২৫ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ৪:০৯

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা ও কিছু কথা

-ড. মো. নূরুল আমিন

২০০৭ সালে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল সেনা সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকার ক্ষমতায় আসার অব্যবহিত পরে একটা টিভি চ্যানেলে বাম ও আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবী জনাব শাহরিয়ার কবির দু’টি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের ওকালতি করতে গিয়ে তিনি বলেছেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যারা লড়াই করেছেন তারা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে আদালত কর্তৃক সাজা পাবেন এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হবেন আর যারা বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন তারা বুক ফুলিয়ে ধর্মীয় রাজনীতি করবেন এবং নির্বাচনে অংশ নেবেন তা হতে পারে না। তার দাবি, ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়ে তাদেরও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন যে, ১৯৭২ সালে ধর্মীয় রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কারণ ’৭১ সালে যা কিছু গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও যুদ্ধাপরাধ হয়েছে তার সবকিছু ধর্মের দোহাই দিয়ে হয়েছে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের অংশ করার সময় বলেছিলেন যে, ধর্মকে হত্যা থেকে, হত্যার রাজনীতি থেকে মুক্ত করার জন্য, ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করবার জন্য, ধর্মের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় যদি ইসলামই থাকবে তাহলে আমরা কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করলাম? তার কথায় এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, পাকিস্তানী শাসকদের শাসন-শোষণ, অবিচার-অত্যাচার নয়; ইসলাম থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। এ কথাটি অনেকেরই জানা ছিল না।

আসলে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি দেখে হতবুদ্ধি না হয়ে পারা যায় না। তাদের কথা-বার্তা যে তাদের দেউলিয়াপনাকে উন্মুক্ত করে দেয় এবং তারা তা উপলব্ধি করতে পারেন না, তা দেখে দেশবাসী হতাশ হয়ে যান।

শাহরিয়ার কবির একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি। বাম ও আওয়ামী মহলের রতœ ভান্ডারের অন্যতম রতœ। কেয়ারটেকার সরকারের আমলে তিনি ও তার আরো কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করেছিলেন। মামলাটি তখনও ছিল। এ হিসাবে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহী দেশপ্রেমিক বলা যেতে পারে। তিনি জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধী বলে মনে করেন। যদিও এর আগে ৪ দশক সময়ের মধ্যে তিনি ও তার দল ক্ষমতাসীন অবস্থায় কিংবা তার বাইরে থেকে তাদের অভিযোগের অনুকূলে গ্রহণযোগ্য কোনও প্রমাণ উপস্থাপন করে আদালতে তাদের বিচার করতে পারেন নি। প্রথমাবস্থায় ১৯৭১-৭২ সালে প্রায় চল্লিশ হাজার লোককে গ্রেফতার করে মামলা রুজু করলেও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলা টিকাতে পারেননি। আগে তারা স্বাধীনতা বিরোধী শব্দ ব্যবহার করতেন, পরে তারা নতুন শব্দ “যুদ্ধাপরাধী” আমদানি করেন। এরপর তাদের সুবিধা অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করে এসব নেতাদের শাস্তি দেন। এবার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধেও উঠেপড়ে লেগেছে। ওয়ান ইলেভেনের পরিবর্তনের পর যখন সন্ত্রাস-দুর্নীতির দায়ে বিভিন্ন দলের নেতা-নেত্রীরা গ্রেফতার হতে শুরু করলেন তখন জামায়াতের লোকদের গ্রেফতারের হার তাদের হতাশ করেছিল। এর বিরুদ্ধে কয়েক মাস হৈ চৈ করে যখন কোনও ফল হলো না তখন ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি নিয়ে তারা মাঠে নেমেছিলেন। শাহরিয়ার কবিরের কথা থেকে এখন এই দাবির মূল কারণগুলো বেরিয়ে এসেছে।

আমাদের দেশের কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী যে শিয়ালের চেয়ে ধূর্ত তা অনেকেই জানতেন কিন্তু নিজের লেজ কেটে শিয়ালের মতো অন্যদের লেজ কাটার দাবির ন্যায় নির্বুদ্ধিতা তারা করবেন এটা অনেকেরই জানা ছিল না। শাহরিয়ার কবির তাই পরিষ্কার করে দিলেন। এখন অবস্থার কিছুটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

আগেই বলে রাখি আজকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে যে বিতর্ক তা প্রকৃতপক্ষে ইসলামে রাজনীতি আছে কি নেই তা নিয়ে নয় বরং এ দেশে ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়েই। আওয়ামী লীগ প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। এই সংবিধান এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের ইতিহাসটি অনেকেরই জানা নেই।

