২৬ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ১০:৪৮

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ৯ বছর পূর্ণ


নারায়ণগঞ্জ থেকে তমিজউদ্দিন আহমদ: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ঘটনার ৯ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২৭ এপ্রিল। নির্মম এ হত্যাকান্ডের মাত্র ৩৩ মাস পর জেলা জজ আদালতে রায় ঘোষণা এবং এরপর ১৯ মাসে হাইকোর্টে রায় হয়েছে। বর্তমানে আপীল বিভাগে প্রায় সাড়ে ৪ বছর ধরে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে এ মামলাটি। বিচারের ধীরগতির কারণে নিহতদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে ক্ষোভ, হতাশা, ভয় ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। হাইকোর্টের রায় আপীল বিভাগে বহাল রেখে অবিলম্বে রায় কার্যকর করার দাবী নিহতদের পরিবার সহ সাধারণ মানুষের। তাদের প্রত্যাশা আপীল আদালতেও নি¤œ আদালতের রায় বহাল থাকবে। এ রায় কার্যকর হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতাসীন অপরাধীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। জেলা জজ আদালতে ৩৫ আসামীর মধ্যে ২৬ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিলেও হাই কোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে বাকীদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। অপহরণের তিনদিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দরের শান্তিরচর থেকে সাত জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এই ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন ফতুল্লা থানায়। পরে আদালত আসামীদের স্বীকারোক্তি, জবানবন্দী ও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ৩৩ মাস পর জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারী রায় প্রদান করেন। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ৭ জনকে ১০ বছর করে এবং ২ জনকে ৭ বছর করে কারাদন্ড প্রদান করা হয়।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামীপক্ষ আপিল করলে দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৮ সালে ২২ আগস্ট হাইকোর্ট ১৫ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ বহাল রাখেন। আর বাকীদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করেন। আপীল বিভাগে সাড়ে ৪ বছর ধরে এ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারের পরিবারের দাবি আপীল আদালতে যেন এ রায় বহাল রাখেন। রায় দ্রুত কার্যকর হলে নিহতদের আত্মা শান্তি পাবে এমনটাই দাবি। উচ্চ আদালতে ধীরগতির কারণে এখনো নিহতদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে ক্ষোভ, হতাশা ও অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে বলে জানান মামলার বাদী ও নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি। তিনি মনে করেন ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ধীরগতি হচ্ছে। দ্রুত রায় বাস্তবায়নে চান প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ।

নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মিজানুর রহমান রিপন নি¤œ আদালত থেকে হাইকোর্টের দেয়া রায় সন্তোষজনক হয়েছে জানিয়ে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা আপীল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকবে প্রত্যাশা করে তা দ্রুত কার্যকর করার দাবী জানান। আর এজন্য প্রধানমন্ত্রীর দেয়া সুবিচারের আশ^াসের বাস্তবায়ন চান তারা।

নারায়ণগঞ্জ জেলা মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান মাসুম বলেন, জেলা জজ ও হাই কোর্টের রায় নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য স্বস্তির। উচ্চ আদালতে কার্যক্রম দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তি করার জন্য প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ দাবী করেন নারায়ণগঞ্জের মানবাধিকার কর্মীসহ সচেতন নাগরিকরা। তারা দ্রুত এ ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানান।
শুধু নারায়ণগঞ্জ নাগরিক সমাজই নয় নি¤œ আদালতের রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত ফাঁসি কার্যকর করার দাবী সাধারণ মানুষেরও। রায় বাস্তবায়িত হলে এটা ক্ষমতাসীন অপরাধীদের জন্য দৃষ্টান্ত ও যুগান্তকারী হয়ে থাকবে বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জবাসী।

পিছনে ফিরে দেখা : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সাত খুনের নৃশংস ঘটনা শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, দেশবাসীসহ বিশে^ নাড়া দিয়েছিল। ৭ জনকেই হত্যা করা হয়েছিল নৃশংসভাবে। হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয়া হয় লাশ। যাতে ভেসে না উঠে সে জন্য লাশের সাথে ইট বেঁধে দেয়া হয়।

সাত খুনের ঘটনায় ১২৭ সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জন সাক্ষ্য প্রদান করে। আদালতে ১৬৪ ধারায় ২১ আসামীর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। আসামীরা তাদের জবানবন্দীতে হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়।
মামলার নথি, চার্জশিট, জবানবন্দী ও সুরতহাল রিপোর্ট সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামকে অপহরণের দিনক্ষণ আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল সিদ্ধিরগঞ্জ থানার একটি চাঁদাবাজির মামলায় স্থায়ী জামিন নিতে নজরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ আদালতে যান। এ সম্পর্কে মেজর (অব.) আরিফ হোসেন নিশ্চিত হয়েই সেদিন সকালে অপহরণ পার্টিকে বিভিন্ন পয়েন্টে দাঁড় করিয়ে রাখেন। সাদা পোশাকের একটি টিমের নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণে অবস্থান ছিল। তারা সার্বক্ষণিক মেজর আরিফের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে খবরা খবর দিচ্ছিল। নজরুল ইসলাম সেদিন তার গাড়ি না এনে সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপনের সাদা রংয়ের গাড়ি ব্যবহার করে আদালত প্রাঙ্গণে আসেন।

