২১ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৩:০১

এত বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ করেন কেন

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী


পত্রিকা খুললেই একটা নিউজ পাওয়াই যাবে। তা হলো- অমুক জায়গায় বিদ্যুতের ঘাটতি। অমুক জায়গায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোড শেডিং। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই বললেই চলে। এফবিসিসিআই বলেছে, বিদ্যুতের ঘাটতির কারণে তাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষকরা সাধারণত সহজে খুব বেশি কথা বলে না। বিদ্যুতের দাবিতে অতিষ্ঠ হয়ে হঠাৎ কখনো বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও করে। তারও কোনো মানে হয় না। বিদ্যুৎ কি সারাজীবন এদেশে ছিল!

বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় বিদ্যুতের ‘বারোটা’ বাজিয়ে দিয়ে গেছে। তারা ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এক মেগাওয়াটও বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনি। সে সময় কি মানুষ চলে নাই? চলেছে তো। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে হাজার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছেন বলে দাবি করেন। সে সময় এত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগের পার্লামেন্ট সদস্য গায়িকা মমতাজ পার্লামেন্টেই বলেছিলেন এখন এত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে যে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করতে হবে যে. বিদ্যুৎ লাগবে গো বিদ্যুৎ! সে বিদ্যুৎ গেল কই?

বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বলে সরকারের দাবি। তার জন্য বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েছে। মানুষ কলকারখানা করছে। উৎপাদন হচ্ছে। ব্যাপক কর্মসংস্থান হচ্ছে। ঘরে ঘরে চাকরির সংস্থান করা হয়েছে। তবু এফবিসিসিআই বিদ্যুতের জন্য কান্নাকাটি করে। এদের পেট আর ভরে না। সরকার প্রণোদনার ঋণ দিয়েছিল এদেরকে। সম্প্রতি এর সভাপতি সেই প্রণোদনার ঋণের কিস্তি শোধ করার জন্য আরও ছয় মাস সময় চেয়েছে। সময় তারা পাবেন। কিন্তু ২৫ হাজার টাকা কৃষি ঋণ নিয়ে সময়মত পরিশোধ করতে না পেরে জেল খেটেছেন কৃষকেরা।

কৃষক হয়েছে বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে? ঋণ তো সে নিয়েছে। এটা তো সত্য। তাহলে শোধ করবে না কেন? বলবে টাকা পাবো কোথায়? কেন? লাউয়ের দাম ৮০ টাকা করে দিয়েছি। শিমও ৮০ টাকা। বরবটি ১২০ টাকা। ঢেঁড়শ ১২০ টাকা। শশা ১০০ টাকা। টাকা পাচ্ছেন না আপনারা? তাহলে ঋণের টাকা দিবেন না কেন? এফবিসিসিআিই তাহলে ঋণের টাকা দিবে না কেন? কারণ তারা তো কর্মসংস্থান করছে। মানুষের রুটি রুজির ব্যবস্থা করছে। তাদের তো একটু সময় লাগতেই পারে। অথচ কৃষিপণ্যের দাম নগদ-ফগদ। এক হাতে পণ্য দিচ্ছেন। আর হাতে টাকা নিচ্ছেন। ঋণের কিস্তি দেন। ছাড়াছাড়ি নাই।

আবার এত বিদ্যুৎ বিদ্যুৎই বা করতে হবে কেন? এদেশে কি সবসময় বিদ্যুৎ ছিল? উপজেলা শহরগুলোতে বিদ্যুৎ এসেছে কতদিন আগে? তখন মানুষ কী করতো? প্রধানমন্ত্রী সেসব দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কৃষক ফুটানির কথা বলে। বিদ্যুৎ না হলে সেচ দিবো কীভাবে? কেন, আগে কীভাবে সেচ দিয়েছেন? তখন দোন সিস্টেম ছিল। ক্ষেতে নালা কেটে পুকুরের পানি দোন দিয়ে জমিতে সেচ দিয়েছেন। সরকারের উন্নয়নের ফলে গায়ে কি চর্বি জমে গেছে? এখন আর দোন দিয়ে সেচ দিতে পারেন না? এ কথা সত্য, কৃষক তো পানি পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সেচ দিয়ে ফসল ফলানোর চেষ্টা করে। কারণ দোন দিয়ে যে সেচ দিবে, সে পুকুর উধাও হয়ে গেছে। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানি তুলে কৃষক পরিবেশের চরম সর্বনাশ ঘটিয়েছে। এখন জমির আর্দ্রতা নেই। ফলে সেচ ছাড়া উপায়ও নেই।

