২৬ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ১১:০৫

আছে অনুমোদন, নেই বিদেশে বিনিয়োগ

দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমোদন পাওয়ার জন্য উদ্যোক্তাদের একটি অংশের বেশ আগ্রহ ছিল। গত বছর এ বিষয়ে নতুন বিধিমালা প্রণয়নের আগে কিছু কোম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদনও দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ২০২০, ‘২১ ও ‘২২ সালে অনুমোদন পাওয়া ১২টির মধ্যে ১১টি প্রতিষ্ঠানই দেশের বাইরে বিনিয়োগ করেনি। মূলত, চলমান ডলার সংকট এবং টাকার বড় দরপতনের কারণে তারা ধীরে চলার নীতি নিয়েছে। অন্যদিকে, বিদেশে বিনিয়োগে নতুন নীতিমালার আওতায় দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে।

বাংলাদেশের মূলধন হিসাব উন্মুক্ত নয়। যে কারণে কেউ ইচ্ছা করলেই বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে না। বিনিয়োগ করতে চাইলে নির্ধারিত প্রক্রিয়া মেনে আবেদন করতে হয়। এর পর যাচাই-বাছাই শেষে সরকার নির্ধারিত কমিটি অনুমোদন দেয়। যদিও বাংলাদেশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশে বিনিয়োগের চেয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত কিংবা কর ফাঁকির অর্থ বিদেশে পাচার করেন অনেকে। পাচারের অর্থ দিয়ে তাঁদের অনেকেই অবৈধভাবে বিনিয়োগও করেন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলার সংকটের অন্যতম কারণ বিবেচনা করা হয় বিভিন্ন উপায়ে পুঁজি পাচারকে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বিদেশে বিনিয়োগের বৈধ অনুমোদন রয়েছে ২৩টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে ২১টি প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে ৭ কোটি ৭০ হাজার ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের অনুমোদন নিয়েছে। আর কারিগরি পরামর্শ ও অন্যান্য সেবার বিপরীতে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার দুটি কোম্পানিতে বড় অঙ্কের শেয়ার পেয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস। অনুমোদন পাওয়াদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১০টি প্রতিষ্ঠান ৪ কোটি ১ লাখ ৪৮ হাজার ১৩৫ ডলার দেশের বাইরে নিয়েছে।

স্টিল খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) কেনিয়া ও হংকংয়ে প্রায় ৫২ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পায়। ২০১৬ সালে কেনিয়ায় প্রায় ৪৬ লাখ ৭০ হাজার ডলার বিনিয়োগ অনুমোদনের বিপরীতে এখন পর্যন্ত নিয়েছে মাত্র ২৭ হাজার ২০০ ডলার। আর হংকংয়ে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিনিয়োগের অনুমোদন পেলেও এখনও কোনো অর্থ নেয়নি। জানতে চাইলে বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত সমকালকে জানান, কেনিয়ায় কোম্পানি খুলে উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে। সেখানে তাঁরা জমি খুঁজছেন। আর হংকংয়ে আগে থেকে তাঁদের ট্রেডিং ব্যবসা রয়েছে। শিগগিরই বাকি ডলার নিয়ে কোম্পানি গঠন করবেন। তিনি জানান, বাংলাদেশে সব ধরনের কাঁচামাল বাইরে থেকে আনতে হয়। এখানে মূল্য সংযোজন বলতে শুধু শ্রম। ফলে যেসব দেশে কাঁচামাল পাওয়া যায় সেখানে কারখানা করে উৎপাদন করা গেলে বেশি লাভবান হওয়া সম্ভব। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর মাধ্যমে দেশও বেশি উপকৃত হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, গত বছরের শুরুর দিক থেকে ডলার সংকট প্রকট হয়েছে। এতে করে এক বছরে প্রতি ডলারে দর বেড়েছে ২৫ শতাংশের মতো। এখন নিয়মিত ব্যবসা চালাতে অনেকে হিমশিম খাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে দেশের বাইরে বিনিয়োগ নেওয়ায় নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের অনুরোধে গত বছর বিধিমালা করা হয়। এর পর ডলার সংকটের বিষয়টি প্রকট হয়েছে। যে কারণে আপাতত বিদেশি বিনিয়োগের যাচাই কমিটি কোনো বৈঠক করছে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু উৎপাদনের জন্যই দেশের বাইরে বিনিয়োগ নেওয়া হয়, তেমন নয়। ওষুধসহ কিছু ক্ষেত্রে পণ্য বাজারজাত করার সুবিধার জন্য বা সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে নামমাত্র বিনিয়োগ নিয়ে কোম্পানি খুলতে হয়। বাংলাদেশে উৎপাদিত হলেও তখন সেই দেশে খোলা কোম্পানির নামে পণ্য বাজারজাত করা যায়। অবশ্য শুধু পণ্য বাজারজাত করার জন্য অনেক কোম্পানির বিদেশে শাখা বা লিয়াজোঁ অফিস রয়েছে। তৈরি পোশাক, ওষুধসহ বিভিন্ন খাতের প্রতিষ্ঠান পণ্য বিপণনের সুবিধার্থে লোক নিয়োগ দিয়ে বিদেশে এ ধরনের অফিস পরিচালনা করে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অন্য কোনো সংস্থার অনুমতির প্রয়োজন হয় না।

