২৮ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৮:০৩

ই-কমার্সে আরেক ধাক্কা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা করছেন দেশের লাখ লাখ উদ্যোক্তা। বলা যায়, দেশের ই-কমার্স খাত টিকে আছে অনেকটা ফেসবুকের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত পণ্যের প্রচারণায় ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু হঠাৎ করে ডলার সংকটের কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনী কার্যক্রম সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা অনুমোদিত বিজ্ঞাপনী সংস্থা এইচটিটিপুল। এতে বিপাকে পড়েছেন দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। অনেকে নতুন করে বিজ্ঞাপন দিতে পারছেন না। কারও আবার রানিং বিজ্ঞাপনও আটকে গেছে। ফলে ফেসবুক বুস্টের মাধ্যমে অনেকে তাদের পণ্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন অনলাইননির্ভর উদ্যোক্তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিজ্ঞাপন সীমিত করায় ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য বড় বাজেট থাকে না। বেশির ভাগেরই নিজস্ব কার্ড না থাকায় এজেন্সির মাধ্যমে অল্প বাজেটের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকেন ফেসবুকে। পণ্য গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাতে সাধারণত ৫-১০ ডলারের বিজ্ঞাপন দেন তারা। আর এইচটিটিপুল’র কাছ থেকে বেশি করে ডলার কিনে ব্যবসা করে এজেন্সিগুলো। এখন এইচটিটিপুল সার্ভিস বন্ধ করে দেয়ায় তারাও ব্যবসা করতে পারছে না। এ ছাড়া এইচটিটিপুলের কাছ থেকে সার্ভিস নিতো এমন বড় প্রতিষ্ঠানগুলোও সমস্যায় পড়েছে। তবে ই-কমার্স খাত সংশ্লিষ্টদের দাবি, এইচটিটিপুল যেহেতু মেটার নিজস্ব সংস্থা। সার্ভিস বন্ধ করলেও তারা ছাড়াও বাংলাদেশে অনেক এজেন্সি রয়েছে। তাদের মাধ্যমে উদ্যোক্তারা সেবা নিতে পারবে। সুতরাং সাময়িক সমস্যা হলেও এতে উদ্যোক্তাদের খুব বেশি ক্ষতি হবে না বলে মনে করছেন তারা।

ওদিকে, চলমান অর্থনৈতিক সংকট ও অনাস্থার কারণে এমনিতেই বিপর্যস্ত দেশের ই-কমার্স খাত। ইভ্যালিসহ কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার পর আস্থার সংকট কাটেনি ই-কমার্সে। তবে এবার ঈদুল ফিতরে উদ্যোক্তারা কিছুটা ব্যবসা করতে পেরেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার ঈদে ৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছে, এরমধ্যে ডিজিটাল লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা।

গত মঙ্গলবার গ্রাহকদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ডলার সংকটের কথা বলে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনী কার্যক্রম সীমিত করার ঘোষণা দেয় এইচটিটিপুল। সংস্থাটির বাংলাদেশ লিমিটেডের পরিচালক সানি নাগপাল স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, পরবর্তী নোটিশ না দেয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে মেটার পরিষেবা সাময়িকভাবে পাওয়া যাবে না অথবা সীমিত থাকবে। ডলার সংকট ও বিদেশে টাকা পাঠানো নিয়ে জটিলতার কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানায় সংস্থাটি। চিঠিতে এইচটিটিপুল জানায়, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে ফেসবুকে গ্রাহকদের জন্য তাদের প্রস্তাবিত বিজ্ঞাপনের জায়গা সীমিত হয়ে যাবে। এতে গ্রাহকদের প্রচারের জন্য (এড ক্যাম্পেইন) জায়গা সীমিত হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া কোনো কোনো গ্রাহকের চলমান বা অনাগত প্রচার কার্যক্রম বন্ধ বা বাতিল করা হতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবস্থাপনার পোল্যান্ডভিত্তিক প্ল্যাটফরম নেপোলিয়নক্যাটের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৩৮ লাখ ৬০ হাজার ৮০০। আর বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজারের একটি বড় অংশই ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায় যুক্ত। যারা ফেসবুকে পেজের মাধ্যমে নিজেদের ব্যবসা চালান। পণ্যের প্রচারণার জন্য তারা ফেসবুক বা মেটার প্ল্যাটফরমগুলোতেই বিজ্ঞাপন দেন। ফলে এইচটিটিপুল বিজ্ঞাপন সীমিত করায় ছোট উদ্যোক্তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

