২৫ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:১০

‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান’

-ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান/কোথা সে আরিফ অভেদ যাহার জীবন-মৃত্যু-জ্ঞান/ যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম/ ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম/ যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া/ জিন পরী ইনসান।/ স্ত্রী-পুত্ররে আল্লারে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক/হেসে কুরবানি দিত প্রাণ হায়! হায় আজ তারা মাগে ভিখ/ কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া/ ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা/ আজাদ করিতে এসেছিল যারা/ সাথে ল’য়ে কোরআন’।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের আট দশক আগে সমকালীন মুসলমান সমাজের আত্মজাগরণমূলক গানটির মর্মবাণী আজো দিন দিন বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে নিজেরাই নিজেদের শত্রুতায় লিপ্ত এবং অন্যের সংঘবদ্ধ সংহারের শিকার পরিবেশ পরিস্থিতিতে। নজরুল গানটি রচনা করেছিলেন তার অসুস্থ হওয়ার বছর দুয়েক আগে, এটি তার কোনো সঙ্গীত সঙ্কলনে ঠাঁই পায়নি। অগ্রন্থিত গানটি আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ১৯৪১ সালে রেকর্ড করা হয়। এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা আদি রেকর্ড এটি। এর ঠিক দশ বছর আগে ১৯৩১ সালে ’ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ নজরুলের প্রথম ইসলামী গানেরও প্রথম রেকর্ড করেছিলেন আব্বাস উদ্দীন। নজরুল জীবনের শেষ দশ বারো বছরে তিনি মুসলমান সমাজে আত্মজিজ্ঞাসা ও জাগৃতির প্রেরণাপ্রদায়ক যে কবিতা ও গান রচনা করেছিলেন তার প্রাসঙ্গিকতা এখনো বর্তমান। যেমন তার ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা’; ‘শাতিল আরব শাতিল আরব’; ‘খেয়া পারের তরণী’; প্রমুখ কবিতা ও গানে স্বাধীনতা হারা, ঐতিহ্য ও ইতিহাস বিস্মৃত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলার জন্য ছিল নিবেদিত।

সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশে ও সমাজে মুসলমানদের শাসনকাল, গৌরব ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চেষ্টা চলছে। যখন যেভাবে প্রযোজ্য-মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীর উদগাতা হিসেবে মুসলমানদের দেখানোর অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার চিন্তাচেতনাকে পরস্পরবিরোধী ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যার বাতাবরণে রাখার এ প্রবণতা প্রয়াস প্রচেষ্টা নতুন এবং স্থানিক নয়, সার্বত্রিক। আর এর বিপরীতে মুসলমানদের ১. ব্যক্তিগত চরিত্রবলের উন্নতি ২. আন্তঃবিরোধ ও মতানৈক্যের মাসুল দেয়ার পরিবর্তে অনন্য ঐক্যবদ্ধতা ৩. শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা অর্থাৎ জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চাই হতে পারে উদ্ধার ও উন্নয়নের উপায়। ব্যষ্টি থেকে সমষ্টি। প্রথমে তাই ব্যষ্টি বা ব্যক্তির চরিত্রবল উন্নয়নের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান অর্থাৎ ব্যক্তিচরিত্রের কথা কাজ ও আমল তদনুযায়ী পরিচালিত হলে বাকি দুটি শক্তি (ঐক্য ও শিক্ষা) অর্জন বা প্রতিষ্ঠা সহজসাধ্য হবে।

