২৫ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:১৩

ই-বর্জ্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে

বর্তমান ডিজিটাল যুগে দেশে বৈদ্যুতিক ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার অত্যন্ত উদ্বেগজনকহারে দ্রুত বাড়ছে। কিন্তু ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর এগুলো যে পরিমাণ বর্জ্য পদার্থ তৈরি করছে এবং এসব বর্জ্যেরও যে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে ধারণা ও সচেতনতা অত্যন্ত সীমিত। অত্যধিক জনঘনত্বের এই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য একটা বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠছে, যা একদিকে যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে তা তেমনি পরিবেশ সুরক্ষার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে এবং ই-বর্জ্য সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই পরিকল্পনা গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সম্প্রতি ই-বর্জ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে তারা ই-বর্জ্য থেকে কার্যকর ও বাধ্যতামূলকভাবে শিশুদের রক্ষা করতে আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, ই-বর্জ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদের রক্ষা করতে হলে কার্যকর ও বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।

ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য বলতে পরিত্যক্ত বৈদ্যুতিক বা ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম বা পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতি বোঝায়। এগুলি মূলত ভোক্তার বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি, যেমন- ফ্রিজ, ক্যামেরা, মাইক্রোওয়েভ, কাপড় ধোয়ার ও শুকানোর যন্ত্র, টেলিভিশন, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ল্যাবটব ইত্যাদি। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যের নিয়মনীতিহীন ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণ থেকে মানবস্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এবং পরিবেশ দূষণ হতে পারে। এসব যন্ত্রপাতিতে মানবস্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অনেক ক্ষতিকর উপাদান থাকে। সিসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম, লিড অক্সাইড প্রভৃতি ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান মানুষের স্নায়ুতন্ত্র, যকৃৎ, বৃক্ক, হৃদ্যন্ত্র, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, ত্বক ইত্যাদির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব ই-বর্জ্যের মধ্যে সিসা, সিলিকন, টিন, ক্যাডমিয়াম, পারদ, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি রাসায়নিক থাকে এবং এসব রাসায়নিক দেশের মাটি ও পানিকে দূষিত করছে। মাটির গুণগত মান বিনষ্ট করছে, শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। নানাভাবে তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগের ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের ঝুঁকি বেশি। ই-বর্জ্যের সিসা নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। শিশু বড় হলে ফুসফুস, শ্বাসতন্ত্র, থাইরয়েড জটিলতা, ক্যানসার এবং হৃদরোগের মতো বড় রোগের জটিলতাও পড়ে। তাই ই-বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে বছরে কী পরিমাণে ই-বর্জ্য পুনর্ব্যবহার, ধ্বংস ও পরিবেশে মিশে যায়, তা নিয়ে সরকারি সুনির্দিষ্ট কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৮ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল এবং এতে বলা হয়, ওই বছর দেশে ৪ লাখ টন বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনিকস) বর্জ্য জমা হয়। এর মধ্যে কেবল ৩ শতাংশ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা রিসাইক্লিংশিল্পে ব্যবহার করা হয়। বাকি ৯৭ শতাংশের ঠাঁই হয় ভাগাড়ে। এতে আরও বলা হয়, দেশে প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে এবং ২০৩৫ সাল নাগাদ এই ই-বর্জ্য বছরে ৪৬ লাখ টনে দাঁড়াবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৬ সালে ১ লাখ ৪২ হাজার মেট্রিক টন ই-বর্জ্য বের হয়েছে। ২০২১ সালের ১ হাজার ১৬৯.৯৮ টন মোবাইল ই-বর্জ্য বের হবে।

ই-বর্জ্যের এই স্বাস্থ্যঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে তিন দশক আগে যখন কম্পিউটার, ইলেক্ট্রনিকস পণ্য ও মোবাইল ফোনের উন্নতি ও বিস্তার শুরু হয়। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি ১০ জুন ২০২১ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর অধীনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের একটি বিধিমালাটির গেজেট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে ই-বর্জ্যের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এখানে মানুষ কিছুদিন পরপরই টেলিভিশন, স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম বদলায়। সরকারি কোনো উদ্যোগ না থাকায় পুরোনো বেশির ভাগ সরঞ্জাম পুনর্ব্যবহার হয় না। উল্টো তা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যে নানাভাবে ক্ষতি করে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধিমালাটিতে ই-বর্জ্যের ঝুঁকি কমাতে কী করা উচিত, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কাজের বণ্টন, ক্ষতিপূরণ চাওয়ার অভিভাবক কারা, আমদানি করা বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিক পণ্যের পরীক্ষা, পরীক্ষাগার-সংক্রান্ত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কী করা উচিত, তা উল্লেখ নেই। এ ছাড়া ই-বর্জ্য পরিবহন, ধ্বংসে নিযুক্তদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়গুলো নীতিমালার বাইরে রয়ে গেছে।