দুপুরের দিকে নজরুল ইসলাম অন্তর্বর্তীকালীন জামিন নিয়ে আদালত থেকে বের হওয়ার পরপরই মেজর আরিফের কাছে খবর পৌঁছে দেয় আদালতের আশপাশে অবস্থান নেয়া সাদা পোশাকের র‌্যাব সদস্যরা। নজরুলের সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, সিরাজুল ইসলাম লিটন, তাজুল ইসলাম। গাড়ি ড্রাইভ করেন স্বপনের ব্যক্তিগত গাড়িচালক জাহাঙ্গীর। নজরুলদের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। তিনি কোর্টের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন। নজরুলদের বহনকারী গাড়িটি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা লিংক রোড হয়ে উত্তর দিকে যাওয়ার পথে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের সামনে পৌঁছার পর মেজর আরিফের নেতৃত্বে গাড়ির গতিরোধ করা হয়। নজরুলের গাড়ির পেছনে ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি। পরে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দু’টি গাড়ি থেকে সাতজনকে র‌্যাবের দুটি গাড়িতে তুলে নেয়া হয়।

গাড়িতে তাদের ওঠানোর পর একে একে প্রত্যেকের শরীরে ইনজেকশন পুশ করে অচেতন করা হয়। অচেতন হওয়া সাতজনকে কয়েক ঘণ্টা তাদের গাড়িতেই রাখা হয়। পরে নিয়ে যাওয়া হয় নরসিংদীতে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে পরিকল্পনা মতে কাঁচপুর ব্রিজের পশ্চিম পাড়ে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বালু-পাথর ব্যবসাস্থল জনমানুষশূন্য করার জন্য নূর হোসেনকে ফোন দেন মেজর (অব.) আরিফ হোসেন। গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পর র‌্যাবের গাড়ি ওই স্থানে পৌঁছায়। গাড়ির ভেতরই অচেতন প্রত্যেকের মাথা ও মুখ পলিথিন দিয়ে মোড়ানো ছিল। পরে গলা চেপে একে একে শ্বাস বন্ধ করে মারা হয় সাতজনকে। সাতজনের নিথর দেহ গাড়ি থেকে নামানো হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ শহরের ৫ নম্বর ঘাট থেকে র‌্যাবের নির্দিষ্ট নৌকা নিয়ে যাওয়া হয় কাঁচপুর ব্রিজের নিচে।

লাশগুলো নৌকায় উঠিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর ‘নির্দিষ্ট স্থান’ থেকে লাশ গুমের উপকরণ নৌকায় তোলা হয়। নৌকার মধ্যেই সাতজনের পায়ে ২৪টি করে ইটবোঝাই সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর হাত পেছনে করে রশি দিয়ে বাঁধা হয়। এরপর পলিথিনে মোড়ানো লাশগুলো নদীতে ফেলে দেয়া হয়।

পরে ৩০ এপ্রিল বিকালে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের শান্তিনগর এলাকায় নদীতে কয়েকটি লাশ ভাসতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর এক কিলোমিটারের মতো এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে একে একে ছয়টি লাশ তুলে আনে। আর পরদিন ১ মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

সাত খুন মামলা পরিচালনা করা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নারায়ণগঞ্জ আদালতের তৎকালীন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, ‘গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে মাত্র ৮ মাসেই মামলার আইনি কার্যক্রম শেষ হয়। ১২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। যুক্তি-তর্ক ও আসামীদের জেরাতে রাষ্ট্রপক্ষ তথা আমরা আদালতে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে মামলায় অভিযুক্তরা সবাই সাতজনকে অপহরণ থেকে শুরু করে হত্যা, গুমসহ পুরো কার্যক্রমে জড়িত।’
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারী নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রায় প্রদান করা হয়। নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। বাকি ৯ জনকে সাত থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামীর মধ্যে তিনজন পলাতক। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন।

হাইকোর্টের রায় : হাইকোর্ট নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র‌্যাব-১১’র অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদ-ের আদেশ বহাল রাখে। বাকি ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছে হাইকোর্ট। তাদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। না দিলে আরো দুইবছরের সাজা ভোগ করতে হবে। এছাড়া নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-ের রায় হাইকোর্টেও বহাল রয়েছে। বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।

তৎকালীন সময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, ''ডেথ রেফারেন্স শুনানির পর আদালত এই আদেশ দিয়েছেন। ঘটনার পরে আর্মড ফোর্সেসের লোক, নেভির লোক, এয়ার ফোর্সের লোক ছিল, পুলিশের সদস্যরা ছিল, কিন্তু তারপরেও অতি সংক্ষিপ্ততম সময়ে তাদের বিচার হলো এবং শাস্তি হলো। এতে প্রমাণ হলো, আইনের উর্ধ্বে কেউ না, তা সে যতই শক্তিশালী হোক বা যে বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হোন না কেন।''

আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, র‌্যাব মানুষের নিরাপত্তায় তারা যে কাজ করে তা প্রশংসনীয়। কিন্তু কতিপয় সদস্য যে এই হত্যাকা-ে জড়িত হয়েছে, এর দ্বারা বাহিনীর সার্বিক ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার কারণ নেই।

দ-িতদের মধ্যে ২৫ জনই র‌্যাবের সদস্য যারা সশস্ত্র বাহিনী বা পুলিশ থেকে সংস্থাটিতে প্রেষণে এসেছিলেন, যাদের মধ্যে রয়েছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং মেজর বা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার পদমর্যাদার কর্মকর্তাও। অভিযোগ ওঠার পর তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়। কোন ফৌজদারি অপরাধে র‌্যাবের একসঙ্গে এত সদস্যের সাজা এর আগে আর হয়নি।

 

https://dailysangram.com/post/522937