পুকুর বা জলাশয় ভূমিদস্যুরা গ্রাস করে ফেলেছে। সে ভূমিদস্যু সব সরকারি দলের সদস্য। কেউ তাদের বাধা দেয়নি। জলাশয় থাকাটা যে কত জরুরি তা এবার অগ্নিকা-ের ঘটনাগুলোর সময় প্রমাণিত হলো। বঙ্গবাজার কিংবা নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেটের আগুন নেভানোর জন্য পানির সংস্থান ছিল না। হিমশিম খেয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ও তাদের পরিবারের লক্ষ্য সদস্য এখন বিপন্ন।

এই নগর জুড়ে অনেক খাল পুকুর ছিল। সরকারি দলের দস্যুরা সেগুলো বহু আগেই ভরাট করে দোকানপাট বা বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। পানি নাই। জলাশয় নাই। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও নিচে নেমে গেছে। পানি তুলবে কোথা থেকে। পানি আসবে কোথা থেকে। এই শহরে আমি যখন প্রথম আসি তখন ধোলাই খাল ছিল। লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমে ছোট লঞ্চে করে নবাবপুর নেমেছিলাম, মনে আছে। বুড়িগঙ্গায় টলটলে পানি ছিল। সেসব দিন হারিয়ে গেছে। এখন সবাই বিদ্যুৎ চায়, নইলে ডিজেল চায়। শ্যালো টিউবওয়েল চালাবে। পানি তুলে আনবে। অথচ পানি কোথায়!

এই সরকারের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদীতে বাঁধ দিয়ে প্রায় সকল পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সে পানির ন্যায্য হিস্যা আছে বাংলাদেশের। কিন্তু মেরুদ-হীন আওয়ামী লীগ সরকার বলছে যে, ওদেরই পানি নাই। ওরা পানি দেবে কোত্থেকে? আমাদের বক্তব্য হলো নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখুন। হিস্যায় যতটুকু পাই, ততটুকুই নেব। এই সরকারের সে দাবি করারও মুরাদ নেই। এখন পানি যেটুকু আসে সেটা আসে আল্লাহ ভরসায়। সরকার টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। পদ্মা তো গেছেই। তিস্তায়ও চরম সর্বনাশ ডেকে এনেছে ভারত। এদের ক্ষমতায় রাখার স্বার্থে সব লুটে নিচ্ছে তারা। পানি প্রবাহ যদি স্বাভাবিক থাকতো খাল-বিল নদীনালা যদি সচল থাকতো, তাহলে আমাদের এই সমস্যা নিয়ে আলোচনার করতে হতো না। একসময় কি কৃষি জমিতে সবুজ শস্যের ফলন ঘটেনি? হাওয়ায় দুলেছে ধানের শীষ। জেলে নৌকা মাছ ধরেছে নদনদীগুলো ঘিরে। এই নদনদী ঘিরে ছিল আমাদের জীবন জীবিকা, কৃষি পরিবেশ ও সংস্কৃতি। সব ধুলায় অন্ধকার।

বিদ্যুতের সংকট যখন শুরু হলো, তখন হাজার হাজার মেগাওয়াটের ঐ বক্তব্য স্তিমিত হয়ে এলো। এখন কুমির ছানা দেখায়। বলে, করোনা গেল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ হলো। সারা পৃথিবী নাস্তানাবুদ। আমরা কি তার বাইরে থাকতে পারবো? ডিজেল নেই। এগুলো যেটুকু আমদানি করি তা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। রাশিয়া থেকে কখনও আমরা ডিজেল আমদানি করিনি। তাহলে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ আমাদের দেখান কেন? রাশিয়ার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেটা উপেক্ষা করে তেল আমদানি করা যাচ্ছে না। ভারতের মাধ্যমে যদি কিছু আমদানি করা যায়ও, তবে তা পরিশোধন করার কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই। ফলে সে চিন্তা বাদ দিতে হচ্ছে। প্রাকৃতিক যেসব সূত্র থেকে আমরা এগুরো মেটাতে পারতাম সেগুলো এখন আর নেই। রিজার্ভের টাকা নানা পথে হাওয়া হয়ে গেছে। এখন সরকার বিভিন্ন দেশকে বলছে যে, আমাদের আল্লার ওয়াস্তে বাকিতে কিছু তেল দেন। সুবিধাজনক সময় এলে পরিশোধ করে দিবো।