বলাবাহুল্য, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে ১১ জানুয়ারি একটি আদেশ জারি করেন। রাষ্ট্রপতি আদেশ নামে অভিহিত এই আদেশ বলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। এই আদেশের আওতায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে (নির্বাচিত এমএনএ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত এমপিএ দের নিয়ে) একটি গণপরিষদ গঠন করা হয়। এর ফলে নবগঠিত গণপরিষদের সদস্য দাঁড়ায় ৪০৩ জন। এদের মধ্যে ৪০০ জন সদস্যই ছিল আওয়ামী লীগের, বাকি তিনজন ছিলেন অন্য দলের বা নির্দলীয়। ঐ সময় গণপরিষদের ৩৪ জন সদস্যকে সংবিধানের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। এই ৩৪ জনের মধ্যে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে মাত্র একজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। সংবিধান তৈরির রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সংবিধানের কোনও অধ্যায় বা অংশবিশেষ প্রণয়ন কিংবা বিভিন্ন ইস্যু তলিয়ে দেখে বিশ্লেষণের লক্ষ্যে কখনো কোনও উপকমিটি গঠন করা হয়নি। এই আদেশের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, এতে সংবিধানের খসড়া অনুমোদনের জন্য সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান রাখা হয়েছিল, অর্থাৎ ৪০৩ জন সদস্যের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ (৩০৩ ভোট) কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ (২৬৯ ভোট) সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নয়, সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ২০২ ভোটে তা পাশ করার সুবিধা রাখা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট সংবিধান কমিটি সংবিধানের একটি খসড়া তৈরি করার কাজ শুরু করে। ১০ জুন খসড়া চূড়ান্ত হয়। অর্থাৎ খসড়া তৈরিতে তাদের সময় লাগে মাত্র ৫৪ দিন। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ড. কামাল হোসেন। এই সংবিধান তৈরিতে তিনিই প্রধানত মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। কথিত আছে যে, ড. কামাল হোসেন সংবিধান তৈরির লক্ষ্যে যত না বেশি আলাপ আলোচনা শলাপরামর্শ করেছেন গণপরিষদ সদস্যদের সাথে, তার চেয়ে বেশি করেছেন দিল্লীভিত্তিক ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে। তারা তাকে শাসনতন্ত্রের প্রস্তাবনা, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও গঠন কাঠামো এবং সরকারের ধরন প্রকৃতিসহ সামগ্রিক শাসনতন্ত্রের যে মুসাবিদা দিয়েছিলেন তিনি কমিটিকে দিয়ে তাই অনুমোদন করিয়েছেন। এতে অধিকার, নীতিমালা, বিধি-বিধান, সরকার পদ্ধতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, সুশাসনের গ্যারান্টি প্রভৃতি সম্পর্কে প্রকাশ্যে বা রুদ্ধদ্বার কক্ষে কোন বিতর্কই অনুষ্ঠিত হয়নি।

১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে সংবিধানের খসড়া পেশ করা হয়। বিনা আপত্তিতে গণপরিষদ প্রাথমিকভাবে খসড়াটি অনুমোদন করে। অবশ্য পরবর্তীকালে কোনও প্রস্তাব থাকলে তা উত্থাপন করার জন্য সাংবিধানিক প্রস্তাবই জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়। জনসাধারণের তরফ থেকে এই খসড়ায় সংযোজন বিয়োজনের জন্য বেশ কিছু প্রস্তাবও দেয়া হয়। এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত অনুচ্ছেদটি প্রত্যাহারের প্রস্তাবও ছিল। পত্র-পত্রিকায় খসড়ার কোন কোন অংশের কড়া সমালোচনাও করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নবেম্বর গণপরিষদ ৬৫টি সংশোধনী সহকারে খসড়া প্রস্তাবটি অনুমোদন করে। এতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাটি অক্ষুণœ থেকে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশের সাংবিধানিক দলিলের মূল প্রস্তাবনায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি ছিল অভাবিতপূর্ব।

গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় এ ধরনের নজির নেই। গণতন্ত্রের সূতিকাগার নামে পরিচিত গ্রেট বৃটেনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি, ক্রিশ্চিয়ান পার্টি প্রভৃতিসহ বেশ কিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সেখানে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত আছে। যুক্তরাষ্ট্রেও অনুরূপভাবে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি, ক্যাথলিক পার্টি, ব্যাপ্টিস্ট পার্টিসহ ইহুদী, খৃস্টান ও মুসলিম ধর্মভিত্তিক অনেকগুলো দল-উপদল কাজ করছে। খোদ ভারতবর্ষ যেখান থেকে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতারা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণের সবক ও অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন সেই ভারতবর্ষেই ধর্মভিত্তিক দল বিজেপি, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, মুসলিম লীগ এবং জামায়াতে ইসলামীসহ অসংখ্য দল সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত দেশসমূহ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়া-আফ্রিকায় এমন গণতান্ত্রিক দেশ নেই যেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নেই। বাংলাদেশ নিজেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ফসল। ১৯৪৭ সালে মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে যদি তৎকালীন পূর্ববাংলা ও আসামের সংশ্লিষ্ট অঞ্চল পাকিস্তানের অংশ না থাকতো, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হতে পারতো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ ও তাদের বশংবদ বামপন্থী দলগুলো অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে ধর্মকে তাদের শত্রু হিসাবে বেছে নেয় এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে শাসনতন্ত্রে একটি বিধান জুড়ে দেয়। এক্ষেত্রে তারা দু’টি কাজ করেছিল।

এক, রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা। এই নীতির অংশ হিসাবেই তারা শাসনতান্ত্রিক বিধান হিসাবে ধর্মভিত্তিক সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করেছিল। এই দু’টি বিধানই ছিল এদেশের সংখ্যাগুরু জনমানুষের জীবন দর্শনের সাথে গাদ্দারী। প্রত্যক্ষভাবে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার এর কারণ ব্যাখ্যা না করলেও পরোক্ষভাবে তারা এটাই বুঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, যেহেতু তাদের দৃষ্টিতে তৎকালীন পাকিস্তানের সরকারগুলো পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের সাথে জড়িত ছিল এবং পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দল মুসলিম লীগ ধর্মভিত্তিক ছিল এবং যেহেতু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তারা জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জমিয়াতে ওলামায়ে ইসলামসহ ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ এবং তাদের নেতৃবৃন্দ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাননি সেহেতু এই দলগুলো যাতে ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে না পারে সেজন্য শাসনতান্ত্রিকভাবে তাদের পথ রুদ্ধ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ভারতীয় স্বার্থও জড়িত ছিল বলে অনেকে অনুমান করে থাকেন। তাদের মতে, এদেশের মুসলমান এবং ইসলামভিত্তিক অথবা ইসলামী জীবন দর্শন ও মূল্যবোধ ভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহ এবং আলেম ওলামাদের কারণে ভারত বিভক্ত হয়েছিল। ভারতীয় কংগ্রেস ও হিন্দু নেতৃবৃন্দ এটা চাননি। দেশ বিভাগের কারণেই পূর্ব বাংলার হিন্দু জমিদারদের জমিদারি ও ব্যবসায়িক স্বার্থ ছেড়ে ভারতে পাড়ি দিতে হয়েছিল। তাদের আরো ধারণা ছিল যে, নবগঠিত বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ উদ্ধারে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রয়োজন। বাজার দখল, করিডোর ব্যবহার, নদী ও সামুদ্রিক বন্দরসমূহের ওপর আধিপত্য, সংস্কৃতির সম্প্রসারণ ট্রানজিট সুবিধা আদায় প্রভৃতি ক্ষেত্রে নিরংকুশ ভারতীয় স্বার্থ উদ্ধারের পথে ইসলামী দলগুলো বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। কাজেই তাদের জব্দ করা প্রয়োজন। জব্দ করার এই প্রক্রিয়াটিও তারা অত্যন্ত তাড়াহুড়ার সাথে সম্পন্ন করেছে। এর যথার্থতা ও আইনগত এখতিয়ার নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।

