২২ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১১:০৩

ইন্টারনেটের দাম কমানো নিয়ে পাল্টাপাল্টি

দীর্ঘ প্রায় দুই বছরে ইন্টারনেটের দাম কমেনি। বরং তা নিয়ে চলছে পাল্টপাল্টি বক্তব্য। ২০১৫ সালে  সরকার সর্বশেষ ব্যান্ডউইথের দাম কমায়। আরও দাম কমানোর ফলে আশার আলো দেখেন ইন্টারনেট গ্রাহকরা। তাদের ধারণা ছিল ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর ফলে গ্রাহক পর্যায়ে কমবে ইন্টারনেটের দাম। ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর ২০ মাস অতিবাহিত হলেও কমেনি গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এ নিয়ে নানা বক্তব্য দিলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। দাম কমিয়ে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) আশা প্রকাশ করে বলেছিল গ্রাহক পর্যায়ে এর সুফল পৌঁছাবে। এজন্য তারা বিটিআরসির ওপর দায়িত্ব বর্তান। বিএসসিসিএলের যুক্তি, পাইকারি হিসেবে আমরা ব্যান্ডউইথের দাম কমিয়েছি। এখন গ্রাহকরা এর সুবিধা পাবেন কি-না সে বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে নিশ্চিত করবে বিটিআরসি। পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, বিএসসিসিএল দাম কমানোর মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। তারা দাম কমিয়েছে শর্ত জুড়ে দিয়ে। প্রথম শর্ত যারা ন্যূনতম ১০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ কিনবে কেবল তারাই ৬২৫ টাকায় ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ পাবে। দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, নতুন এ মূল্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জন্য প্রযোজ্য হবে। বিটিআরসি জানিয়েছে, মোবাইল অপারেটর ছাড়া আর কেউই এ পরিমাণ ব্যান্ডউইথ কেনার সামর্থ্য রাখে না। এছাড়া তিন জেলার বাইরেও কিন্তু ইন্টারনেটের অনেক গ্রাহক রয়েছে। মূলত এ দুটি কারণে গ্রাহক পর্যায়ে ব্যান্ডউইথের দাম কমানোর প্রভাব ইতিবাচক হচ্ছে না। এদিকে বিতর্ক ছাপিয়ে এখন ইন্টরনেটের দাম নিয়ে শুরু হয়েছে পাল্টাপাল্টি। সম্প্রতি বিষয়টি তুলে ধরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সাংবাদিকদের বলেন, মধ্যস্বত্ব নিয়ে একটা ব্লেইম গেইম হয়। যারা স্বত্বভোগী আছেন তাদের নিয়ে যখনই আমরা মিটিং করি তারা বলেন আমি তো কমেই দিয়েছি কিন্তু আমার তো অন্যদের খরচ দিতে ব্যয় বাড়ছে। কেউ বলেন- এনটিটিএনদের দোষ, এনটিটিএনরা বলেন আইআইজিদের দোষ আবার বলেন এমএনওদের দোষ। তিনি জানান, আমরা এটা বুঝতে চাই না। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে সরকার যখন এতটা দাম কমিয়েছে, এখন অ্যান্ড ইউজার লেভেলে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে চাই। বিষয়টি আমরা খুব সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছি। আমি সবাইকে বারবার বলেছি, অপারেটরদেরও বলেছি-এটি রাজনৈতিক সরকার, আমাদের জনগণের সেবা করতে হবে, ইন্টারনেটের দাম কমান। সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৮ বছরে ব্যান্ডউইথের দাম ৮ বার কমানো হয়। ২০০৮ সালে যেখানে ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ২৭ হাজার টাকা সেখানে বর্তমানে দাম ধরা হয়েছে ৬২৫ টাকা। বিএসসিসিএলের ব্যান্ডউইথের সর্বশেষ দাম ধরা হয় ৫০ থেকে ৯৯৯ মেগা ৯০০ টাকা, ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৪৯৯ মেগা ৮২৫ টাকা, ২ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার ৯৯৯ মেগা ৭৫৫ টাকা, ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার ৯৯৯ মেগা ৬৮০ টাকা এবং ১০ গিগার চেয়ে বেশি প্রতি