২০ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ২:৪৫

ভারী হয়েছে ঋণের বোঝা

বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ঋণ নেয়ার প্রবণতা ব্যাপক হারে বেড়েছে। দেশের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বা পরিবার এখন ঋণের দায়ে জর্জরিত। এই তথ্য উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয় ও ব্যয় জরিপে। জরিপে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের এক-তৃতীয়াংশের বেশি ব্যক্তি বা পরিবার ঋণগ্রস্ত। যেখানে প্রতিবছরে গড় ঋণ নেয়ার পরিমাণ ৭০ হাজার টাকারও বেশি। এই ঋণ তারা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে নিয়েছে।

দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের মধ্যে ঋণের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া মানুষের খাদ্যাভাস ও জীবনাচারে পরিবর্তন এসেছে, এজন্য মানুষ ঋণ নিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মতো ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্ট এর মাধ্যমে সহজেই ঋণ পাওয়ার কারণেও অনেকে ঋণ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী (জরিপ পূর্ববর্তী ১২ মাসে) আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে ৩৭ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পরিবার। ২০১৬ সালে যা ছিল ২৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। ২০১০ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৩২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পরিবার আর্থিক বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে ঋণ নিতো।

এই প্রবণতা ২০১৬ সালে কিছুটা কমে গিয়েছিল। তবে ২০২২ সালে সেটি আবার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এদিকে জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঋণ নেয়ার প্রবণতা শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষের মধ্যে বেশি। ২০২২ সালের জরিপে শহরে ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে, যেখানে এই সময়ে গ্রামে ৩৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে। ২০১৬ সালে শহরে ২২ দশমিক ১০ শতাংশ এবং গ্রামে ৩২ দশমিক ১১ শতাংশ পরিবার ঋণ নিয়েছে। ২০১০ সালে এ হার ছিল যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ৩৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।

অন্যদিকে খানাভিত্তিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০২২ সালের খানার আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের খানাভিত্তিক গড় ঋণ নেয়ার পরিমাণ ৭০ হাজার ৫০৬ টাকা। ২০১৬ সালে এটির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার ৭৪৩ টাকা এবং ২০১০ সালে ছিল ২৮ হাজার ৬২ টাকা।

জরিপ অনুযায়ী, গ্রাম এবং শহরের ঋণ নেয়ার পরিমাণে ব্যবধান অনেক। গ্রামের তুলনায় শহরের পরিবারগুলো টাকার পরিমাণে কয়েকগুণ বেশি ঋণ নেয়। শহরে জরিপ পূর্ববর্তী ১২ মাসে গড় ঋণ নেয়ার পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৯৫ টাকা এবং গ্রামে যার পরিমাণ ৪১ হাজার ৯২১ টাকা। ২০১৬ সালে শহরে একটি পরিবার ঋণ নিতো ৫৯ হাজার ৭২৮ টাকা, যেখানে গ্রামে গড় ঋণ নেয়ার পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৩৩২ টাকা। আর ২০১০ সালে গড় পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫৪ হাজার ১২২ টাকা এবং ২১ হাজার ৮০৪ টাকা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মানবজমিনকে বলেন, ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়ার প্রধান কারণ হলো মূল্যস্ফীতি। খানায় বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষকে ঋণ নেয়া লাগছে।

তবে সকল খানা একই ধরনের না জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা খানাগুলোকে মোটামুটি তিনটি ভাগে দেখতে পারি। একটি হলো ঘাটতি খানা। তাদের ঋণ করতে হয় প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্য। আরেকটি খানা আছে যাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে ঋণ নিতে হয়, আবার চাহিদা মেটানোর জন্যও ঋণ নিতে হয়। সন্তানদের শিক্ষা ব্যয়, স্বাস্থ্যগত ব্যয় মেটানোর জন্য তাদের প্রয়োজন পড়ে। এ ছাড়া মানুষের আয় বৃদ্ধি সাপেক্ষেও তার জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি হয়। মানুষের খাদ্যাভাসে পরিবর্তন হচ্ছে, জীবনাচারে পরিবর্তন হচ্ছেÑএর ফলে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ব্যয় মেটানোর জন্য তাদেরকে ঋণ করতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, নতুন নতুন বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্ট এসেছে। যার মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই ঋণ নিতে পারছে। যেমন ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এসেছে। এগুলো দিয়ে ঋণ নেয়া যায়। আগে এগুলো মানুষ বেশি ব্যবহার করতো না। এজন্য তারা এটি দিয়ে ঋণ নিতে পারতেন না। এখন যেহেতু এগুলো এসেছে, ফলে মানুষ ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে লোন নিচ্ছে। এ ছাড়া চাকরিজীবীরা চাকরির বিপরীতে ঋণ নিচ্ছে। সেটাও কিন্তু ঋণগ্রস্ততা বাড়াচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে জীবনমান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তিনি আরও বলেন, আরেকটি ক্যাটাগরি হলো সারপ্লাস হাউজহোল্ড। যাদের আসলে প্রচুর পরিমাণে অর্থ রয়েছে। কিন্তু তারা বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগের জন্য ঋণ নিচ্ছে। এই সকল কারণে মানুষের মধ্যে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে বলে জানান তিনি।

https://mzamin.com/news.php?news=52074