২৮ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৫৫

ঈদযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদ এসেছিল, মোটামুটি ৫ দিন সরকারি ছুটি ছিল। মানুষ আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদ করার জন্য উৎসবের কাছে ফিরে গিয়েছিল। শহর মোটামুটি ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। ঈদের কেনাকাটায় উপচে পড়েনি সাধারণ মানুষ তার আগে থেকেই সমাজের ভেতর এক ধরনের হাহাকার চলছিল। দ্রব্যমূল্যের সীমাহীন-বৃদ্ধির ফলে কঠিন চাপে আছে মানুষ। এখন মধ্যবিত্ত পর্যন্ত সকলেরই নাভিশ্বাস চলছে। পত্রপত্রিকার রিপোর্টে দেখলাম বহু মানুষ অর্থের টানাটানিতে প্রোটিন খাওয়া খুবই কমিয়ে দিয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের পুষ্টির তীব্র সংকটের সৃষ্টি করবে। এখন নিয়ম হয়ে গেছে দাম যদি একবার বাড়ে, তাহলে আর কমতে চায় না। ডিমের দাম নতুন করে খুব একটা বাড়েনি। কিন্তুু ব্রয়লার মুরগির দাম আবারো বেড়ে কেজি প্রতি ৩০০ টাকার কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে, গরুর গোশতে হাতই দেওয়া যায় না। সরকার অবিরাম ঢাক পেটাচ্ছে যে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই আছে। এই সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত নয়, নির্বাচিত হতে তাদের সাধারণ মানুষের ভোটের প্রয়োজন পড়েনি। দলীয়করণকৃত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন দিনের ভোট আগের রাতেই প্রায় শত ভাগ দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে রেখেছিল। সরকার যাকে যাকে চেয়েছে তাদের নাম ঘোষণা করে দিয়েই নির্বাচন কমিশন জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে তাদের নির্বাচিত ঘোষণা করে দিয়েছে। এমন আজব নির্বাচনের কথা পৃথিবীতে কেউ কখনো শোনেনি। ফলে এই তথাকথিক নির্বাচন নিয়ে সারা বিশ্বে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছিল। সরকার যেহেতু গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নয়, সেহেতু জনগণের কাছে কোনো কৈফিয়ত দেয়ার দায়ও তাদের নেই।

দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটেছে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভে। আর এই ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যরা ও নেতৃবৃন্দ সবাই সরকারি দলের সদস্য। ফলে তারা যথেচ্ছা দাম বাড়ায়। আর লুটে নেয় সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা। সরকারের তরফ থেকে কিছুদিন ধরে বলা হলো যে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যেন সরকারের কিছুই করার নেই। এ নিয়ে সরকার এমনসব মিথ্যা ও আজগুবি কথাবার্তা বলতে থাকল যে, মানুষের কষ্টে হাসি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না। এ কথা ঠিক যে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম কমে আসলেও সরকার আর দাম কমায় না। এর প্রভাব পড়ে কৃষিতে ও শিল্পে। পণ্যের দাম বাড়ে। আর ব্যাপক দুর্নীতির ফলেও পণ্যের দাম বাড়ে। এর মাশুল গুনতে হয় সাধারণ মানুষকে। ফলে দুর্দশা আরো বাড়ে।

বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো সাধারণত দেখি না। কিন্তু ঈদের ছুটিতে টিভি চালিয়ে এক স্বর্গরাজ্যের সন্ধান পেলাম। সেখানে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল যে, মানুষ ঈদের কেনাকাটায় খুব সুখে লিপ্ত আছে। এটা যদি না বলে তাহলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারের’ দায়ে কিংবা সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ ক্ষুণœ করার দায়ে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হতে পারে। চাই কি সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে মধ্য রাতে যেকোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতে পারে।

সরকারের উন্নয়নের জজবা এখন পুরনো হয়ে গেছে। তারপরও প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলেছেন যে, এত উন্নয়ন করলাম, তা সত্ত্বেও জনগণ কেন তাদের পেছনে যায়। আমরা যারা উন্নয়ন খুব একটা দেখতে পাই না তাদের চোখ দেখানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। উন্নয়ন বলতে সরকার দু’একটা কুমির ছানা ধরে আনে। পদ্মা সেতু আর মেট্রো রেলই প্রধান। সন্দেহ নেই, পদ্মা সেতু উন্নয়নের একটা চিহ্ন বটে। এতে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। বুড়িগঙ্গা সেতুও উন্নয়নের স্মারক ছিলো।

আর মেট্রো রেল এখনও যতনা পরিবহনের কাজে লাগছে, তার চাইতে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে বিনোদন কেন্দ্র হিসাবে। মানুষ বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে বিনোদনের জন্য মেট্রোরেলে উঠছেন। যে বাচ্চাটি তখনও উঠতে পারেনি তার বিষণœ চেহারা টেলিভিশনে দেখতে পাই। যারা সফল হন তারা রেল থেকে নেমে টিভি ক্যামেরার সামনে হাসি মুখে বলে, খুব আনন্দ পেয়েছি। জিয়াউর রহমান যখন শিশুপার্ক করেছিলেন তখনও শিশু ও তার অভিভাবকদের একই রকম অনুভূতি দেখেছি ও শুনেছি। কিন্তু সেটি পার্কই ছিল, রেল নয়।

