২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৩:২০

কেউ শুনছে না নদীর কান্না

নদী মরে যাওয়ায় নদীকেন্দ্রিক
জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির মুখে
নদী শুকিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে মৎস্যসম্পদ
সেই সাথে বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি,
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর
ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাÐ আর দখল রাজত্ব নদীকে তিলেতিলে মারছে। নদীর সঙ্গে মরছে নদীর ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশও। কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ দেখা দিয়েছে, সেচ চাহিদা মেটাতে হচ্ছে মাটির নিচের পানি তুলে। তাতে বিপদ আরও বাড়ছে। ভ‚গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে, মাটির গুণাগুণ নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে। নদীভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। নদীর মাছ হয়ে উঠছে অমূল্য সম্পদ। নদীতে মাছ ধরা, নৌকায় নদী পারাপার করা জেলে-মাঝিদের জীবনধারা বাস্তব থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

পানি হচ্ছে নদীর প্রাণ। সেই পানির জন্য হাহাকার করছে দেশের প্রতিটি নদী। অথচ কেউ শুনছে না নদীর এই কান্না। নদীকে জীবন্তসত্ত¡া ঘোষণা করে নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। দখলে-দূষণে মরছে নদী। অপর দিকে ভারতের ফারাক্কা ও গজল ডোবায় বাঁধ দিয়ে এবং উজানে তৈরি করা ৪০টি ড্যাম ও ব্যারাজ পানির গতি পরিবর্তন করে এদেশের নদীগুলোকে কার্যত হত্যা করা হয়েছে। ভারত এখন নতুন করে আবারও ফারাক্কার উজানে আরও দু’টি খাল খনন করে পানি অন্যত্র নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এতে তিস্তা একেবারেই পানিশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার ছাড়া নানা ধরনের শিল্প বর্জ্যরে দূষণে নদীর প্রাণ বৈচিত্র্যও এখন হুমকির মুখে। পাশাপাশি নদীর পাড় দখল করে, কিংবা নদীর বুকেই চলছে অবৈধ নির্মাণ। সব মিলিয়ে দেশের বেশির ভাগ নদীর বুকে ধু ধু বালু চর। আর এসব চর এখন ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। নদী মরে যাওয়ায় নদী কেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির মুখে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় হুমকিতে মৎস্যসম্পদ। সেই সাথে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর।

ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। বৃহত্তর যশোরের জেলাগুলো, খুলনার তিনটা জেলা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, এমনকি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ এগুলোর ভাগ্য সরাসরি গঙ্গার ওপর নির্ভরশীল। এ ছাড়া বরগুনা, পিরোজপুর, বরিশাল, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ, এসব জেলার নদীর পানি কমে যাওয়ার কারণে সমুদ্রের পানি ভেতরে ঢুকছে। এতে লবণাক্ত হচ্ছে বিপুল এলাকা। বদলে যাচ্ছে ইকোসিস্টেম। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ৫০ বছর পর সুন্দরবনে একটা সুন্দরীগাছও থাকবে না। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও বরগুনা থেকে মানুষ দেশান্তরি হতে থাকবে। কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

দেশের নদীর মরণদশা নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট বেশ কয়েকটি পর্বে ছাপা হচ্ছে। দেশের কয়েকটি জেলার নদীর সার্বিক অবস্থা আজকের পর্বে তুলে ধরা হলো।