কিছু দিন আগেও করোনার আক্রমণের লক্ষ্য বা প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সমাজ ও পরিবার বিচ্ছিন্ন একেকজন মানুষ, সেই একেকজন মানুষের মন মানসিকতায়, মূল্যবোধে, উপলব্ধির উপলব্ধিতে, আচার আচরণে, বিচার বিবেচনাবোধে, আত্মবিশ্বাস ও শক্তিতে, আত্মশুদ্ধিতে কেমন পরিবর্তন সূচিত হয়েছে বা হচ্ছে, ব্যক্তিচরিত্রের উন্নয়ন ভাবনার পর্যালোচনাটা সেখান থেকে শুরু হতে পারে। সহজে সংক্রমণের ভয় ঢুকিয়ে, প্রতিরোধ ও প্রতিষেধকের ধোঁয়াশে পরিস্থিতিতে মানুষ সামাজিক দূরত্বে থাকার নামে পরিবার ও আপনজনেরাও তাকে সহানুভূতি জানাতে ভয় পেয়েছিল, এমনকি স্থানীয় লকডাউনের নামে প্রচণ্ড অমানবিক আচরণের শিকার হতে হয়েছিল মানুষকেই। একেকজন মানুষকে এসব বাস্তব বিষয় বিবেচনায় এনে প্রত্যেককে নিজে নিজে হতে হবে আত্মসচেতন, আত্মবিশ্লেষক। নিজে শরীরের দেহের যত্ন, মনকে ভালো খাবার, পরিবেশকে বান্ধব করে তোলার পদক্ষেপ নিজেকে নিতে হবে। খালি খালি পোশাকধারী কিংবা বয়ানে প্রচারসর্বস্ব ধর্মপ্রাণ হয়ে নয় সবাইকে ব্যবহারিকভাবে ধর্মপরায়ণ হতে হবে। সব ভালো গুণ ধারণ করতে হবে, অবলম্বন করতে হবে। এখন সবাইকে অনুভবের আয়নায় বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে, শ্রাবণের জোয়ারে নদীর পথ চলায়, পাখির কূজনে, কুহেলী কুয়াশায় ঢাকা শীতের ভোর, শরতের নির্মেঘ আকাশ, কৃষ্ণচূড়া, বাগানবিলাস আর আজালিয়ার সৌন্দর্যে মুখ লুকাতে হবে, শ্বাস প্রশ্বাস নিতে হবে। পাখ, পাখালির নিত্যদিনের সাংগীতিক জীবনযাত্রা কান পেতে শুনতে তাদের সাথে সবার সাথে একাত্ম হতে হবে। এরা সবাই বিধাতার, বিধাতাও এদের সবারই। মনের সব জড়তা, কূপমণ্ডূকতা, দীনতা, হীনতা ঝেড়ে মুছে ফেলে নিজেকে নির্ভার করে তুলতে হবে। হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, রাগ, ক্ষোভ, ভয়, আশঙ্কা, সংকোচ, শঙ্কা, সংক্ষুব্ধতা সবই ত্যাগ করতে পারলে নিত্যনতুন উদ্যমে গৌরব প্রত্যাশায় উদ্বেল হয়ে উঠবে মন। ঈমানদার ব্যক্তিত্ববান বলে গণ্য হওয়ার জন্য মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভীর উপদেশ মতো ১. আগে সালাম দিন ২. হাসিমুখে কথা বলুন। দুঃখ কষ্ট চেপে রেখে মুখের হাসি ধরে রাখতে চেষ্টা করবেন ৩. বেশি শুনবেন, কম বলবেন ৪. তামাশার ছলেও কখনো মিথ্যা বলবেন না ৫. ভুল হলে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চেয়ে নিন বা দুঃখ প্রকাশ করুন ৬. অকারণে বেশি হাসি বা ঠাট্টা মশকরা করবেন না ৭. ধীরে ধীরে বুঝিয়ে কথা বলুন ৮. আগে অন্যের কথা শুনুন, তারপর নিজে বলুন ৯. কোনো বিষয়ে তর্কে জড়াবেন না। মনে রাখবেন, তর্কে জিতা নয় বরং তর্কে না জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ ১০. কারো কাছে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন না। ১১. ধৈর্য ধরে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন ১২. কেউ ভুল করলে ক্ষমা করুন। অন্যের দোষ ঢেকে রাখুন। মানুষের প্রতি সুধারণা রাখুন ১৩. ছোট বড় সবাইকে প্রাপ্য সম্মান দিন ১৪. কথা দিয়ে কথা রাখবেন ১৫. পোশাকে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন, সম্ভব হলে সুবাসিত রাখতে চেষ্টা করবেন ১৬. পারলে খাওয়ান, জোর করে খাবেন না। অন্যের জিনিসে লোভ করবেন না ১৭. খাবার সামনে এলে আগে অন্যকে দিন। সুযোগ সুবিধা নিজে না নিয়ে অন্যদের দিয়ে দিন ১৮. মুখ ও শরীর দুর্গন্ধমুক্ত রাখুন। আপনার যা কিছু আছে, পরিচ্ছন্ন পরিপাটি রাখুুন ১৯. চরিত্র ও নৈতিকতা উন্নত রাখুন।

