২৫ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:১৯

রিজার্ভ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ার শঙ্কা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসাবে আগামী জুনের মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন (২৪৪৬ কোটি) ডলার থাকতে হবে। কিন্তু এ মুহূর্তে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন (৩ হাজার ১১৮ কোটি) ডলার এবং ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২ হাজার ৩১৮ কোটি ডলার। সামনে আকু (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন-এসিইউ) পেমেন্ট হলে ১৭ কোটি ডলারের বেশি কমবে। তাই রিজার্ভের হিসাবসংক্রান্ত আইএমএফ-এর দেওয়া শর্ত পূরণ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে সরকার। এমন অবস্থায় আজ ঢাকায় সাত দিনের সফরে আসছে আন্তর্জাতিক এই দাতা সংস্থার একটি প্রতিনিধিদল। রিজার্ভ ছাড়াও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের শর্ত হিসাবে আর্থিক, রাজস্ব ও প্রশাসনিক খাতের সংস্কারের ঘোষণা কতটা থাকছে, সেটিও জানতে চাওয়া হবে। ২ মে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে আইএমএফ-এর প্রতিনিধিদলটি অর্থ বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, এনবিআর ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সূত্র জানায়, সফরকালে অর্থনীতিতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রভাব এবং ব্যবস্থাপনা পদক্ষেপের ফলে সরকারের জ্বালানি আমদানি কতটা কমেছে, তা পর্যালোচনা করবে দলটি। যদিও সামগ্রিক ভর্তুকি আইএমএফ নির্ধারিত সীমায় আটকে রাখতে সরকার ইতোমধ্যে সারের দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্য সেপ্টেম্বর থেকেই তিন মাস পর পর আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে নিট ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনবে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এছাড়া জুনের আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়াটি বিল আকারে জাতীয় সংসদে উত্থাপনের শর্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে খসড়াটি মন্ত্রিসভা চ‚ড়ান্ত অনুমোদন করেছে। আসছে বাজেট অধিবেশনে এটি বিল আকারে উত্থাপন করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হবে।

সূত্র আরও জানায়, ঋণের শর্তের অগ্রগতি যাচাই করতেই আইএমএফ প্রতিনিধিদল ঢাকা সফরে আসছে। সংস্থার কাছ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন (৪৭০ কোটি) ডলারের ঋণের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এখন তাদের বেঁধে দেওয়া সময়ে সংস্কার প্রতিশ্র“তির বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানতে চাওয়া হবে। পাশাপাশি নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার জন্য কতটুকু সংস্কার করতে হবে, তা নিয়েও আলোচনা হবে।

এই সফরের পর সেপ্টেম্বরে আরও একদফা পর্যবেক্ষণে আইএমএফ প্রতিনিধিদল আসবে। ওই সময়ে সর্বশেষ শর্তগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতির ওপর রিপোর্ট করা এবং এর ওপর ভিত্তি করে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হবে। আইএমএফ ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাত কিস্তিতে ঋণ বিতরণ করবে। ৩০ জানুয়ারি ৪৭৬.২ মিলিয়ন ডলারের প্রথম কিস্তি ছাড় করা হয়েছে।

এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কারের অগ্রগতির জবাব প্রস্তুত করা হয়েছে। ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের সার্বিক অগ্রগতিতে আইএমএফ টিম সন্তোষ হবে বলে আশা করছেন। তার মতে, ব্যাংক
ঋণের সুদহারে করিডর গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সেটি বলেছেনও। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নিয়ে কাজ করছে। এ করিডর গ্রহণ করা হলে বর্তমান সুদহারের ওপর আরোপিত ক্যাপ উঠে যাবে। ফলে সুদহার বর্তমানের তুলনায় বাড়বে। এছাড়া বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রতিষ্ঠা করা হবে। আর এসব কার্যকরের সম্ভাবনা রয়েছে জুলাই থেকে।

জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সোমবার যুগান্তরকে জানান, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অঙ্ক আগামী জুনের মধ্যে ২৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু এখনো ওই পর্যায়ে তা পৌঁছেনি। জুনের এখনো দুমাস বাকি আছে। ওই সময়ে রিজার্ভ পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম। আর শর্তপূরণে ব্যর্থ হলে সংস্থাটির স্টপ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম থেকে একটি ছাড়পত্র প্রয়োজন হবে। নরমালি ওয়েভার চাইতে গেলে ঋণের সুদহারের ক্যাপ তুলে দেওয়া, মুদ্রা বিনিয়ম হার বাজারভিত্তিক করার অঙ্গীকার চাইতে পারে সংস্থাটি। তিনি আরও বলেন, আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী আগামী অর্থবছরে জিডিপির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। তার মতে, ঋণের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। সেগুলো কীভাবে মিট করবে, এখন দেখার বিষয়। তিনি বলেন, ঋণের সুদহারে করিডর কার্যকর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। করিডর সিস্টেম কবে থেকে কার্যকর, রিজার্ভের ঘাটতির হিসাবটি সমন্বয় এবং রাজস্ব আদায়ে প্রশাসনে সংস্কার কীভাবে হবে, সেসব বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশ্র“তি দেওয়া হয় আশা করছি।

এদিকে আগামী বাজেটে আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত পূরণে আর্থিক, রাজস্ব ও প্রশাসনিক খাত সংস্কারের কতটা ঘোষণা থাকছে, এটি দেখার জন্য আইএমএফ প্রতিনিধিদল ঢাকা আসছে বলে জানিয়েছেন আইএমএফ-এর সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঋণের শর্ত এখন ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন শুরু হচ্ছে। রাজস্ব আদায়ের একটি লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চয় ঠিক করা হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা ও সরকারের প্রস্তুতির অভাবের কারণে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে না। তিনি আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সরকারের উচিত হবে। বর্তমান লক্ষ্যমাত্রার নিচে আছে রিজার্ভ। এটি বাড়াতে হবে। রিজার্ভের ব্যবস্থাপনা বাজারভিত্তিক হবে কি না, এটি দেখার বিষয়। কারণ, সরকার বাজারভিত্তিক ব্যবস্থা বিশ্বাস করে না। এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব এবং বাজেটে শর্তের সংস্কার কতটা ঘোষণা থাকছে এই সফরে, তা মূল্যায়ন করবে আইএমএফ।

অর্থ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, সফরকালীন আইএমএফ প্রতিনিধিদলের কাছে জুনের মধ্যে রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত এবং কর-জিডিপি অনুপাত শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হবে। অর্থ বিভাগ মনে করছে, দাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এডিপি, জাইকা ও কোরিয়ার কাছে বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে দেড় থেকে দুইশ কোটি মার্কিন ডলার পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, যা রিজার্ভের নিট হিসাব বাস্তবায়নে সহায়তা হিসাবে যোগ হবে।
এদিকে আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এবং শুল্ক খাতে চলমান প্রবৃদ্ধিসহ অতিরিক্ত ১৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে হবে। এই বাড়তি আদায়ের ক্ষেত্রে এরই মধ্যে এনবিআর একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। সেখানে বলা হয়, অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের জন্য আগামী বাজেটে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতে কর অব্যাহতি কমিয়ে আনা হবে। কর হার বাড়ানো, কর জাল সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক করদাতাদের অডিট কার্যক্রম শক্তিশালী করতে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস) চালু, কর অঞ্চল সম্প্রসারণ, কর আদায়ের খরচ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

পাশাপাশি ভ্যাট অডিট জোরদারকরণ, ভ্যাট ফাঁকি রোধে ভ্যাট গোয়েন্দার কার্যক্রম গতিশীল করা, আয়কর অনুবিভাগের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে ভ্যাট আদায় বাড়ানো হবে। বিলাসী পণ্যের ক্ষেত্রে অব্যাহতি সুবিধা উঠিয়ে দেওয়া, মোবাইল ফোন বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট আরোপসহ ভ্যাট হারও পুনর্বিন্যাস করা হবে। আর এই কৌশলপত্র তুলে ধরা হবে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলটির কাছে।

আইএমএফ-এর ঋণ চুক্তিতে প্রায় ৩৮টি শর্ত রয়েছে। এর মধ্যে আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে, সেগুলোর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি যাচাই করবে সংস্থাটি। এছাড়া ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে যেসব শর্ত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে সরকার, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আগামী বাজেটে কী কী উদ্যোগ থাকছে, তা-ও পর্যালোচনা করবে সংস্থাটি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/668154