প্রথমত: মতামত প্রকাশ ও দল গঠনের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অঙ্গ। এখানে বিধিনিষেধ আরোপ করে কোনও দল, গোষ্ঠি বা মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখা যায় না। পাকিস্তান একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল যদিও ধর্মীয় অনুশাসন ঐ দেশটিতে কতটুকু কার্যকর ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তথাপি ঐ দেশে চরম ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসাবে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করেছে, কংগ্রেস পার্টি রাজনীতি করেছে। নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী চীন ও মস্কোপন্থী কমিউনিউস্টরাও ন্যাপের ব্যানারে কাজ করেছে। কম্যুনিস্ট পার্টি সক্রিয় ছিল। একইভাবে ভারতবর্ষেও কম্যুনিস্ট পার্টি কাজ করছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি দল জনগণের কাছে তার আদর্শ ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে যেতে পারে এবং কোন দলটি ভাল কোন দলটি মন্দ তা বিচার বিশ্লেষণ করে ভোট দেয়ার মালিক জনগণ। তারা যদি প্রত্যাখ্যান করে তাহলে আইন করে তাদের বে আইনী করার দরকার হয় না, তারা আপনা আপনিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ও তার বাম সুহৃদরা দুর্ভাগ্যবশত: গণতন্ত্রের এই সহজ নীতি সত্যটি ভুলে গেছেন। দ্বিতীয়ত: কোনও ধর্মের অনুসারী হবার দাবিদার কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি কোনও অপরাধ করে থাকেন তা হলে তার জন্য ধর্ম বা ধর্মীয় অনুশাসনকে দায়ী করা যায় না, যিনি বা যারা অপরাধ করেছেন উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে নিরপেক্ষ বিচারে তিনি বা তারা দোষী সাব্যস্ত হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের শাস্তি প্রদান বাঞ্ছনীয়। সুনির্দিষ্টভাবে তাদের অপরাধ চিহ্নিত করে তার অনুকূলে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করে বিচার করতে পারলেন না। মামলা করলেন মামলা টিকলো না, হাজার হাজার লোককে এরেস্ট করে ধরে নিয়ে গিয়ে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ এমন অপরাধ নেই যার অভিযোগ আনলেন না। মানুষের স্মৃতি যখন তাজা ছিল, সাক্ষ্য প্রমাণ যখন সহজপ্রাপ্য ছিল আলামতসহ যখন সেগুলো অনুসন্ধান ও সংরক্ষণে কোন সমস্যাই ছিলনা তখন তা না করে ভবিষ্যতে রাজনীতি করার জন্য তা তলে রাখলেন। কাউকে ফাঁসি দিতে না পেরে ফাঁসি দিলেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নামে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে। এ কাজটি এমন একটি দেশে করা হলো যে দেশের ৯০ শতাংশ লোক মুসলমান। এর ৪ দশক পরে এসে তারা ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের নামে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন।