নিজের অপারগতার কথা কাউকে জানাবেন না। প্রার্থনায়, সাজদায় পড়ে শুধু আল্লাহকে বলুন ২০. আচার ব্যবহারে বিনয়, ভদ্রতা ও নম্রতা বজায় রাখুন।

আল্লাহতে পূর্ণ ঈমান আমার ক্ষেত্রে ইবাদত উপাসনায় যার যার সৃষ্টিকর্তার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণে এবং কর্মে নিবেদিত নিষ্ঠার মানসিকতায় জাগ্রত রাখা বা থাকা উচিত। এ আশাবাদের ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে যার যার সম্পর্কের বিষয়টি সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনা হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা মহীয়ান, গরীয়ান, সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, পরম দয়ালু ও দাতা (রাহমানুর রাহিম)। আল্লাহর সার্বভৌমত্ব একক এবং অদ্বিতীয়। এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়ায় আমার জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবনকাল পেরিয়ে বর্তমান পর্যায়ে আমি উপনীত। কত অসম্ভব ভাব কল্পনার বাস্তবতায় আমি আজ। কত পশ্চাদপর অবস্থা থেকে আমি আজ এখানে। আমি যা হয়েছি তা অন্যেরা একই সমতলে থেকেও হতে পারেননি। আবার আমিও অন্যের মতো অনেক পর্যায়ে যেতে পারিনি। আমি যা তাই-ই হয়েছি, এ সবের নিয়ন্তা তিনিই। এসেছিলাম একা, তাঁরই বিধান মতো, আমার নিয়তি মতো আমি শেষ হয়ে যাবো, চলে যাবো একা একা। এখন প্রশ্ন হলো আল্লাহর সৃষ্টি আমি- আমার নিয়ন্তার প্রতি আমার আত্মসমর্পণ (মুসলিমুন), নির্ভরশীলতা (তাওয়াক্কাল), বন্দেগি কেমন হওয়া উচিত বা তার স্বরূপ কী? করোনাকালে দেশে দেশে ধর্ম ও মতবাদে এ স্বরূপ সন্ধান ও আত্মস্থকরণের তাগিদ অনুভূত হয়েছে তীব্রভাবে। সেবার ইতালির এক হাসপাতালে করোনা থেকে সেরে ওঠা ৯৩ বছর বয়সী রোগীকে রিলিজের দিন ভেন্টিলেশনে অক্সিজেন ব্যবহার বাবদ ৫০০০ ইউরোর একটা বিল ধরিয়ে দেয়া হয়। বৃদ্ধ কেঁদে দিলেন, চিকিৎসকরা বললেন কাঁদছেন কেন, এটা মাত্র এক দিনের বিল, অসুবিধা থাকলে এটি আপনাকে পরিশোধ করতে হবে না। বৃদ্ধ বললেন, আমি পুরো বিল পরিশোধ করব, কিন্তু আমার চিন্তা এবং ভয় সারা জীবন প্রকৃতি থেকে কত অক্সিজেন অবলীলায় পেয়েছি, এ জন্য কোনো দিন কিছ্ ুপে করিনি, করতে হয়নি, বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশও করিনি।’

আল্লাহ আমার রব (প্রভু), আমার হাবিব (বন্ধু) তিনি আমাকে ভুল শুদ্ধ উভয় পরিবেশ পরিস্থিতিতেও পালন করেন-রক্ষা করেন। আমরা আমাদের কর্মক্ষেত্রে, সংসারে জাগতিক নিয়মে আমাদের নিয়ন্ত্রককে ভয় পাই। মান্য গণ্য করি, তাঁর হুকুম তামিলে তৎপর থাকি, তাকে খুশি করতে সমীহ করতে সচেষ্ট থাকি।

