২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৩:১৯

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা

‘ঋণ করে ছেলের মামলার খরচ যোগাচ্ছি’

মো. ইমন। বয়স ১৭ বছর। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকা কাদিগড় নয়াপাড়া। ২০২০ সালে ১৫ বছর বয়সী নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ফোন কোম্পানি অতিরিক্ত টাকা কেটে নেয়ায় ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস লেখে। এরপর তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থানায় মামলা করেন স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা। পরবর্তীতে তাকে স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। বর্তমানে স্থানীয় একটি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সে। ইমনের মামলার খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব পরিবার। তার কৃষক বাবা ধানি জমি বিক্রি করে এবং সমিতি থেকে সুদে টাকা তুলে মামলা চালাচ্ছেন। সরজমিন ইমনের গ্রামের বাড়ি ভালুকায় গেলে মানবজমিন-এর সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন কিশোর ইমন এবং তার মা।

মাটি দিয়ে তৈরি এক কক্ষবিশিষ্ট এবং আধাপাকা একটি ঘরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন এই কিশোর। ইমনের মা খোদেজা বেগম বলেন, ছেলের পড়াশুনা শেষ করে ইচ্ছা ছিল একজন ব্যাংকার কিংবা সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে পরিবারের মুখে হাসি ফোটাবে। দেশের সেবা করবে। কিন্তু মামলার কারণে এখন তার সকল স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মামলা প্রসঙ্গে ইমনের মা বলেন, ২০২০ সালে অনেক বলার পরে পরিবারের পক্ষ থেকে একটি স্মার্টফোন কিনে দেয়া হয়। তখন ইমানের বয়স ছিল ১৫ বছর। এ সময় মুঠোফোনে অতিরিক্ত টাকা কেটে নেয়ায় ফেসবুকে এক ফ্রেন্ডের একটি লেখা পোস্ট কপি করে তা শেয়ার করে। এরপর শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে ঘরে শুয়ে ছিল। মমতাজ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি ফোন দিয়ে লেখাটি ডিলিট করতে বলেন। এরপর তার সঙ্গে দেখা করতে বলেন। দেখা করলে বলেন, তুমি যেটা করেছো সেটা খারাপ। এতে করে তোমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী মামলা হবে।

এরপর স্থানীয় যুবলীগের সভাপতি রিপন ফোন দিলে ইমন কান্না করে বলে, ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করে দিন। এ রকম ভুল আর হবে না। এরপর তার সঙ্গে দেখা করতে বললে আর দেখা করেনি এই কিশোর। এরপর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক নিপুণ ভালুকা থানায় বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন। পরদিন শনিবার মামলা করার পর দুপুরে বাসায় পুলিশ আসে। এ সময় এই শিক্ষার্থী বাসায় ছিলাম না। পরে পুলিশ বাসাবাড়ি ভেঙে দেয়ার হুমকি, বকাঝকা দিয়ে চলে যায়। এরপর স্থানীয় যুবলীগের অনেক নেতা বাড়িতে আসেন। তারা বলেন, ইমনকে আটকে রাখেন। ওপর থেকে অর্ডার আসছে তাকে পুলিশে দিতে হবে। এ সময় কিছু ব্যক্তি বলেন, টাকা দাও তাহলে সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তখন টাকা দেয়া হয়নি। পরে বাসা থেকে চলে যায় ইমন। এরপর মা-বাবা এবং খালা ইমনকে সঙ্গে করে ভালুকা থানায় আত্মসমর্পনের জন্য রাত ৯টায় নিয়ে যান। এ সময় পুলিশ দেখে তার বয়স কম। একরাত থানা হেফাজতে রেখে দেয়। পরদিন থানায় ইমনের মা গেলে তাকে পরিবারের হেফাজতে না দিয়ে ময়মনসিংহ আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে গাজীপুরের শিশু কারাগারে পাঠানো হয়। সেখানে ১৬ দিন থাকার পর জামিনে বেরিয়ে আসে। এখন প্রতি তিনমাস পর পর কিশোর ইমনকে আদালতে হাজিরা দিতে যেতে হয়। ইমনের পরিবার ও ইমন জানায়, এ ঘটনার পর প্রতিবেশী-স্কুলের বন্ধুরা বুলিং করতো। ইমন জেলে গেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। অনেকেই ইমনকে দেখতে পারতো না। খুব খারাপ মন্তব্য করতো। কেউ কেউ ভয় দেখিয়ে বলেছে ১০-১৫ বছরেও জেল থেকে বের হতে পারবে না। এরপর তাকে নিয়ে স্থানীয় একটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হওয়ায় স্কুলের হেডমাস্টার ডেকে পাঠায়। এ সময় প্রতিষ্ঠান ইমনের কারণে লজ্জিত হচ্ছে সহ নানা কথা বলেন। এরপর ওই হাইস্কুল থেকে আরেকটি স্কুলে ভর্তি হয় ইমন।

ইমনের মা খোদেজা বেগম বলেন, আমাদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। এখন পর্যন্ত মামলার খরচ চালাতে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বাবা মো. ইসমাইল হোসেন পেশায় একজন কৃষক। চার ভাই-বোনের মধ্যে ইমন সবার ছোট। এখনো ইমনকে প্রতি তিনমাস পর পর ময়মনসিহং এর নারী শিশু আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হয়। বর্তমানে ইমনের বয়স ১৭ বছর ৩ মাস। মামলা চালানোর খরচের বিষয়ে খোদেজা বেগম বলেন, ছেলের মামলার খরচ চালাতে পাশর্^বর্তী এনজিও থেকে সুদে টাকা তুলে এবং জমি বিক্রি করতে হয়েছে। ইমনের বাবা বর্তমানে অসুস্থ। বসতভিটা আর সামান্য চাষের জমির বাইরে তেমন কিছুই নেই। ইমন বলে, স্বপ্ন ছিল সরকারি চাকরি করবো। এখন সেটা আর সম্ভব হবে না হয়তো। সবাই বলে রাষ্ট্রবিরোধী মামলা থাকলে সরকারি চাকরি হবে না। আমি মনে করি এটা অবশ্যই রাষ্ট্রবিরোধী নয়। যেহেতু এটা গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাতিল চাই। আমার মতো আর কোনো শিশু-কিশোর যেন ভবিষ্যতে এমন হয়রানির শিকার না হয়। এ সময় ইমনের মা খোদেজা বেগমও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানান।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না মানবজমিনকে বলেন, কোনো মাইনর বা শিশুর বিরুদ্ধে খুনের ঘটনায়ও মামলা হতে পারে না। তাকে শাস্তি দেয়া কিংবা জেলে রাখার কোনো এখতিয়ার নেই। তাকে শিশু আইনের সকল ধরনের সুবিধা দিতে হবে। তার শিক্ষা ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ছে। এটা ইতিবাচকভাবে দেখার কোনো উপায় নেই। এবং এটা বিচারিক আদালতেরও নজরে আনা উচিত। নাগরিক’র সদস্য, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শিশু-কিশোরদের অপরাধের বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। যা স্পষ্টত জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক মো. পরাগ বলেন, একজন শিশু কিংবা কিশোরের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নিঃস্বন্দেহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। মামলার কারণে সরাসরি বুলিং এর শিকার হতে হয়েছে। তাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সামাজিকভাবে চাপ, পারিবারিক চাপ এক্ষেত্রে বড় একটি বিষয়। যেটা তার মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে।

https://mzamin.com/news.php?news=52228