বাংলাদেশিদের দেশের বাইরে বিনিয়োগ বিষয়ে আগে কোনো বিধিমালা ছিল না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবেদনের ভিত্তিতে এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংকে গঠিত বাছাই কমিটি কেস টু কেস ভিত্তিতে অনুমতি দিত। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে গত বছরের ১৬ জানুয়ারি বিধিমালা করা হয়। নতুন বিধিমালার আওতায় শর্তসাপেক্ষে একজন রপ্তানিকারক তার পাঁচ বছরের বার্ষিক গড় রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশ অথবা নিট সম্পদের ২৫ শতাংশের মধ্যে যা কম, সে পরিমাণ বিনিয়োগের আবেদন করতে পারেন। রপ্তানিকারকের সংরক্ষিত (রিটেনশন) কোটা বা ইআরকিউ হিসাব থেকে শুধু সমজাতীয় খাতে বিনিয়োগের আবেদন করা যাবে। নতুন বিধিমালায় সম্প্রতি দুটি প্রতিষ্ঠান আবেদন করলেও এখনও অনুমতি পায়নি।

অনুমতি পেয়েও বিনিয়োগ নেয়নি যারা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বাইরে বিনিয়োগের অনুমোদন পেলেও বিনিয়োগ না করার তালিকায় রয়েছে ১১টি প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি চার কোম্পানি পাঁচ দেশে এক কোটি ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। তবে একটি প্রতিষ্ঠানও এখনও বিনিয়োগ নেয়নি। এর মধ্যে ওষুধ খাতের রেনাটা লিমিটেড যুক্তরাজ্যে ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়েছে। এ ছাড়া রেনেটা আয়ারল্যান্ডে আগেই থাকা অপর এক কোম্পানিতে নতুন করে ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ বাড়ানোর অনুমতি পেয়েছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ফিলিপাইনে ১০ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। বিএসআরএম নতুন করে হংকংয়ে ৫ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। কলম্বিয়া গার্মেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান হংকংয়ে ১৫ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি নিয়েছে।

২০২১ সালে নাসা গ্রুপের মালিকানাধীন এজে সুপারগার্মেন্ট সৌদি আরবে সিটি অব ড্রিমস ফর ডেটস কোম্পানিতে ৫০ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি নেয়।। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ রুটি, কেকের মতো পণ্য তৈরি করে ভারতের সেভেন সিস্টার অঞ্চলে বাজারজাত করতে দেশটিতে কোম্পানি খুলে সেখানে ২০ লাখ ৬২ হাজার ৬৬৫ ডলার বিনিয়োগের অনুমতি নিয়েছে। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় এখনও তারা সে অর্থ নিতে পারেনি। এমবিএম গার্মেন্টস ১ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পায়। ইনসেপ্টা ফার্মা যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ডলারের কোম্পানি খোলার অনুমতি পেলেও এখনও তা নেয়নি। এ ছাড়া বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস সিলন নামে শ্রীলঙ্কায় বেশ আগেই একটি কোম্পানিতে ৬০ লাখ ডলার নেওয়ার অনুমোদন পেলেও এখনও বিনিয়োগ করেনি।