উদ্যোক্তাদের ফেসবুকে বুস্ট সার্র্ভিস দিয়ে থাকে ‘এড গ্যালারি’। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী দ্বীন ইসলাম বলেন, আমরা যেহেতু এইচটিটিপুলের কাছ থেকে সার্ভিস নিতাম তাই আপাতত আমাদের এড ক্যাম্পেইন বন্ধ রয়েছে। আমাদের কাছ থেকে প্রতিদিন ১০-১২ জন উদ্যোক্তা সার্ভিস নিতো। কিন্তু এইচটিটিপুল বিজ্ঞাপন সীমিত করায় আর কাউকে সার্ভিস দিতে পারছি না। এ ছাড়া যে ক্যাম্পেইনগুলো রানিং ছিল সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে।

আব্দুল আহাদ নামে একজন উদ্যোক্তা জানান, এইচটিটিপুলের এই সিদ্ধান্তের কারণে উদ্যোক্তাদের বুস্ট করতে সমস্যা হচ্ছে। আল আমিন নামে একজন জানান, গতকাল হঠাৎ করে তার রানিং এড বাতিল হয়ে গেছে। এতে আমাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

তবে এতে উদ্যোক্তাদের খুব একটা সমস্যা হবে না বলে মনে করেন ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর এফ-কমার্স এলায়েন্সের কো-চেয়ারম্যান খালিদ সাইফুল্লাহ্। তার মতে, অনেকেই পাসপোর্ট/ক্রেডিট কার্ডে ডলার ভরার ঝামেলার কারণে সরাসরি নিজেরা কার্ডে বিজ্ঞাপন না দিয়ে এইচটিটিপুলের মাধ্যমে সার্ভিস নেয়। তবে এইচটিটিপুল ছাড়াও অন্য মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া যাচ্ছে। খালিদ সাইফুল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, মেটা তাদের কার্যক্রম সীমিত করেনি, মূলত শুধু এইচটিটিপুলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে তাদের সেবা বন্ধ করে দিচ্ছে। যারা এতদিন নিজের কার্ড দিয়ে নিজের একাউন্টের মাধ্যমে এড ক্যাম্পেইন করেছেন তাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে এতে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা যারা এজেন্সির মাধ্যমে অল্প টাকার বিজ্ঞাপন চালাতেন, তাদের ক্ষেত্রে সাময়িক সমস্যা হবে।

তিনি জনান, ফেসবুকে এড রান করা ডলারের পরিমাণ কতো শতাংশ এইচটিটিপুলের আর কতো শতাংশ উদ্যোক্তাদের নিজেদের কার্ডে হয়, সেটার কোনো ডাটা নেই এখনো। তবে দেশে উদ্যোক্তাদের বুস্টের আনুমানিক ৫-৭ শতাংশের মতো সার্ভিস নেয় এইচটিটিপুল। বাকিরা সবাই নিজেরা নিজেদের কার্ডে বা নিজেদের সোর্সে বুস্ট করে।

ই-ক্যাবের যুগ্ম সম্পাদক ও ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফরম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামের (উই) সভাপতি নাসিমা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, এতে সামগ্রিকভাবে উদ্যোক্তাদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না। কারণ উদ্যোক্তাদের অধিকাংশেরই ডুয়েল কারেন্সি কার্ড আছে, কার্ড দিয়ে নিজেরাই বুস্ট করে। যাদের কার্ড নেই তাদের সমস্যায় পড়তে হবে। কারণ বুস্টিং ক্যাম্পেইন যারা চালান তারা এইচটিটিপুলের সার্ভিস নিতো। তবে এইচটিটিপুল ছাড়াও অনেক এজেন্সি আছে তাদের মাধ্যমেও বিজ্ঞাপন দেয়া যায়। আর বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যারা এইচটিটিপুলের সার্ভিস নিতো তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। আমাদের উদ্যোক্তাতো মাত্র ৫-১০ ডলারের বুস্ট করে। তাছাড়া আমরা আগে থেকেই উদ্যোক্তাদের বুস্ট না করে অর্গানিকভাবে প্রচারণা চালাতে বলছি। সুতরাং এতে উদ্যোক্তাদের খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হবে না।

 

https://mzamin.com/news.php?news=52918