২৫ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:১৪

জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি স্বজনদের এখনো ক্ষতিপূরণ পাননি শ্রমিকেরা

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজার গার্মেন্টস কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে বিকট শব্দে ধসে পড়ে পুরো ভবন। সৃষ্টি হয় এক নির্মম ইতিহাস। এক দশক আগে রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১৩৬ জন পোশাককর্মীর মৃত্যু হয়। দশ বছর পার হলেও এ ঘটনায় করা দুই মামলার বিচারে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। কবে নাগাদ বিচার শেষ হবে নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও দ্রুত শেষ করার প্রত্যাশা জানান রাষ্ট্রপক্ষ। এখনও সেদিনের স্মৃতি বহন করছেন অনেকেই। সেদিনের ঘটনার পর অনেকের জীবন কাটছে জীবন্ত লাশ হয়ে। সেদিনের ক্ষত এখনও দগদগে তাদের হৃদয়ে।

এ হত্যা মামলার বিচার শুরুর সাড়ে পাঁচ বছর পর প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। এ পর্যন্ত মামলার ৫৯৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৪৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটির বিচারিক কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। যে কারণে বিচার শুরুর সাত বছর পার হলেও এ মামলায় কোনো সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। এ দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা কারাগারে থাকলেও অধিকাংশ আসামী জামিনে এবং পলাতক রয়েছেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। এর নিচে চাপা পড়েন সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাক শ্রমিক। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে।

মামলার ৪১ আসামীর মধ্যে ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। তিনজনকে বাদ দিয়ে হত্যা মামলায় এখন আসামীর সংখ্যা ৩৮ জন। এদের মধ্যে দশজন পলাতক এবং অন্যরা জামিনে রয়েছে। ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বিচার শুরুর সাড়ে ৫ বছর পর এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এ পর্যন্ত ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৪৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ আদালতে পাঁচজন সাক্ষ্য দেন। আগামী ১৫ মে পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় আরেকটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ১৩৫ জনকে। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটি হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেন। সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। এতে বিচার শুরু হলেও একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল বেনাপোল থেকে রানাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পর থেকে রানা কারাগারে আটক রয়েছে। ২০২২ সালে হাইকোর্টে জামিন চেয়ে আবেদন করেন সোহেল রানা। আবেদনের শুনানি নিয়ে আদালত রুল দেন। রুলের শুনানি শেষে গত ৬ এপ্রিল জামিন মঞ্জুর বলে রায় দেন হাইকোর্ট। এই জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করেন। পরবর্তীতে ৯ এপ্রিল হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। একই সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনটি আগামী ৮ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বিমল সমাদ্দার বলেন, বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে ৪৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। অন্য সাক্ষীদের আদালতে হাজিরের মাধ্যমে সাক্ষ্য গ্রহণ অব্যাহত রেখেছি। যেসব সাক্ষী অসচ্ছল তাদের যাতায়াতের খরচ বাবদ খুব সামান্য অর্থও দেওয়া হচ্ছে। অন্য সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে দ্রুত বিচার কাজ শেষ করা হবে। তবে কবে নাগাদ শেষ বলে সেটা বলা সম্ভব না।

জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি: সাভারে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের স্মরণ করেছেন স্বজন ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। গত রোববার সন্ধ্যায় রানা প্লাজার সামনে অবস্থিত অস্থায়ী বেদিতে এই মোমবাতি প্রজ্জ্বলন কর্মসূচি পালিত হয়। এসময় নিহতদের স্মরণে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শ্রমিকদের পরিবার ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি রানা প্লাজা ট্রাজেডির সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়। এসময় আহত শ্রমিকরা ৪ দফা দাবি জানান। দাবিগুলো হলো-রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের এক জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা করা, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার জন্য দায়ী সবার বিচারের ব্যবস্থা করা, দেশের শ্রম আইন সংস্কার করে শ্রমিক বান্ধব আইন গড়ে তোলা এবং দেশের সব শিল্প খাতে আহত শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা ও সরকারি ভাতার ব্যবস্থা করা।

ক্ষতিপূরণ পাননি শ্রমিকেরা: গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ১০ বছর আগে এদিন ওই ভবন ধসে ৫টি তৈরি পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৮ জন শ্রমিক মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সহস্রাধিক শ্রমিক গুরুতর আহত হন; যাদের অধিকাংশই কর্মক্ষমতা হারিয়ে পঙ্গু জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের এক জীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ ৪৮ লাখ টাকা দাবি করা হয়েছিল। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণের দাবি জানানো হয়েছিল। ভবনমালিক সোহেল রানার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানানো হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা যারা ভবনমালিক সোহেল রানার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় উৎকোচ গ্রহণ করে ভবন নির্মাণে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং কারখানাগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো এই ১০ বছরেও শ্রমিক পক্ষ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষ থেকে পুনঃপুন এই দাবিগুলো উত্থাপনের পরও মেনে নেওয়া হয়নি। শ্রমিকদের পরিবার ও আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য আবারও মালিকপক্ষের প্রতি দাবি জানাচ্ছি।

https://dailysangram.com/post/522855