২০২০ সালের নভেম্বরে সামিট পাওয়ার ভারতে গঠিত সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট ইস্ট গেটওয়ে প্রাইভেট কোম্পানিতে ৯৯ হাজার ৮০০ ভারতীয় রুপি বিনিয়োগের অনুমতি নিয়েও তা করতে পারেনি। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় টেকআউট লঙ্কা নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ৫৫০ শ্রীলঙ্কান রুপি বিনিয়োগের অনুমতি পেলেও তা আর নেয়নি।
বিনিয়োগ ফেরত এনেছে দুই কোম্পানি

দেশ থেকে প্রথমবারের মতো ২০১৩ সালে মিয়ানমারে একটি যৌথ মূলধনি কোম্পানিতে বিনিয়োগের অনুমতি পায় মবিল যমুনা। শুরুতে ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার নিয়ে মিয়ানমারে এমজেএল অ্যান্ড একেটি পেট্রোলিয়াম কোম্পানি গঠন করে। পরবর্তী সময়ে আরও ৩ লাখ ৭৭ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে। তবে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ না পাওয়ায় ২০১৯ সালে শেয়ার বিক্রি করে লাভসহ ১৩ লাখ ডলার ফেরত এনেছে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ওষুধ খাতের কোম্পানি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস এস্তোনিয়ায় আড়াই হাজার ইউরো বিনিয়োগ করে। এ বিনিয়োগের বিপরীতে সেখানে ইনসেপ্টা নরডিক ওইউর ৫০ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয়। তবে পরবর্তী সময়ে সেই শেয়ার দেশটির কমেড বালিটিক ওইউর কাছে ২ হাজার ৬১৩ ইউরোতে বিক্রি করে বিনিয়োগ ফেরত এনেছে।

কোথায় কার বিনিয়োগ
তৈরি পোশাক খাতের ডিবিএল গ্রুপ ২০১৫ সালে ইথিওপিয়ায় ৯৫ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন নেয়। চার ধাপে ২০১৮ সালের মধ্যে পুরো অর্থ নিয়ে ডিবিএল ইন্ডাস্ট্রিজ পিএলসি গঠন করে উৎপাদন শুরু করে তারা। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল ২০১৬ সালে কেনিয়ায় ১ কোটি ২০ লাখ এবং ২০২০ সালে একই কোম্পানিতে আরও ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন পায়। এরই মধ্যে তারা ১ কোটি ডলারের বেশি নিয়েছে সেখানে। মবিল যমুনা মিয়ানমারের বাইরে ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরের এমজেএল (এস) পিটিই নামে একটি কোম্পানিতে ১ লাখ ডলার বিনিয়োগ করে।

আকিজ জুট মিলস ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগ করে। সেখানকার আকিজ রিসোর্সেস এসডিএন বিএইচডি নামের কোম্পানিতে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ নিয়েছে ২ কোটি ডলার। পাশাপাশি মালয়েশিয়া থেকে ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে এ কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে। স্পেকট্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরে সাড়ে ১০ হাজার সিঙ্গাপুর ডলার বিনিয়োগ করে। ওই বছর সার্ভিস ইঞ্জিন নামের অপর একটি কোম্পানি সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাড়ে ৭ হাজার ডলার বিনিয়োগ নেয়। প্রতিষ্ঠানটি সেবার ফি হিসেবে ইতোমধ্যে ১৫ হাজার ৯০১ ডলার দেশে এনেছে। এসিআই হেলথকেয়ার যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য বিক্রির ১০০ ডলার দেশে ফেরত না এনে ২০১৭ সালে নামমাত্র একটি কোম্পানি গঠন করে।

https://samakal.com/economics/article/2304169348