ই-বর্জ্য শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বেই বড় উদ্বেগের কারণ এগুলো একদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ করছে। ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক জোট গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট স্ট্যাটিসটিকস পার্টনারশিপের (জিইএসপি) এক হিসাব বলছে, বিশ্বে প্রতি পাঁচ বছরে ই-বর্জ্য ২১ শতাংশ হারে বাড়ে। ২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে ৫ হাজার ৩৬০ কোটি কেজি ই-বর্জ্য জমা হয়। সে বছর মোট উৎপাদিত ই-বর্জ্যের শুধু ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয়েছে। ই-বর্জ্য বেশি জমা হচ্ছে নিম্ন আয় ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। ২০১৪ সালে জাপানে অবস্থিত জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে বলা হয় বিশ্বে প্রতিবছর ৪ কোটি টনেরও বেশি ইলেকট্রনিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গণচীন – কেবলমাত্র এই দুইটি দেশই সারা বিশ্বের ই-বর্জ্যের এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন করে। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়টি এশিয়ার ই-বর্জ্য নিয়ে অন্য একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে দেখা গেছে, ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে এশিয়ায় ই-বর্জ্যের পরিমাণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে প্রায় ৬৩ শতাংশ। ১২টি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়ে তারা বলছে, এই পাঁচ বছরে ই-বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন। এদের মধ্যে চীনের অবস্থা ভয়াবহ। এ সময় তাদের দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ই-বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ লাখ ৮১ হাজার টন। যা পুরো এশিয়ার জন্য উদ্বেগের বলে বলা হচ্ছে। যদিও এসব ই-বর্জ্যে অনেক অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু ও অন্যান্য উপাদান মিশে আছে, যেগুলি পুনঃচক্রায়ন করা সম্ভব। লোহা, তামা, সোনা, রূপা, অ্যালুমিনিয়াম, প্যালাডিয়াম ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য অন্যান্য উপাদানগুলির মোট মূল্য ৫২০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন এর পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যবস্থাপনা ও নীতিমালা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে ১ কোটি ২৯ লাখ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতে নিয়োজিত। এ সমস্ত নারী ও তাদের অনাগত সন্তানদের বিষাক্ত ই-বর্জ্য দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরের একটা বড় অংশের বয়স পাঁচ বছরের নিচে, যারা সক্রিয়ভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত আছে। সংস্থাটি আরও বলছে, অভিভাবকেরা প্রায়ই শিশুদের ই-বর্জ্য খেলতে দেন ও পুনর্ব্যবহার কাজে লাগান। ঘরের মধ্যে শিশুরা এগুলো খেলনা হিসেবে ব্যবহার করে। ই-বর্জ্যের বিষাক্ত রাসায়নিক, বিশেষ করে মার্কারি এবং সিসা উচ্চমাত্রায় থাকে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ খুব সহজেই শিশুর শরীরে প্রবেশ করে এবং এতে শিশুদের বুদ্ধি বিকাশের ক্ষমতা হ্রাস পায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, যন্ত্র ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি শেখা। এতে মোবাইল, ল্যাপটপ ও ট্যাব বেশি দিন ধরে ব্যবহার করা যাবে। গুরুত্ব দিতে হবে পুরোনো সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানোর ওপরে। একই যন্ত্র একাধিক কাজ করবে, এমন মাল্টিপারপাস ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। একই চার্জারে সব সংস্থার সব মডেলের মোবাইল চার্জ করা যায়, এমন চার্জারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ইউনিফর্মের ব্যবহার, নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কিছুটা সুফল মিলবে। তাছাড়া, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ই-বর্জ্য একটা বড় ধরনের সমস্যা ও হুমকি হয়ে উঠছে, যা সমাধানের লক্ষ্যে এখন থেকেই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ই-বর্জ্যেরে কারণে ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং এটা বিশ্বব্যাপীই ঘটছে। এর জন্যও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন ই-বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ নিরূপণের ব্যবস্থা; তারপর এগুলোর জন্য স্থায়ী ভাগাড় ও রিসাইক্লিং কারখানা স্থাপন করা। জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগও নিতে হবে। এ বিষয়ে ভারত, চীনসহ অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগাতে হবে। ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি উৎপাদন, আমদানি, বিপণন, ব্যবহার এবং ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত নীতিমালা ও আইন-বিধান মেনে চলার ব্যবস্থা ও তদারকি করা। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে প্রায় ১৩ কোটি মানুষের হাতে মুঠোফোন; অন্যান্য ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও বাড়ছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। এগুলোর প্রায় ৩০ শতাংশই প্রতিবছর ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। সুতরাং এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমাদের কালক্ষেপণের সুযোগ নেই।তবে আশার কথা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সচেষ্ট হচ্ছে। বিভিন্ন বিক্রয়কারী সংস্থাও ব্যবহৃত পুরনো সামগ্রী সংগ্রহ করে তা রিসাইক্লিং-এর ব্যবস্থা করছে। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং রক্ষা করতে হবে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও পরিবেশ দূষণ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, পৃথিবীর সকল দেশের নীতি, আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় জনস্বার্থে। কিন্তু, বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নে দুর্নীতির মাধ্যমে জনস্বার্থ উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার সাম্প্রতিক একটি ঘৃণ্য উদাহরণ হচ্ছে সমন্বিত নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন না করে একটি অগ্রহণযোগ্য বায়ু দূষণ বিধিমালা প্রণয়ন। এই ঘনবসতির বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ দিনে দিনে এখন মানবিক বিপর্যয় তৈরি করছে। তাই পরিবেশ রক্ষার সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন আজ অপরিহার্য।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, দূষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় দ্বৈত নীতির মধ্যমে দূষণের মানমাত্রা বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে আমাদের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশের আইন মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে, ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের গোষ্ঠী স্বার্থকে রক্ষা করছে যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়ে বাংলাদেশে দূষণের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। আমাদের সামগ্রিক জনসাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ করতে আইনসমূহের কার্যকর সংশোধন অতি জরুরি।
সূত্র ই-বজ্য পরিবেশের একটি নতুন ইস্যু। মূলত অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বাসাবাড়িতে ব্যবহারের পর বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক ও ইলেক্ট্রনিক্স দ্রব্য যখন অচল বা সচল অবস্থায় ফেলে দেয়া হয়, তখনই তা ই-বর্জ্যে পরিণত হয়। কখনো কখনো তা পুনঃব্যবহার উপযোগী করা হলেও অধিকাংশ সময়ে তা স্থায়ীভাবে বর্জ্যে পরিণত হয়। পুরনো ডিভাইসগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের মত টেকসই ও মেরামত খরচ লাভজনক না হওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বাজারজাতকরণ কৌশল ই-বর্জ্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। পরিত্যক্ত ডিভাইসগুলি যত্রতত্র নিক্ষেপ এবং নিয়মকানুনহীন সংগ্রহ ও পুনঃচক্রায়ন কৌশলের কারণে দিন দিন তা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের প্রতি হুমকি হয়ে উঠছে। ই-বর্জ্যের কারণে ঘটছে জলবায়ুর পরিবর্তন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ইফফাত আরা শামসাদ বলেন, ই-বর্জ্যের কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম নেওয়া, শিশুর ওজন কম হওয়া, এমনকি মৃত শিশুর জন্ম দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। ই-বর্জ্যের সিসা নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। শিশু বড় হলে ফুসফুস, শ্বাসতন্ত্র, থাইরয়েড জটিলতা, ক্যানসার এবং হৃদরোগের মতো বড় রোগের জটিলতাও পড়ে।