কিন্তু আমরা যারা ঝাপসা দেখি তারা এর পেছনে কত দুর্নীতি হলো সেটা দেখার চেষ্টা করি। সে এক মহা দুর্নীতি কান্ড। ফ্লাইওভারে দুর্নীতি, সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি, মেট্রো রেলে দুর্নীতি, প্রকল্পে দুর্নীতি এসব দেখতে দেখতে আমাদের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে। দেশ এখন এক সর্বনাশা দুর্নীতির কবলে পড়েছে। আর এসব দুর্নীতি ঢাকতে সরকারের রথী-মহারথীরা অবিরাম মিথ্যা কথা বলে চলেছেন। সব মিথ্যা কথার জবাব দিতে ব্যর্থ হয়ে মন্ত্রীরা অবিরাম সাংবাদিকদের গালি গালাজ করছেন। তারা হাটুরে ভাষায় সাংবাদিকদের এমন সব ভাষায় অভিযুক্ত করেন যে, তখন দুঃখ হয়। এইসব লোক আমাদের মন্ত্রী, সরকারের দাবি পদ্মাসেতু নাকি তারা নিজের টাকায় করেছেন। সরকারের নিজের টাকায়ও যদি হয়ে থাকে, তবে তাও জনগণের টাকা। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. ইউনূস এবং বেগম খালেদা জিয়া নাকি পদ্মাসেতু হতে বাধা দিয়েছিলেন। সেজন্য ড. ইউনূসকে পদ্মাসেতু থেকে ‘টুপ করে’ ফেলে দিয়ে চুবিয়ে আনা উচিত। আর বেগম খালেদা জিয়াকে একেবারে সেতু থেকে নদীতে ফেলে দেয়া উচিত। এই দুইজনই এ দেশের সম্মানিত ব্যক্তি। বেগম খালেদা জিয়াকে তো জেলে পুরেই রেখেছেন। ড. ইউনূসকে একের পর এক মামলা দিয়ে যাচ্ছেন। এতো অসম্মানিত হওয়া খুব কম নোবেল বিজয়ীর কপালে ঘটেছে।

আবার আমরা এমনও দেখেছি যে, কেবলমাত্র দুর্নীতির জন্যই সংযোগ সড়ক ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে বহু সংখ্যক সেতু। যেগুলো উন্নয়নে মাইলফলক হিসাবে বছরের পর বছর অব্যবহৃত দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বড় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে, যার নিচ দিয়ে কেবল কোষা নৌকা পার হতে পারে। একটি বড় নৌকা বা লঞ্চ পার হতে পারে না। এ রকমও বেশ কিছু সেতু রয়েছে। এসব সেতুর পরিকল্পনা কে করলো, অনুমোদন কে দিল, ঠিকাদারি কে পেলো তার অনুসন্ধান কেউ করে না। নদীর পানির শুকনো মৌসুমের উচ্চতা ধরে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত তারা অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। তারা ধরেই নিয়েছিলেন যে, ভারত যেহেতু পানিই দিচ্ছে না, উজানে বাঁধের পর বাঁধ দিচ্ছে, সেখানে সেতু বেশি উঁচু করে কী লাভ? বরং সেতু নিচু করে তারা টাকার সাশ্রয় করেছেন।

এক সময়তো এই নদী দিয়ে আর কোন বড় নৌকা বা জাহাজ চলবে না। পরিস্থিতি তেমন হলেও যখন ঢল আসে তখন বিপাকে পড়ে যায় কৃষক ও যাত্রীরা। সেতু তো বানিয়ে দিয়েছি। মানুষ ক’টা দিন কষ্ট করতে পারবে না? এবার ঈদের আগে ভয়গ্রস্ত টিভি চ্যানেলগুলোকে খুব ঘটা করে বলতে শুনলাম রেল যাত্রার আনন্দ অতি চমৎকার। যাত্রীরা ঠেলাঠেলি, হুড়োহুড়ি ছাড়াই আগাম কাটা টিকিটে নির্বিঘেœ আনন্দের সঙ্গে রেলে ভ্রমণ করছেন। যদি সত্যি সত্যি তাই হয়ে থাকে তবে বিনা টিকেটের কোনো যাত্রী রেলে ভ্রমণ করতে পারেননি। কিন্তু সবসময় কি আর নির্দেশ অনুযায়ী চলে? ক্যামেরার ফাঁক দিয়ে ছাদ ভর্তি অসংখ্য যাত্রী দেখলাম পুরানো নিয়মে। সামনে ফিটফাট, ছাদে সদরঘাট।

এখন সমস্ত টিভি চ্যানেল সরকারি নির্দেশে চলে। প্রতিটি টিভি চ্যানেল মন্ত্রী, এমপি বা অন্য কোনো প্রভাবশালীর কবলে। টিভি রিপোর্টিং দেখে মনে হলো যেনো রিপোর্টাররা একটি স্ক্রীপট-ই তোতা পাখীর মতো পড়ে শোনাচ্ছেন। জয় বাংলা। অস্বীকার করবো না লঞ্চে ভিড় ছিলো কম। লঞ্চ মালিক-শ্রমিকরা বলেছেন পদ্মা সেতু হওয়ায় মানুষ দূরপাল্লার বাসে করে কম সময়ে গন্তব্যে যেতে পারছেন। ফলে লঞ্চের যাত্রী কমেছে। তবে হতাশ নন তারা। লঞ্চে ভাড়া কম, বাসের অনেক বেশি। পদ্মা সেতু একবার দেখা হয়ে গেলে যাত্রীরা ফের লঞ্চমুখী হয়ে যাবেন।

ঈদ চলে গেছে। মানুষ ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছে। ঢাকার রাস্তা এখনো অনেকটাই ফাঁকা। ধারণা করি, দুই-চারদিনের মধ্যে পুরানো দৃশ্য ফিরে আসবে। এরপর দেখা যাবে রেলের কৃত্রিম স্বস্তি কতদিন টেকে।

 

https://dailysangram.info/post/523063