কিন্তু এটা বাণিজ্য। বাকি চাহিলে লজ্জা পাওয়া ছাড়া কোনো কায়দা নেই। বাকিতে তেল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ফলে সরকার তেলের দাম দ্বিগুণ তিনগুণ করে ফেলেছে। যার প্রভাব পড়ছে সব কিছুর ওপর। কিন্তু দমে গেলে তো আর হবে না। সরকার উত্তম পথ বাতলে দিয়েছে। বিদ্যুৎ যখন নাই, তখন রেড়ি বা ভেন্নার তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে লেখাপড়া করতে হবে। ছেলেবেলায় আমরা কেরোসিনের কুপি বা হেরিকেনের আলোয় লেখাপড়া করেছি। কই আমাদের তো কোনো অসুবিধা হয়নি। দিব্যি পাস-টাস করে চাকরি বাকরি করে, লেখালেখি করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। এখন কেন বিদ্যুৎ না হলে চলে না। এসি না হলে চলে না। পাখা না হলে চলে না। আমাদের আমলে হাত পাখা ছিল। বৈদ্যুতিক পাখা বা এসি ছিল না।

সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত চমৎকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, লেখাপড়া করতে হবে রেড়ি বা ভেন্নার তেলের প্রদীপের আলোয়। যেভাবে আমাদের পূর্বপুরুষরা গরম পার করেছেন, সেভাবেই পার করতে হবে। আমার তো মনে আছে, চৈত্র-বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে আমরা আমগাছের নিচে পাটি বিছিয়ে ভাইবোনেরা সামান্য বাতাসের আশায় শুয়ে থেকেছি। ঘামে পাটি ভিজে গেছে, টেরও পাইনি। ঘুম ভেঙে গেলে গামছা নিয়ে পুকুরের দিকে ছুটেছি গোসল করতে। এখন গ্রামেও জলাশয় হিসেবে পুকুরের সঙ্কট। বিলগুলো শুকিয়ে কাঠ। যাও দুই একটা পুকুর আছে, সেখানে মাছের চাষ হয়। সেসব পুকুরে নামতে মানা। টিউবওয়েল আসায় পাতকুয়ার ব্যবহার নেই বললেই চলে। সেখানে বালতি দিয়ে আর পানি তোলা যায় না। শুকিয়ে গেছে। টিউবওয়েলেও পানি ওঠে না। সেচ ব্যবস্থার ফলে পানির স্তর নেমে গেছে। সুতরাং রেড়ি বা ভেন্নার তেলের বিকল্পই বা আর কী আছে!

আমরা পাথরের দেশ ভুটানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পানির উৎস বলতে পার্বত্য ছড়া। টিপটিপ করে পানি পড়ে। সেই পানি পাইপ দিয়ে ধরে দূর দূরে নিয়ে যায়। এই পানিই লোকে খায়। পর্বতের অনেক নিচে আছে ঝর্ণাধারার মতো বরফগলা প্রচ- ঠা-া পানি। আমাদের যে গাইড ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, খাবার কিংবা শাকসবজি ফলাবার পানি কোথায় পাও? পর্বতের অনেক উপরে হয়তো দু’টো বসতঘর। ওটাই গ্রাম। মাসে একবার বাড়ির ছোট বড় সবাই পানির পাত্র নিয়ে ঐ নদীতে নামে। গোসল করে। গোসল মানে কী? টুপ করে একটা ডুব দেয়। তারপর যার যার পাত্রে পানি ভরে মাথায় নিয়ে ঐ পর্বত ডিঙিয়ে উপরে উঠে যায়। যতদিন এই পানি থাকে। ততদিন আর ভুলেও নিচে নামে না। শৌচকার্য কীভাবে করো? তিনি জানালেন কেন। পাতা আছে। পাথর আছে। একেবারেই আদিমযুগ। আমাদেরও কী রেড়ি বা ভেন্নার তেল নিয়ে সে আদিমযুগে ফিরে যেতে হবে!

 

https://dailysangram.com/post/522661