২৫ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:১৬

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ভয়ঙ্কর কিশোর গ্যাং

‘বড় ভাই সালাম দিছে, সামনে পার্টি.. কিংবা কাকা সালামি কই?’ ঈদ, নববর্ষ, থার্টিফাস্ট নাইটের নামে এভাবেই নিরবে চাঁদাবাজি করছে উঠতি বয়সী ছেলেরা। রাজধানীর পাড়ায় পাড়ায় রয়েছে এ রকম গ্যাং। ‘গ্যাং কালচারের’ নামে রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় উঠতি বয়সীদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। শুরুতে আড্ডা, পার্টি বা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধে যুক্ত থাকলেও এখন তা বিস্তৃত হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে। আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে জবরদখল ও মাদকবাণিজ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বখাটে কিশোরদের। সম্প্রতি ঈদ উপলক্ষেও ‘সালামি’র নামে নিরবে চাঁদাবাজি করেছে এসব গ্যাং। এ রকম শতাধিক গ্যাংয়ের তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। এসব গ্যাংয়ের সদস্য অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০। অন্যদিকে কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করে ফায়দা নিচ্ছেন স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণকারী এমন অর্ধশত ব্যক্তির নামও রয়েছে গোয়েন্দাদের হাতে।

২০১০ সাল থেকে রাজধানীতে কিশোর অপরাধের কারণে মামলা হয়েছে প্রায় অর্ধশত। যার মধ্যে মাত্র একটি মামলার বিচার কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। সম্প্রতি মিরপুরের বাউনিয়াবাদ এলাকায় শাহীন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে কিশোর গ্যাং আশিক বাহিনীর সদস্যরা। পরে টাকা না পেয়ে প্রকাশ্যে তাকে চাপাতি ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে গ্যাং সদস্যরা। গ্যাংয়ের ১০-১২ জন সদস্য মিলে ধারালো ছুরি দিয়ে তাকে উপর্যুপরি আঘাত করে। এ ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পরে মামলা হলে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে পুলিশ। জানা গেছে, স্থানীয় নেতা ও বড় ভাইদের ছত্রছায়ায় এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায় এই আশিক বাহিনী। মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজেও ব্যবহার করা হয় তাদের।

গ্যাং কালচারের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে রাজধানীতে প্রথমবারের মতো প্রাণ হারায় উত্তরা ট্রাস্ট কলেজের ছাত্র আদনান। সম্প্রতি র‌্যাবের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়া নাফিজের গড়ে তোলা কিশোর গ্যাং গ্রুপের হাতেই খুন হয়েছিল আদনান। সেই মামলার এজাহারভুক্ত ৯ নম্বর আর চার্জশিটের দুই নম্বর আসামি নাফিজ। সম্প্রতি নিজ বাসা থেকে মাদকসহ গ্রেফতার হন নাফিজ। এ ছাড়া ঢাকার প্রবেশদ্বার টঙ্গী এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইবাজদের নিয়ন্ত্রণ করে রাসেল মিয়া, সুমন মোল্লাহ, মিন্টু, ইউসুফ, কাইয়ুম, পল্লান। সোহেল রানার ছত্রছায়ায় টঙ্গী-গাজীপুরে এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। মাঝেমধ্যে এ গ্রুপের সদস্যরা আটক হলেও তদবিরে তাদের তাৎক্ষণিক ছাড়িয়ে আনেন সোহেল রানা।

টঙ্গী থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক পরিচয়ে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করেন বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, তুরাগপাড়কে ঘিরে গড়ে উঠা টঙ্গী শহরকে মাদকের আখড়ায় পরিণত করেছে এই কিশোর গ্যাং। শুধু মাদক নয় হত্যা, চাঁদাবাজি ও ছিনতাই মামলার একাধিক আসামি রয়েছে সোহেল রানার গ্রুপে। নিজেরা কিশোর না হলেও কিশোরদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে নানা অপকর্ম করায় এ বাহিনী। সোহেল রানার আশির্বাদপুষ্ট এ কিশোর গ্যাং ও মাদক সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসছে নির্যাতন। এমনকি তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি সাংবাদিকও। সম্প্রতি স্থানীয় এক সাংবাদিক কিশোরদের দিয়ে মাদক ব্যবসা চালানোর প্রতিবাদ করলে তাকেও দেয়া হয় হত্যার হুমকি। এ বিষয়ে থানা ও পুলিশ সদর দফতরে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।

জানা গেছে, সোহেল রানার বাহিনীতে টঙ্গীর চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী, ছিনতাইকারী এমনকি হত্যা মামলার আসামিও রয়েছে। সম্প্রতি সোহেল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদরদফতরে লিখিত অভিযোগ করেছেন মো: রিয়াল নামের এক ফিশারি। অভিযোগে বলা হয়, গেল বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর দখলের উদ্দেশ্যে সোহেল রানার নির্দেশে প্রায় ৫০ জন সন্ত্রাসী তার মৎস্য খামারের ভেতরে থাকা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার মাছের খাবারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় পাশে থাকা এক নারীর মুদি দোকানেও তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। এ বিষয়ে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতা না পেয়ে পুলিশ সদর দফতরে অভিযোগ করা হয়। এ ছাড়া সোহেল রানা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এমন অভিযোগ করে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। এমনকি টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট ও ডাইং ফ্যাক্টরি গড়ে তুলেছেন।

টঙ্গীর দত্তপাড়া ব্র্যাক টাউন এলাকায় কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম নুরুর পৈতৃক সম্পত্তি জোরপূর্বক দখলের চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এ ব্যাপারে গাসিকের ৪৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম নুরু বলেন, গত ৩০ ফেব্রুয়ারি সোহেল রানা তার লোকজন নিয়ে তার জমিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ শুরু করে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের কাজ বন্ধ করেছে। এ বিষয়ে সোহেল রানার সাথে কয়েক দিন যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/743316