আমি স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার কথা বলছিলাম। এই সংবিধানের খসড়াটি অথবা তার অনুমোদন এত তাড়াতাড়ি না করলে কি হতো না? পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধান তৈরির উদ্দেশে ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের Legal Frame work -এর অধীনে নির্বাচন করে যারা এমএনএ এবং এমপিএ নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদের আইনসভার সদস্য বানানো হয়েছিল। আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা তখনো এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন। বলেছিলেন যে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য তারা উপযুক্ত ব্যক্তি নন। এজন্য Constituent Assembly’র নির্বাচন হওয়া উচিত এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নির্বাচিত এসব প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র তৈরি করবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ তার জন্য অপেক্ষা করেনি। ফলে জনগণের নয়, তাদের নিজেদের ইচ্ছারই প্রতিফলন হয়েছে এই শাসনতন্ত্রে। বলাবাহুল্য ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রটি বলবৎ হয়েছিল। এর পরের বছরেই অর্থাৎ ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অনেকের মতে তৎকালীন সরকার শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের কাজটি নির্বাচিত সংসদের উপর ছেড়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তারা তা করেননি। বিশেষজ্ঞরা এজন্য ভারতীয় স্বার্থ, আত্মস্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থ ছাড়াও গণপরিষদ সদস্যদের একটি বিশেষ স্বার্থকে দায়ী করেছেন। এ স্বার্থটি হচ্ছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতার অনুগত থাকার বিষয়টি। এটা সকলেই জানতেন যে সংবিধান অনুমোদন ও বিধিবদ্ধ হবার সাথে সাথেই গণপরিষদ অবলুপ্ত হবে। নতুন সংবিধান অনুযায়ী নতুন পার্লামেন্টের নির্বাচনে মাত্র ৩০০ জন এমপি নির্বাচিত হবেন। যেহেতু গণপরিষদের সকল সদস্যই রাজনীতিক এবং একই রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন সেহেতু পরবর্তী নির্বাচনে তাদের নিজেদের মনোনয়ন পাবার জন্য শীর্ষনেতার সর্বাধিক সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। সে কারণেই আবশ্যিকভাবেই কার্যত সকল গণপরিষদ সদস্যের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা ছিল শীর্ষ নেতা ও দলের ইচ্ছা পূরণের মাধ্যমে আনুগত্য প্রমাণ করা যাতে করে পরবর্তী নির্বাচনে তারা দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন। তারা মনোনয়ন পেয়েও ছিলেন এবং তাদের হাতে দেশটি কিভাবে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ক্ষমতার অপব্যবহার ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব অত্যাচারী স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নেয় এবং ধর্মের পরে গণতন্ত্র তাদের হাতে বন্দী হয়। শাসনতন্ত্র গৃহীত হবার দু’বছরের মাথায় চতুর্থ সংশোধনী বাংলাদেশের স্বাধীন মানুষের সকল প্রকার আশা আকাক্সক্ষা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করে একদলীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। একদিকে লুটপাট, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, জায়গা-জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জবর দখল, চোরাচালান, মজুদদারী, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আস্ফালন অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ, অনাহার, অর্ধাহার, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের মানুষকে নরকের নিকৃষ্ট বাসিন্দায় পরিণত করে। তারা তখন প্রত্যক্ষভাবে দেখতে পায় কারা প্রকৃতপক্ষে খুনী, লুটেরা ধর্ষক। রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা, জনসভায় বছরের পর বছর ধরে যাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো একতরফাভাবে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করে আসছিল দেখা গেল যে তারা নয় বরং অভিযোগকারীরা স্বয়ং এই অপরাধগুলোর সাথে জড়িত। অসহায় মানুষ যখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না তখনই ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের মর্মান্তিক পট পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু মর্মান্তিক হলেও সাড়ে তিন বছরের আওয়ামী দুঃশাসন মানুষকে তা স্বাগত জানাতে বাধ্য করে। এই পট পরিবর্তনের ফলে মানুষ গণতান্ত্রিক অধিকার ফেরত পায়, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার হয় এবং রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পরিত্যক্ত হয়; সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতাও উন্মুক্ত হয়। এই পরিবর্তনগুলো নিছক প্রশাসনিক আদেশে হয়নি, গণভোটে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থনে সেগুলো অনুমোদিত হয়েছে এবং তিন দশক ধরে তার ভিত্তিতে দেশ চলছে। এখন হঠাৎ করে তিন দশক পর ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবি এবং তার সপক্ষে উত্থাপিত যুক্তি সন্দেহাতীভাবে অদ্ভুত। যারা ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদাযাপন করেন তাদের মুখে এটা মানায় না। দুর্নীতির মামলায় নিরপেক্ষ বিচারে আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কেউ যদি নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে পড়েন তাহলে দেশ ও জাতির জন্য তা ক্ষতিকর নয় মঙ্গলের কারণ হতে পারে। এটা অপরাধের শাস্তি। কিন্তু এজন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করা কিংবা শাস্তি দেয়ার চিন্তা করা সুস্থ মস্তিষ্কের পরিচায়ক নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তাদের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে আনীত হাজার হাজার দুর্নীতি মামলা তুলে নেয় কিন্তু বিরোধীদলীয় নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে আনীত মামলাসমূহ রেখে দেয় এবং তারা নিজেরাই তাদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া শুরু করে। যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, দুর্নীতির দায়ে যারা অভিযুক্ত হননি তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তাহলে আক্ষেপ তারাই করতে পারেন যারা বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন। দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট দেয়ার মালিক দেশের মানুষ, কোনও দল বিশেষ নয় এবং তারা তো নয়ই যারা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে লিপ্ত এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় হাইকোর্টের জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়ান। কে স্বাধীনতার পক্ষ আর কে বিপক্ষ এ প্রশ্ন একটি স্বাধীন দেশে অবান্তর বলেই দেশের মানুষ মনে করেন।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে দলটি সংবিধান ক্ষেত্রে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ^াসের ধারা তুলে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন করেছেন। মানুষের ভোটাধিকার হরণ করেছেন এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকেও তুলে দেয়ার পাঁয়তারা করছেন। চৌদ্দ টাকার মাঝারী মানের চাল এখন ৭০ থেকে ৮০ টাকার কমে পাওয়া যাচ্ছে না, পোলাওর চাল ১৩০ থেকে ১৭০ টাকা কেজি, ৮০-৯০ টাকা গরুর গোশত এখন ৭৪০ টাকা থেকে ৮৫০ টাকা কেজি, খাশির গোশত ১,১০০ থেকে ১,২০০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্যই ৫০০ শতাংশ থেকে ১০০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সামাজিক বৈষম্য এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সমাজে এখন দুইটা শ্রেণী অতিধনী এবং অতি দরিদ্র, যাদেরকে Haves and Havenots বলা হয়। এর অবসান অপরিহার্য।

https://dailysangram.com/post/522792