২৮ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৫৯

খেলাপি ঋণ আর রিজার্ভ সরকারের গলার ফাঁস

খেলাপি ঋণ আর বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ এদুটি সরকারের জন্য এখন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দেয়া শর্ত পূরণ না হলে ঋণ পাবে না বাংলাদেশ। এই সমস্যা নিরসনে সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে সংস্থাটি। এ ছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধনের দুর্বল ভিত্তি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। একই ভাবে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোনভাবেই বাড়ছে যা উদ্বেগের প্রধান কারণ।

জানা গেছে, প্রতিনিয়তই সরকারকে আমদানি বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতে করে বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়ানো কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে। আর সরকার যদি আমদানি বন্ধ করে দেয় তাহলে দেশে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে। এতে1 আরো বড় সমস্যার সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণ কোনভাবেই কমাতে পারছে না। তার সাথে রয়েছে ঋণ অবলোপনও। রয়েছে সরকারি ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি সমস্যাও। সব মিলিয়ে খেলাপি আর বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ নিয়ে সরকার চাপে রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের ধারাবাহিক বৈঠকে এসব বিষয় উঠে আসে।এটি হবে বাংলাদেশের জন্য দ্বিতীয় কিস্তি। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ২০ শতাংশ ঋণের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ এই ২০ শতাংশ ঋণের বিপরীতে খেলাপি ঋণের হার অস্বাভাবিক।

বাংলাদেশের জন্য গত জানুয়ারিতে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের শর্তের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। আইএমএফ মিশনকে জানানো হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের ঋণ ও অগ্রিম রয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ৪২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে তাদের খেলাপি ঋণ ৫৬ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকের ৫৮ শতাংশ, আর সবচেয়ে কম সোনালী ব্যাংকের ১৫ শতাংশ। ছয় ব্যাংকের গড় খেলাপি হার দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

সংস্থাটির এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। তবে তার কয়েকদিন পর দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। দলটির বাকি ৭ সদস্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন।

বৈঠকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের উচ্চ খেলাপি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫ লাখ কোটি টাকা। এই ঋণের ৮০ শতাংশের এনপিএল হচ্ছে ৫ শতাংশের নিচে। বাকি ২০ শতাংশ ঋণের এনপিএল অনেক বেশি। আর এই ২০ শতাংশের বড় অংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর। ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ৮০ শতাংশ ঋণ থেকে নিয়মিত আয় হচ্ছে ব্যাংকগুলোর। উচ্চ খেলাপির কারণে বাকি ২০ শতাংশ ঋণ থেকে তেমন আয় হচ্ছে না। এমন ব্যাখ্যার পর এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি আইএমএফ প্রতিনিধি দল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, আইএমএফের ঋণের শর্তপূরণে রাষ্ট্র্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার চাপ রয়েছে। এ অবস্থায় খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা আইএমএফকে জানানো হয়েছে। সেই উচ্চ খেলাপি ঋণের পরিমাণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একটা ব্যাখ্যাও তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন মন্ত্রিসভায় পাস হওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কেও সংস্থাটিকে অবহিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বর শেষে রার্ষ্ট্রায়ত্ত ৬ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা, যা ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ। এর মধ্যে মন্দমানের ঋণই রয়েছে ৫৩ হাজার ২১১ কোটি টাকা বা ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। মন্দ ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। অন্যদিকে, গত ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের মধ্যে ৫টি মূলধন ঘাটতিতে ছিল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া সোনালী, জনতা, বেসিক ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি যথাক্রমে ১ হাজার ৮৩২ কোটি, ১ হাজার ৫০০ কোটি, ২ হাজার ৩০৪ কোটি ও ২ হাজার ১০৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, গত কয়েক বছর সরকারের বাজেট থেকে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে কোনো সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না। এর পরিবর্তে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব সক্ষমতায় মূলধন ঘাটতি পূরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আগের সফরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে আইএমএফকে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। আর বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশের মধ্যে। এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়েছে এখন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত বছরও বেশকিছু নীতি সহায়তামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতের সুশাসনের প্রশ্নেও বেশকিছু কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মেয়াদি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ছাড় অব্যাহত ছিল। এক্ষেত্রে বকেয়া কিস্তির ৫০ শতাংশ পরিশোধ করেই ব্যবসায়ীরা খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া ঋণ পুনঃতফসিলের একটি নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে পেরেছেন ঋণগ্রহীতারা। পাশাপাশি সুদ মওকুফ, ঋণ পরিশোধ ও অবলোপনেরও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা দেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে সার্বিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় গ্রাহকদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও একটা পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারছে। আর এসবের ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খেলাপি ঋণে।