কদাচিৎ তাঁর অবাধ্য হই, তিনি মাইন্ড করতে পারেন এই চিন্তায় বা বোধ বিশ্বাসে চিন্তাভাবনায় সব সময় সতর্ক থাকি। সেখানে আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি, আমার সব নিয়ন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণ কর্তার প্রতি, তাঁর হুকুম আহকাম পালনের প্রতি, তাঁকে সম্মান সমীহ করার ক্ষেত্রে তাঁকে ভক্তি ও ভয় করার ক্ষেত্রে এত অমনোযোগী এত অবজ্ঞা অবহেলা কেন? কেন তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি হিংসাবিদ্বেষ পোষণ কিংবা অমানবিক আচরণ? কেন আমরা তাঁর-ই আরেক সৃষ্টিকে আমাদের উদ্ধারকারী ভাবি? কেন তাঁর কাছে বিপদে উদ্ধার চেয়ে, উদ্ধার পেয়ে, পরে ‘আমাদের বিচক্ষণতার জন্য আমরাই উদ্ধার পেয়েছি’ জাতীয় অহঙ্কার ও গর্বে আমরা স্রষ্টাকে ভুলে যাই, কেন তিনি সামনে নেই বলে? তিনি সরাসরি আমাকে তিরস্কার করছেন না বলে? তার প্রতি আমার অগাধ আস্থা, তার একত্বের মহত্ত্বের স্বীকৃতিতে কেন ব্যত্যয় ঘটাই? তিনি ভুল ধরছেন না ভুল ধরার জন্য, তিরস্কার করার জন্য সামনে নেই বলে? তিনি অবশ্যই সর্বত্র বিরাজমান। সে কারণে তিনি নিজে এসে নিজে কিছু করেন না, তাঁরই সৃষ্টিকে দিয়ে করান। আমরা তাঁর সৃষ্ট মানুষ, তাঁর খলিফা (সূরা বাকারা আয়াত ৩০) বা প্রতিনিধি, আমরা তাঁর রহমতে হেকমতে ভালো মন্দ সব কিছু করি। আমরা শুধু তাঁরই ইবাদত করি (সূরা ফাতিহা, আয়াত ৪); তিনিই সব কিছুর কর্মবিধাতা। এমনকি তাঁর সদয় অনুমতি ছাড়া তাঁর কাছে সুপারিশ করার সাধ্য কারো নেই’ (সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৫)। সুতরাং কোনো কিছু সম্পাদনের ক্ষেত্রে তার পরিবর্তে অন্য কিছু বা কাউকে কৃতিত্ব¡ নেয়া বা দেয়ার ক্ষেত্রে ‘শুধু তাঁরই ইবাদত করার’ ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। আল্লাহকে ভয়, তাঁর ইবাদত বা বন্দনা, তাঁর রহমত লাভের প্রত্যাশা প্রার্থনায়, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের এ অস্বীকৃতি (শরিকানা, শিরক) ব্যাপক সাংঘর্ষিক আবহের সৃষ্টি হয়। ইন্নামাল আমালু বিন্নিয়াত, চিন্তা থেকে কাজের উৎপত্তি। কোনো কাজের চিন্তায় যদি আল্লাহ ব্যতিরেকে অন্য বিধায়ক এবং তাঁর নির্দেশনা বা সন্তুষ্টির পরিবর্তে অন্য কোনো উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় পরিব্যাপ্ত হয় তাহলে ওই কাজ সিদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে শুধু অসিদ্ধই হবে না, এটি শিরকের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। এটিও খুব সূক্ষ্ম বিষয়। সে জন্য ‘সুন্দরবন আমাদের বাঁচিয়েছে’ না বলে ‘আল্লাহর রহমতে সুন্দরবন আমাদের বাঁচিয়েছে’ বলাই উত্তম। আল্লাহ অন্তর্যামী তিনি সবই জানেন, তিনি সূক্ষ্মদর্শী, আমি মনে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে কী ধারণা বা ইচ্ছা পোষণ করছি সেটিও তিনি জানেন। তার অগোচর কিছুই নয়। সুতরাং আল্লাহর ক্ষমতা ও তার ওপর নির্ভরশীলতার (তাওয়াক্কল) ধারণাটা প্রধান। তোমরা যে পশু কোরবানি কর তার চামড়া, রক্ত, মাংস কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না, যা পৌঁছায় তা তোমাদের আল্লাহ সচেতনতা বা তাকওয়া (সূরা হজ, আয়াত ৩৭)। কাউকে আল্লাহর শরিক করলে আল্লাহর কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না, কিন্তু বড় ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা, কেননা আমাদের সব দায়িত্ব পালন, ইবাদত বন্দেগি ও ভালো মন্দ অর্জনের মধ্যে তাঁর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশের ফলে আমার ওই সব অর্জন, কর্মসম্পাদন সবই আত্ম-অহঙ্কারে পর্যবসিত হবে, শয়তানের ভুল ডিরেকশনে চলে যাবে। ইবলিসের বিরুদ্ধে যেটি ছিল অন্যতম অভিযোগ এবং সে আমাদের এভাবে সুযোগ পেলে পদস্খলিত করবে এ ব্যাপারে সে চির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রকৃত প্রস্তাবে আল্লাহর ওপর পূর্ণ ঈমান হবে আল্লাহর স্মরণ, স্বীকৃতি ও শোকরানা (কৃতজ্ঞতা প্রকাশ) করা কর্তব্য আমাদের নিজেদের স্বার্থে। আসলে যে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে তার নিজের কল্যাণে করে (সূরা নমল, আয়াত ৪০)।

