২৬ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ১১:০০

পোল্ট্রি খাতে জিম্মিদশা

হুমকির মুখে পড়েছে দেশের পোল্ট্রি খাত। কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে সম্ভাবনাময় খাতটি। প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খামার। চুক্তিভিত্তিক খামারে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীদের। কারসাজির মাধ্যমে দাম বৃদ্ধি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে করপোরেট চক্রটি। মুরগির খাবার, ওষুধ ও বাচ্চা উৎপাদনের জন্য বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভরশীল খামারিরা। কিন্তু এসব কিছুর দাম বৃদ্ধি করে খামারিদের উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। চুক্তিভিত্তিক খামারে বাধ্য করতে প্রান্তিক পর্যায়ে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করে দিয়ে নিজেরা কম খরচে উৎপাদন করে নিজেদের মতো মূল্যবৃদ্ধি করে দেয়। এমনকি মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে আড়তদার ও খামারিদের দামও ঠিক করে দেয় তারা। কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন খামারিরা।

এতে ব্যবসায় টিকে থাকতে না পেরে খামার বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেকে। গত এক বছরে প্রায় ৪০ শতাংশ খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সরাসরি জড়িত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তাদের যোগসাজশে সিন্ডিকেটকারীরা ভোক্তা ও খামারিদের জিম্মি করে মুরগির দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন ছোট খামারিরা পথে বসছে, অন্যদিকে ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে সাধারণ ভোক্তারা।

খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে ডিম-মুরগির মোট উৎপাদনের ৮০ শতাংশই হয় ক্ষুদ্র খামারিদের মাধ্যমে। অথচ মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন করেই পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান। সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিনিয়তই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সাধারণ খামার। তারা চুক্তিভিত্তিক ফার্মগুলোকে ৩৫-৪৫ টাকায় বাচ্চা দেয়, আর সাধারণ খামারিদের কিনতে হয় ৮০-৯০ টাকায়। মুরগির খাদ্য এবং ওষুধে কম দাম রাখাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে। ফলে লোকসানে পড়ে খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন অনেকে। সংগঠনটির দাবি, বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনের সকল পণ্যের দাম প্রতি কেজিতে ১২ থেকে ১৪ টাকা কমেছে। কিন্তু ফিডের দাম কমেনি। কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করে খামারিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ খামার নেয়ার জন্য বাচ্চা ও ফিডের দাম অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। কর্পোরেটের এই সিন্ডিকেটের সুযোগ করে দেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার মানবজমিনকে বলেন, মুরগির দাম কমিয়ে রাখতে চাইলে উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। কিন্তু তারা যখন ফিডের দাম কমিয়ে দেয় তখন আবার মুরগির দামও একেবারে কমিয়ে দেয়। তখনো আমাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। আবার ফিডের দাম বৃদ্ধি করে খামারিদের চুক্তিবদ্ধ খামারে নিতে উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি করে। তখন নিজেরা বেশি বেশি উৎপাদন করে দাম বাড়িয়ে শুধু নিজেরা লাভবান হয়। অন্যদিকে চুক্তিবদ্ধ খামারেও ছোট ব্যবসায়ীদের লাভ খুব দেয়া হয়। এ অবস্থায় খামারিরা অসহায় হয়ে পড়েছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। হুমকির মুুখে পড়েছে পোল্ট্রি খাত।
তিনি বলেন, প্রান্তিক খামার থেকে এখন যে মুরগি বাজারে আসছে তার উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। কিন্তু কোম্পানির উৎপাদন খরচ আগের থেকে অনেক কম। অথচ দাম বৃদ্ধি করে বেশি লাভ করছে তারাই। আর খামারিরা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।

বাজারে ডিম ও মুরগির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে গত আগস্টে কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কারসাজির প্রমাণ পেয়েছিল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। একটি প্রতিষ্ঠান দুই দিনের ব্যবধানে আড়াই টাকা বেশি দরে ডিম বিক্রি করায় বাজারে দাম বেড়ে যায় বলে তদারকিতে বেরিয়ে আসে। পরে গত ২৩শে মার্চ জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আয়োজিত এক সভায় খামারি পর্যায়ে মুরগি ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় বড় চার প্রতিষ্ঠান। তবে খামারিদের অভিযোগ, সাধারণ খামারিদের মুরগি বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই দিনের মধ্যে এই দাম ১৬০ টাকায় নামিয়ে দেয় কোম্পানিগুলো। ফলে খামারিদের উৎপাদন খরচের চেয়েও মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য করছে তারা। অন্যদিকে খুচরা বাজারে এখনো মুরগির দাম ২২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হতে দেখা গেছে। এর আগে হঠাৎ করে বাড়তে থাকে ব্রয়লার মুরগির দাম। বাড়তে বাড়তে ১৫০ টাকার মুরগি মাসের ব্যবধানে ২৭০ টাকায় উঠে যায়। এরপর ডিম ও মুরগির বাজারের নিয়ন্ত্রণ বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিয়েছে বলে অভিযোগ ছোট খামারিদের।

পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিয়ন্ত্রিত খামারগুলোকে যে দামে বাচ্চা বা খাদ্য দিয়েছে, আমাদের সেই দামে না দেয়ার কারণে মুরগি তুলতে পারছিলাম না। এ সময় তারা মাত্র ৫২ দিনে বাচ্চা এবং ব্রয়লার মুরগি থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আবার আমরা রমজান মাসকে সামনে রেখে বেশি খরচেই মুরগি পালন করেছিলাম কিছু লাভের আশায়। কিন্তু এখন সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে মুরগি ছেড়ে প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংস করে দিচ্ছে তারা। এভাবে ছোট খামারিদের ধ্বংস করে আবারো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মুরগির বাজার অস্থির করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে কর্পোরেট চক্র।

সুমন হাওলাদার মনে করেন, বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য দায়ী বিগত ৩০ বছরেও দক্ষ সাপ্লাই চেইন গড়ে না ওঠা। খামারিরা সব সময় অসহায়। ডিম বা ব্রয়লার উৎপাদনের সকল দরকারি পণ্যের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা নাই। শতভাগ ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদন করা ডিম বা মুরগি বিক্রিতেও তাদের দামাদামি করার সুযোগ নেই। তাই ভোক্তা বান্ধব ও উৎপাদনকারীদের যৌক্তিক লাভ দিতে পারে এমন একটি দক্ষ সাপ্লাই চেইন বর্তমানে বাংলাদেশের পোল্ট্রির উৎপাদন ও বিপণনে শৃঙ্খলা আনতে অতি জরুরি।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর চেয়ারম্যান গোলাম রহমান মানবজমিনকে বলেন, সরকারের সংস্থাগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সিন্ডিকেট করে ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। তাদের কারণে আমরা ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তিনি বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রতিযোগিতা কমিশনেরও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কারণ তারা প্রতিযোগিতা পরিপন্থি কাজ করছে।

https://mzamin.com/news.php?news=52627