২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৩:০৪

প্রচণ্ড তাপদাহে ছুটছে মানুষ নাড়ির টানে

প্রচণ্ড তাপদাহ উপেক্ষা করেই ঈদের আনন্দ স্বজনদের মাঝে ভাগাভাগি করতে নাড়ির টানে ছুটছে মানুষ। তবে এবারের ঈদযাত্রার চিত্র আগের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন। ফেরিঘাটে সেই চিরচেনা যানজট নেই। ট্রেন স্টেশনে নেই হুড়োহুড়ি। বাসে গাদাগাদি আর ছাদে যাত্রীও চোখে পড়ছে না এবার। এসব ভোগান্তি লাঘবে পদ্মা সেতু বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ। অপরদিকে, গণপরিবহনের পাশাপাশি ঘরমুখো মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খোলা ট্রাক ও পিকআপভ্যানে করেও গন্তব্যে যাচ্ছেন। তবে বাসে দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ের অভিযোগ যাত্রীদের।

বুধবার থেকে শুরু হয়েছে সরকারি অফিসে ঈদের ছুটি। ফলে মঙ্গলবার অফিস শেষে সরকারি চাকরিজীবীদের বেশিরভাগই ঢাকা ছেড়েছেন। আর বাকিরা বুধবার রওনা হয়েছেন। এছাড়া গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু গার্মেন্টসের ছুটি। সে কারণে বুধবার রাতেই কেউ কেউ ঢাকা ছেড়েছেন। আর অন্যদের মধ্যে যারা বাড়ি গিয়ে স্বজনের সঙ্গে ঈদ করবেন, তারা গতকাল রওনা হচ্ছেন। এছাড়া শুক্রবার থেকে শুরু হবে গণমাধ্যমে ছুটি। এদিকে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে ঘরমুখো মানুষ ঢাকা ছাড়ায় মহাসড়কে যানবাহনের চাপ কয়েক গুণ বেড়েছে। তবে কোথাও অস্বাভাবিক যানজটের খবর পাওয়া যায়নি। অনেকেই বলছেন প্রচণ্ড গরম হলেও এবারের ঈদ যাত্রা অনেকটা স্বস্তিদায়ক।

অন্যদিকে, মহাসড়কে দূরপাল্লার বাসের পাশাপাশি বেড়েছে ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচল। সড়কে বিপুলসংখ্যক মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার চলতে দেখা গেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, এশিয়ান হাইওয়ে ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশজুড়ে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। তবে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। বুধবার সকাল থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত এই তিনটি মহাসড়ক ঘুরে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহনের চাপ রয়েছে উল্লেখ করে কাঁচপুর থানা হাইওয়ে পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, সকাল থেকে মহাসড়কে যানবাহনের চাপ রয়েছে। তবে কোথাও কোনও যানজট নেই। যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। মহাসড়কে আমাদের অতিরিক্ত ৫০ জন হাইওয়ে পুলিশ এবং ৫০ জন ভলান্টিয়ার কাজ করছেন। এ ছাড়া মোবাইল টিমও কাজ করছে। আশা করছি, এবারের ঈদযাত্রা স্বস্তির হবে।

এদিকে ঢাকা–কুমিল্লা রুটে কোন যানযট না থাকলেও অধিকাংশ বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। যাত্রীর চাপ বেশি দেখলে তারা ভাড়া দ্বিগুণও নিচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে। চাঁদপুর মতলব উত্তরের লিটন জানান, কোন কারণ ছাড়াই ভাড়া দ্বিগুণ নিচ্ছে। আগে যাত্রাবাড়ি থেকে দাউদকান্দি ভাড়া ছিল ৮০ টাকা। এখন ভাড়া নিচ্ছে ১৫০ টাকা। বাস ড্রাইভাররা বলছেন,আমাদের খালি গাড়ি নিতে ফিরতে হচ্ছে। তাই আপডাউন ভাড়া নিতে হচ্ছে। আমাদের কিছুই করার নেই। ঢাকায় ফিরতে কোন যাত্রী নেই।
গুলিস্তান থেকে প্রাইভেটকারে যাত্রী নিয়ে কুমিল্লা যাচ্ছেন রফিক মিয়া। তিনি বলেন, ঈদের আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল এতটা স্বাভাবিক থাকবে ভাবতে পারিনি। ঈদের আগে এই রকম থাকলে গাড়ি চালিয়ে স্বস্তি পাওয়া যাবে, একটু বেশি আয় করা যাবে।

সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল মোড়ে যাচ্ছেন শাহিন মিয়া। তিনি বলেন, মোগড়াপাড়াসহ প্রায় পুরো সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। অথচ স্বাভাবিকভাবে এসব পয়েন্টে যানজট ও জটলা সারাবছর ধরে লেগে থাকে। আজ সেই ভোগান্তি নেই।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট নেই ঢাকা-সিলেট ও এশিয়ার হাইওয়ের দায়িত্বে রয়েছেন ভুলতা হাইওয়ে ক্যাম্পের ইনচার্জ (টিআই) ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও এশিয়ান হাইওয়েতে যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। কোথাও কোনও যানজটের সৃষ্টি হয়নি। তবে সন্ধ্যার পরে গাড়ির চাপ বাড়লেও কোন সমস্য হবে আশা করি। যানজট নিরসনে আমাদের অতিরিক্ত ২৪ জন হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে। এ ছাড়া তিনটি মোটরসাইকেল টিম কাজ করছে। কোনও ধরনের দুর্ঘটনা বা অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলে যানজট হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জানা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। যানজট নিরসনে ঢাকামুখী যানবাহন বঙ্গবন্ধু সেতুর গোলচত্বর থেকে ভূঞাপুর হয়ে মহাসড়কের এলেঙ্গায় গিয়ে মিলিত হচ্ছে। আর এলেঙ্গা থেকে উত্তরবঙ্গমুখী যানবাহনগুলো দুই লেনের সড়ক হয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হচ্ছে। ফলে এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত এই ১৩ কিলোমিটার সড়কে অন্যান্য বছরের তুলনায় এখনও তেমন চাপ পড়েনি।

বুধবার সকাল থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। মানিকগঞ্জের বরংগাইল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ জানিয়েছেন, এই মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক ছিল। স্বাভাবিক রয়েছে সিরাজগঞ্জের ৪৫ কিলোমিটার মহাসড়ক। কোথাও কোনও ধীরগতি বা যানজট নেই। তবে ভোরের দিকে যানবাহনের চাপ অনেকটা বেশি থাকলেও এখন সেই তুলনায় কম। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমের কড্ডার মোড় এলাকা থেকে সার্জেন্ট তাহাজ্জত হোসেন বলেন, মহাসড়কে যানবাহনের চাপ বাড়ছে তবে কোথাও কোনও যানজট বা ধীরগতি নেই। ভোরের দিকে যানবাহনের চাপ একটু বেশি ছিল। সে তুলনায় এখন কম। এ ছাড়াও কোনও পরিবহন যেন এলোমেলোভাবে ঢুকে যানজটের সৃষ্টি না করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে।

সিরাজগঞ্জের ট্রাফিক পরিদর্শক (প্রশাসন) সালেকুজ্জামান খান সালেক বলেন, মহাসড়কে যানবাহন বাড়ছে। ভোর থেকে সেটি আরও বেড়েছে। তবে মহাসড়কে চাপ থাকলেও কোনও যানজট বা ধীরগতি নেই। আশা করছি, উত্তরবঙ্গের ঘরে ফেরা মানুষের এবারের ঈদযাত্রা অনেকটাই নির্বিঘœ হবে। এ ছাড়াও যানবাহন ও ঘরে ফেরা মানুষের ভোগান্তি কমা ও সার্বিক নিরাপত্তায় আমরা সর্বোচ্চ সচেষ্ট রয়েছি।

টোল প্লাজায় মোটরসাইকেলের জট প্রতি বছরের মতো এবারও বিভিন্ন যানবাহনের পাশাপাশি মোটরসাইকেলেও ঘরে ফিরছেন অনেকে। বুধবার ভোর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব টোলপ্লাজার আলাদা টোল বুথে মোটরসাইকেলের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। শত শত মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব টোলপ্লাজার পাশেই স্থাপিত আলাদা বুথে অপেক্ষা করছে সেতু পার হওয়ার জন্য। এ সময় সেতু কর্তৃপক্ষের লোকজন পারের অপেক্ষায় থাকা মোটরসাইকেল আরোহীদের নির্ধারিত টোলের টাকা হাতে রাখার জন্য মাইকিং করেন।