নিজের বিবেচনাতে নিজের কর্মকাণ্ডের বোধ বিশ্বাসের সালতামামি হতে পারে। নামাজের মধ্যে আল্লাহর সন্দর্শন সাক্ষাৎ (মিরাজ) হয়ে থাকে এটা জানি কিন্তু তার সাথে সাক্ষাতের প্রটোকল প্রকৃত অর্থে মানি? তাহলে নামাজে অমনোযোগিতা আসে কিভাবে? কেন নামাজে যা পড়ছি তার প্রতি মনোযোগ থাকছে না। কেন মনে মনে ভাবনায় কামনায় বাসনায় বারবার তাঁর নির্দেশনার বরখেলাপ করি? সব দেখে শুনে মনে হয় যেন অভিনয় করে চলেছি। হায় দুর্ভাগ্য! কুরআনে আল্লাহ বলছেন, ‘তোমরা একই অপকর্ম বারবার কর অথচ তোমরা কেতাব পড়, অর্থাৎ জেনে শুনেও তোমরা প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ কর। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ কর।’ মুনাজাতে বলছি- ‘হে আল্লাহ আমাকে কামেল ঈমান দাও, সাচ্চা একিন দাও যেন বুঝতে পারি আমার ভালো-মন্দ সবই তোমার ইচ্ছায় হচ্ছে, তোমার ভয়ে ভীত অন্তর দাও, তোমার স্মরণে লিপ্ত জিহবা দাও।’ আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া মুনাজাতে এটাও বলছি, হে আল্লাহ যদি আমি বা আমরা ভুল করি তুমি আমাদের ভুলের জন্য পাকড়াও করো না- আমাদের ওপর এমন বোঝা চাপাইওনা যেমন বোঝা অতীতের ভাইদের ওপর চাপিয়েছিল- আমি যা বহন করতে পারি এমন বোঝা আমার ওপর দাও ইত্যাদি।
এ মুনাজাত করছি কিন্তু বারবার তো একই ভুল করে চলেছি- একই অবাধ্যতা চলছে। তাহলে ওই মুনাজাত কী? ওটা কি তাহলে মনের থেকে বলছি না? আমরা এখনো মনের মধ্যে অন্যের অনিষ্ট কামনা করছি কিনা, এখনো মানবতাকে অপমান অবমাননা, কারো কারো দাবি ও অধিকার হরণের মানসিকতায় আছি কিনা, প্রবঞ্চনা প্রতারণার পথ খুঁজে ফিরছি কিনা, এ সব নিজেকে নিজের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসায় আনত হলে আত্মানুসন্ধানে ব্যাপৃত হলে মিলবে প্রভু নিরঞ্জনের ক্ষমা, ভালোবাসা, প্রেমদর্শন ও বিপদ থেকে উদ্ধার।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের
সাবেক চেয়ারম্যান

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/743192