পঞ্চগড় থেকে মো.সম্রাট হোসাইন জানান, ফারাক্কার বাঁধসহ অভিন্ন অন্যান্য নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে পঞ্চগড়ের নদ-নদী এখন মৃত্যুর মুখে। ফারাক্কার মরণ ছোবলে পঞ্চগড় জেলার ৩৩টি নদ-নদী এখন পানি শূন্য। নদীর বুকে ধু ধু বালু চর। আর এসব চর এখন ফসলের বিস্তীর্ণ মাঠ। এ ছাড়া নদী কেন্দ্রিক জীবন-জীবিকা মারাত্মক হুমকির মুখে। পানিহীন নদী মানুষের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কোটি কোটি টাকা খরচ করেও নদীর প্রাণ ফিরাতে পারছে না।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, এ অঞ্চলের নদীগুলোর দিকে হঠাৎ দেখে কেউ বুঝতে পারবে না এটি নদী নাকি ফসলের মাঠ। বেশির ভাগ নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। দু’-একটি নদীতে সামান্য পানি আছে। তবে প্রবাহ নেই। নদীর বুকে জেগেছে বালুচর। এসব চরে কৃষক বোরোসহ আবাদ করছে নানা ফসল। রবিশস্য থেকে শুরু করে ইরি, বোরো, পাট, গম, ভুট্টা, বেগুন, মরিচ, পেঁয়াজ ও রসুনসহ বিভিন্ন সবজি নদীর বুকে আবাদ হচ্ছে। নদী দখল করে গড়ে উঠেছে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, হাট-বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ফলে এই জেলার জেলেরাও বাধ্য হয়ে পেশা পরিবর্তন করেছেন।

জেলায় বিভিন্ন নদী ও খালে ১৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলাকার ৪ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমির আওতাধীন কৃষকের সুবিধার্থে বিগত কয়েক বছর আগে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নয়টি বাঁধ দেয়া হয়। এক সময় এসব নদীর পানি সেচ দিয়েই খরা মৌসুমে নদীর আশপাশে হতো ফসলের চাষাবাদ। এখন সেচ নয়, নদীর বুকেই হয়েছে ফসলের ক্ষেত। তাই বাঁধগুলো কোনো কাজেই আসছে না।

পঞ্চগড় জেলার বুক চিরে করতোয়া, মহানন্দা, চাওয়াই, করুম, টাঙ্গন, পাথরাজ, তালমা, পাঙ্গা, পাম, ভেরসা, ডাহুক, বেরং, গোবরা, তীরনই, রণচÐী, ছোট যমুনা, ছেতনাই, পেটকি, ঘোড়ামারা, মরাতিস্তা, নাগর এখন বিস্তীর্ণ বালিয়াড়িতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে মহানন্দা, করতোয়া ও তালমা নদী বাদে প্রায় সবগুলোই মরে গেছে। এসব নদীর বেশির ভাগের উৎস ভারতে। এক সময় এ নদীগুলোতে সারা বছর স্রোত থাকায় জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধসহ অন্যান্য নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ায় এসব নদী এখন মৃত। নদীগুলো ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে এখন মরে গেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা-উদাসিনতা এবং ভ‚মিদস্যুদের কড়ালগ্রাসে পঞ্চগড়ের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব নদী।

কালিয়াগঞ্জ ও জগদল এলাকার জেলে বাবুল ও মনছুর আলী বলেন, আগে নদী থেকে মাছ ধরে পরিবার-পরিজন চলত। এখন আর সেই সুযোগ নাই। নদীতে পানি না থাকায় খাওয়ার মাছও পাওয়া যায় না।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্যমতে, পঞ্চগড়ের ওপর দিয়ে ৩৩ টি নদী ও দশটি খাল পঞ্চগড় জেলার বুক চিরে প্রায় ৬২১ দশমিক ৯৮ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়। যার মধ্যে ৭ টি নদী ও একটি খাল ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭০.৯০ কিলোমিটার পুনঃখনন করে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে খননের পর বছর না ঘুরতেই নদী আবার ভরাট হয়ে গেছে।

নওগাঁ থেকে এমদাদুল হক সুমন জানান, এ জেলার অন্যতম নদীগুলো হচ্ছে আত্রাই নদী, ছোট যমুনা নদী, ফকিরনী নদী, শিব নদী, পূর্নভবা নদী, নাগর নদী এবং তুলশীগঙ্গা নদী। এক সময় এ নদীগুলো সারাবছর প্রবাহমান ছিল। ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে এখন এসব নদী মূলত মৃত।

ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট থেকে নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলায় আত্রাই নদী প্রবেশ করেছে। জেলার অন্যতম বৃহৎ নদী এটি। বাংলাদেশের ব্যাপক পরিচিত নদ-নদীগুলোর মধ্যেও এই নদী উল্লেখযোগ্য। এই নদীর জেলার ধামইরহাট থেকে পতœীতলা, মহাদেবপুর, মান্দা ও আত্রাই উপজেলা স্পর্শ করে নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায় প্রবেশ করেছে। এককালে মাছ উৎপাদনসহ কৃষিপণ্য বিপণন এবং অন্যান্য ব্যবসা ক্ষেত্রে আত্রাই নদীর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। তবে কালের প্রবাহে নদীর প্রবাহ অনেক কমে গেছে। কেবলমাত্র বর্ষা মওসুমে এই নদীর প্রবাহ গতিশলি থাকে। শুকনা মওসুমে প্রায় শুষ্ক হয়ে পড়ে নদী। এর ফলে বর্ষা মওসুমে ব্যাপকভাবে নৌকা চলাচল করলেও শুকনা মওসুমে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই নদীতে বেশির ভাগ এলাকায় মাঝে মাঝে চর জেগে উঠে। তবে আত্রাই নদী খনন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। ফারাক্কার ছোবলে জেলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ন নদী হচ্ছে ছোট যমুনাসহ অন্যান্য নদীর অবস্থা এখন মৃত বলা যায়।

মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থেকে জ. ই. আকাশ জানান, মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্র দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদীর মাঝে অপরিকল্পিতভাবে একাধিক বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ রোধ করায় পানি প্রবাহিত না হওয়ায় এলাকাবাসী চরম ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। বর্ষা মৌসুমে পানির সাথে ভেসে আসা কচুরিপানা আটকে তা পচে নদীর পানি নষ্ট হয়ে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। ফলে এ অঞ্চলের নদী তীরবর্তী কয়েক হাজার পরিবার পানি ব্যবহার করতে পারেন না। নাব্য সংকটে নদীর পানি শুকিয়ে গেলে গ্রীষ্ম মৌসুমে এ অঞ্চলে চরম আকারে পানির সংকটও দেখা দেয়। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় নাব্য সংকটে অনেকটাই নদীটি মরে গেছে। নদী সচল না থাকায় মিঠা পানির মাছও মিলছে না এ অঞ্চলে।

সরেজমিনে জানা যায়, ২০০০ সালের দিকে বাহিরচর বাজার সংলগ্ন নদীর মাঝে প্রথম বাঁধ দিলেও পরবর্তীতে সেখানে নামেমাত্র ছোট্ট একটা কালভার্ট ব্রীজ করা হয়। এরপরেই বাহিরচর পূর্বপাড়া ইছামতী নদীর ওপর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে নদীর গতিপথ রোধ করা হয়। তার প্রায় দুই কিলোমিটার পরেই আন্ধারমানিক-পিয়াজচর সংযোগে নদীর ওপর দিয়ে আরেকটি স্থায়ী বাঁধ দেয়া হয়। এছাড়াও কাণ্ঠাপাড়া-পশ্চিম খলিলপুর সংযোগে নদীর প্রস্থ কমিয়ে একটি সুইসগেট নির্মাণ করা হয়। এরপর পুর্ব খলিলপুর-বহলাতুলী সংযোগস্থলে নদীর মাঝখানে প্রায় পনের ফিট দৈর্ঘ্য একটি কালভার্ট ব্রিজ নিমার্ণ করা হয়েছে। ফলে বাহিরচর পূর্বপাড়া থেকে হরিরামপুরের শেষ সীমানা সুলতানপুর ও সদরের শুরু ভাঙাবাড়িয়া পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নদীটি অচল হয়ে অবস্থায় রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ কৃষিকাজসহ বিভিন্ন কাজে পানি সংকটে ভুগছেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/569995