মেগার দাম পড়বে ৬১৮ টাকা। আর ১০ গিগার জন্য বিএসসিসিএলকে প্রতি মাসে দিতে হবে ৭২ লাখ টাকা। ইন্টারনেটের দাম কমানো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা সমালোচনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকার তার ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসে এ নিয়ে একটি হিসাব তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয় ৪০০ জিবি। প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহৃত হয় ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার জিবি। প্রতি জিবি গড়ে ২০০ টাকা হিসেবে প্রতিদিন ব্যবহৃত ইন্টারনেটের দাম ৬৯১ দশমিক ২ কোটি টাকা। সরকারের কাছে প্রতি জিবি ২৬ পয়সা হিসেবে প্রতিদিন ব্যবহৃত ইন্টারনেটের ক্রয়মূল্য ৮৯ দশমিক ৮৬ লাখ টাকা। তার মানে দাঁড়ালো প্রতিদিন ৮৯ দশমিক ৮৬ লাখ টাকায় কেনা ইন্টারনেট জনগণের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ৬৯১ দশমিক ২ কোটি টাকায়। প্রতিদিন ইন্টারনেট খাত থেকে মুনাফা হয় ৬৯০ দশমিক ৩ কোটি টাকা। প্রতি বছর ইন্টারনেট খাত থেকে মুনাফা ২ লাখ ৫১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। অপারেটরদের কাছ থেকে প্রতি বছর ইন্টারনেটের দাম হিসেবে সরকার পায় ৩২৮ কোটি টাকা মাত্র (প্রায়)। তিনি আরো বলেন, ২০১৬-২০১৭ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, শুধুমাত্র ইন্টারনেট খাতের এই টাকা যোগ হলেও জাতীয় বাজেট দাঁড়াতো ৬ লাখ কোটি টাকা, প্রায় দুই গুণ। অথচ এই আড়াই লাখ কোটি টাকার পুরোটাই নিয়ে গেছে বিদেশি বেনিয়ারা। এ তথ্য সম্পর্কে মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, হিসাবটি একেবারে নির্ভুল নয়। কাছাকাছি। এদিকে দেশে মোবাইল ফোন ভিত্তিক ইন্টারনেটের দাম কত হওয়া উচিত, সেটি নির্ধারণে ‘কস্ট মডেলিং’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। এ জন্য জাতিসংঘের অধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) একজন কর্মকর্তাকে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। এই পরামর্শক খাত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ইন্টারনেটের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণে বিটিআরসিকে পরামর্শ দেবেন। অন্যদিকে মঙ্গলবার ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব দিয়েছে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব)। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্মেলন কক্ষে আসন্ন ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় অ্যামটব তাদের প্রস্তাব তুলে ধরে। সংগঠনের মহাসচিব টিআইএম নুরুল কবির বলেন,  দেশের ৯৫ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তাই সবার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার সহজ, ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইন্টারনেট সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া দরকার বলে অ্যামটব মনে করে। তিনি বলেন, মোবাইল এখন আর শুধু কথা বলার জন্য ব্যবহার হয় না। এটি এখন ডিজিটাল সার্ভিস। কম্পিউটারের ওপর ভ্যাট/ট্যাক্স প্রত্যাহারের পর এর চাহিদা অনেক বেড়েছে। মোবাইলের ওপরও ভ্যাট/ট্যাক্স প্রত্যাহার করলে সবার জন্য সুবিধা হবে। মোবাইলের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের রাজস্বও বাড়বে। বিটিআরসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৭২ লাখ। এর মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৩১ লাখ, যা মোট ব্যবহারকারীর ৯৪ শতাংশ।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=62496