স্টেশনে ভিড় নেই এবার অনলাইনে শতভাগ টিকিট বিক্রির ফলে স্টেশনে ছিল না কোনও অব্যবস্থাপনা। গতকাল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে সরেজমিনে দেখা গেছে, স্টেশনে নেই আগের মতো যাত্রীদের সেই চিরচেনা ভিড়। স্টেশনে টিকিটবিহীন যাত্রীর প্রবেশ ঠেকাতে তিন স্তরের চেকিংয়ের ব্যবস্থা রেখেছে রেল কর্তৃপক্ষ। ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশ রেলওয়ের নেয়া এসব সিদ্ধান্তের সুফল পেতে শুরু করেছে যাত্রীরা। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা।

সিলেটের যাত্রী আব্দুস সামাদ মাকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। তিনি বলেন, কোনও রকম ঝামেলা ছাড়াই আমরা এবার যাত্রা করতে পারছি। ১০ দিন আগে টিকিট কেটে রেখেছিলাম অনলাইনে। কোনও সমস্যা হয়নি। স্টেশনে ঢুকতেও কোনও সমস্যা হয়নি। ঢোকার সময় টিকিট আছে কি না সেটা দেখেছে, আইডি কার্ড দেখতে চায়নি। অনলাইন টিকিটিং সিস্টেমের প্রশংসা পাওয়া যাচ্ছে সব যাত্রীর কাছ থেকেই। তবে প্রশংসার পাশাপাশি তাদের অভিযোগ ও দাবিও রয়েছে। তারা জানান, সার্ভার ব্যবস্থা যেনও আরও উন্নত করা হয়।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার বলেন, ঘরমুখী মানুষের ট্রেনে ভ্রমণ নিরাপদ করতে আমরা এবার বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার মধ্যে তিন স্তরের চেকিং অন্যতম। এর ফলে বিনা টিকিটের কোনও যাত্রী প্ল্যাটফর্মে ঢুকতে পারছে না। ফলে টিকিটধারী যাত্রীরা স্বচ্ছন্দে ট্রেনে চড়তে পারছে।

বাসে ভাড়া বেশি, ট্রাকে বাড়ি ফিরছেন অনেকেই স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে রাজধানী ঢাকা ছাড়ছে উত্তরবঙ্গের মানুষ। ফলে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম মহাসড়কে যানবাহন ও যাত্রীদের চাপ বাড়ছে। বাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেলের পাশাপাশি কাঠফাটা রোদে রোজা রেখে কম খরচে ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছেন অনেকে।

বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিমপাড়ে কড্ডার মোড় এলাকায় কথা হয় ট্রাকে করে বাড়ি ফেরা কয়েকজনের সঙ্গে। তারা বলেন, আমরা ঢাকার একটি গার্মেন্টসে কাজ করি, বেতনও খুব কম। বেশি ভাড়া দিয়ে বাসে করে আসা সম্ভব না। তাই কম খরচে ট্রাকে করে বাড়ি ফিরছি।

বগুড়াগামী ট্রাক যাত্রী সোবাহান, রফিক, রুবেল সুমন বলেন, বাসে ভাড়া বেশি আমরা সামান্য বেতনের চাকরি করি। তাই কষ্ট করে ট্রাকে বাড়ি ফিরছি। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে অনেক ভোগান্তি সহ্য করতে হচ্ছে আমাদের। মহাসড়কে যানবাহনের ধীরগতি এবং যানজট না থাকলেও কাঠফাটা রোদে তীব্র গরম সহ্য করে ট্রাকে করেই বাড়ি যাচ্ছি।

এদিকে দেশের দক্ষিনাঞ্চলের মানুষ পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে বাসেই বাড়ি ফিরছেন। এতে করে চিরাচরিত সেই লঞ্চের দৃশ আর দেখা যাচ্ছে না। লঞ্চে আর আগের মত যাত্রী পাচ্ছে না। এমনকি কেবিনও খালি যাচ্ছে। লঞ্চে ভাড়াও আগের তুলনায় অনেক কম। তারপরেও যাত্রী নেই।

https://dailysangram.com/post/522727