বাংলাদেশে ই-বর্জ্য নিয়ে গবেষণা করেছে বুয়েটের সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (সিইআরএম)। গবেষকদলের প্রধান সিইআরএমের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. রওশন মমতাজ বলেন, ই-বর্জ্য নতুন ধারণা হওয়ায় এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষের ধারণা নেই। পুরনো ইলেক্ট্রনিক পণ্য ফেরত দিলে যদি প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে ঝুঁকি কিছুটা কমবে। পাশাপাশি এখন অনেক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। সরকার যদি উদ্যোক্তাদের উদ্বুদ্ধ করে সেখানে ই-বর্জ্য সেপারেশন ও রিসোর্স রিকভারি পদ্ধতিগতভাবে করার ব্যবস্থা করে বা প্রণোদনা দেয়, তাহলে রিসাইক্লিং একটি শিল্প হিসেবে দাঁড়াতে পারে।

সূত্র মতে, দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে ই-বর্জ্য। গত ১০ বছরে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ গুণ। এই প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হচ্ছে ডাস্টবিনে। ফলে সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা এনভাইরনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের (ইএসডিও) গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। চলতি বছর এই ই-বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১২ লাখ টন। এখনই এর ব্যবস্থাপনা করা না গেলে সামনের দিনে বড় ধরনের ঝুঁকির সৃষ্টি করবে। দুই-একটি ছোট প্রতিষ্ঠান কিছু ই-বর্জ্য রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। তবে বড় পরিসরে এই উদ্যোগ নেওয়া না গেলে সংকট বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে বলেছেন, এর জন্য বিজনেস প্ল্যান বা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যাতে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়। তাহলে এটা আর ঝুঁকিপূর্ণ থাকবে না। তার মতে, দিনে দিনে ই-বর্জ্য কমানো যাবে না, আমাদের ইলেক্ট্রনিক্স ও ডিজিটাল পণ্যের ব্যবহার আরো বাড়বে। পুরনো প্রযুক্তি বাদ দিয়ে নতুন প্রযুক্তিতে যেতে হবে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাও করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কয়েকটি পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। প্রথমত, যন্ত্র ব্যবহারের সঠিক পদ্ধতি শেখা। এতে মোবাইল, ল্যাপটপ ও ট্যাব বেশি দিন ধরে ব্যবহার করা যাবে। গুরুত্ব দিতে হবে পুরোনো সামগ্রীর ব্যবহার বাড়ানোর ওপরে। একই যন্ত্র একাধিক কাজ করবে, এমন মাল্টিপারপাস ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে। একই চার্জারে সব সংস্থার সব মডেলের মোবাইল চার্জ করা যায়, এমন চার্জারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, ইউনিফর্মের ব্যবহার, নিয়মিত শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে কিছুটা সুফল মিলবে।

সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডাব্লিউইএফ) বার্ষিক বৈঠকে জতিসংঘের নেতৃত্বে ই-বর্জ্য নিয়ে একটি যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ‘এ নিউ সার্কুলার ভিশন ফর ইলেকট্রনিকস-টাইম ফর এ গ্লোবাল রিবুট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে। দ্রুত বাড়তে থাকা ই-বর্জ্যের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। কারণ লাখ লাখ টন ই-বর্জ্য ভূমিতে ফেলে দেওয়া হয়।

জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রোগ্রাম পরিচালক ও ই-বর্জ্য বিশেষজ্ঞ রুয়েদিগের কুয়ের বলেন, বৈশ্বিক ব্যবস্থা নেওয়া অবশ্যই প্রয়োজন। কারণ এ পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ ই-বর্জ্য বছরে উৎপাদন হবে ১২ কোটি টন। এটি পৃথিবীর সম্পদের ওপর যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তেমনি জনজীবনেও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বুয়েটের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে রিসাইক্লিং হচ্ছে উৎপন্ন ই-বর্জ্যের মাত্র ৩ শতাংশ। বাকি ৯৭ শতাংশই কঠিন বর্জ্যের সঙ্গে চলে যাচ্ছে ভাগাড়ে। পরবর্তী সময়ে এসব ই-বর্জ্য পরিবেশের সঙ্গে মিশে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে এরই মধ্যে কয়েকটি রিসাইক্লিনিং কারখানা গড়ে উঠেছে। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ই-বর্জ্য সংগ্রহ হচ্ছে না।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিআইএ) সভাপতি মো. রুহুল আলম আল মাহবুব বলেন, প্রতিবছর প্রায় চার কোটি মোবাইল ফোন আমদানি হচ্ছে। এক বছর পর পর মানুষ মোবাইল পরিবর্তন করে। এ ক্ষেত্রে ই-বর্জ্য তৈরি হয়। ই-বর্জ্য বেশি দামে কিনলে গ্রাহকরাও বিক্রি করতে আগ্রহ দেখাবে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আইনের একটি খসড়া এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। খসড়ায় ধাপে ধাপে পাঁচ বছরে দেশে উৎপন্ন ই-বর্জ্যের ৫০ শতাংশ ব্যবস্থাপনার মধ্যে আনার কথা বলা হয়েছে। আইনটি পাস হলে ই-বর্জ্যের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

https://dailysangram.com/post/522846