সম্প্রতি মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন-২০২১ পাস হয়েছে। আগামী দেড় মাসের মধ্যে তা সংসদে উত্থাপন করা হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আইএমএফকে জানানো হয়েছে। এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দাতা সংস্থাটি। কারণ বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের শর্তের মধ্যে আইনটি ২০২৩ সালে জাতীয় সংসদে উত্থাপনের বিষয়টিও আছে।

বৈঠক সূত্র বলেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ আইএমএফের মিশনকে জানিয়েছে যে দেশে চাহিদার তুলনায় বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কম। দেশের অর্থনীতি এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) দিয়ে সংকটের মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে মার্কিন ডলারের অভাবে পণ্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় ছিল যেখানে ৮৩২ কোটি ডলার, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা দাঁড়ায় ৫১৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছর আগের তুলনায় শুধু এক মাসে আমদানি ব্যয় কম হয়েছে ৩৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট পুরোপুরি না কাটার কারণ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতের জন্য আগে খোলা এলসির নিষ্পত্তি এখনো করতে হচ্ছে।

মিশনকে জানানো হয়েছে, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভুগছে। কোভিড মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ব্যাঘাত ঘটার কারণেই এমন পরিস্থিতি হয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য ধীরে ধীরে বাড়ছে।

আইএমএফ চায় পাঁচটি আইনের সংশোধন। ঋণ কর্মসূচিতেও এ কথা রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মিশনকে জানায়, ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩ গত ২৮ মার্চ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা কমিটি। এটা এখন সংসদে পাঠানো হবে।
এক পরিবার থেকে ব্যাংকের পর্ষদে একাধিক ব্যক্তি যাতে থাকতে না পারেন এবং টানা ৯ বছর তাঁরা যাতে পর্ষদে থাকতে না পারেন, এটা আইএমএফের চাওয়া। বর্তমানে এক পরিবারের চারজন টানা ৯ বছর থাকতে পারেন ব্যাংকের পর্ষদে। আইনের খসড়ায় চারজন থেকে কমিয়ে তিনজন করা হলেও টানা বছরের ব্যাপারে হাত দেওয়া হয়নি। খসড়ায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনাসহ তাদের বিভিন্ন সুবিধা কর্তনের কথা বলা হয়েছে।

গতকালের বৈঠকে আইএমএফের দল খসড়াটি দেখতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সংসদে পাঠানোর আগে তা দেখতে দেওয়া সম্ভব নয়। আরও জানানো হয়, হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন, ১৮৮১ এর সংশোধনের খসড়া এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাসংক্রান্ত কমিটিতে আছে।

দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭ এর সংশোধনের খসড়াটি পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩কে নতুন করে করা হচ্ছে। ৫ এপ্রিল এর খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার (ভেটিং) জন্য পাঠানো হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন, সংসদ ও বিচারবিষয়ক বিভাগে। অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ এর সংশোধনের খসড়াও আছে ভেটিংয়ের জন্য।

বলা হয়, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলো থেকে আমানত সরিয়ে গ্রাহকেরা তা নিয়ে গেছেন প্রচলিত ধারার ব্যাংকে। ইসলামি ধারার এ ব্যাংকগুলো এতে বড় ধরনের আমানত–সংকটে ভুগছে। কয়েক মাস ধরে এ ঘটনা ঘটছে। তবে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের আমানতের চিত্র ইতিবাচক। মিশন এ ব্যাপারে বিশদ চিত্র জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ জন্য সময় চেয়েছে।

বৈঠকের চিত্র তুলে ধরলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ভালোই বলেছে আইএমএফকে। বলে তো আর লাভ নেই। মোদ্দা কথা হচ্ছে সমাধান করতে হবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের ঘাটতির পাশাপাশি অন্য সমস্যা হচ্ছে পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাগত। নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার জন্য ব্যাংকগুলোতে যথাযথ লোক নিয়োগ দেওয়া হয় না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগই এ জন্য দায়ী। কারণ, নিয়োগের সুপারিশটি এ বিভাগই করে।

https://dailysangram.info/post/523101