১৯ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ২:৩৫

ঈদযাত্রার বগি-সিট কমেছে সেখানেও ভিআইপির থাবা

রেলওয়ের জন্য হাজার কোটি টাকায় ইঞ্জিন (লোকোমোটিভ) এবং বগি (কোচ) কেনা হলেও ঈদযাত্রায় কমছে ট্রেনের আসন। গত ঈদুল আজহায় ঢাকা থেকে যাত্রা করা ৩৬ আন্তঃনগর ট্রেনে ৭৫টি অতিরিক্ত বগি যোগ করেছিল রেল। এবার দিতে পেরেছে ৫০টি। আগের বছরের চেয়ে ২৫ বগি কমে যাওয়ায় প্রায় দেড় হাজার আসন কমেছে ঈদযাত্রার ট্রেনে। রেলওয়ে সূত্রে এসব তথ্য পেয়েছে সমকাল।

আসন কমলেও ‘ভিআইপিদের’ টিকিট দিতে রেল এখনও উদারহস্ত। এবারের ঈদযাত্রায় শতভাগ অনলাইনে বিক্রির দাবি করা হলেও প্রচুর টিকিট সার্ভারেই দেওয়া হয়নি। তা সংরক্ষিত রাখা হয় মন্ত্রী, এমপি, বিচারপতি, আমলাদের জন্য। একদিকে ঈদযাত্রার ট্রেনে আসন কমে যাওয়া, অন্যদিকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের’ জন্য টিকিট সংরক্ষণ করায় বঞ্চিত হয়েছে সাধারণ যাত্রীরা।

রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, প্রতি ট্রেনে ছয় আসনের একটি ডাবল কেবিন, তিন আসনের দুটি সিঙ্গেল কেবিন, শীতাতপ এবং শোভন চেয়ার কামরার ১০টি করে আসন রেল মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ের অলিখিত নির্দেশে রাখা হয়েছে। আদতে রাখা হয়েছে আরও বেশি। আগের রেলমন্ত্রীর আমলে যেভাবে রেল ভবনে খাতা খুলে টিকিট বিলানো হতো, কয়েক বছর ধরে তেমনটা হচ্ছে না। শুধু ক্ষমতাবানরা পাচ্ছেন টিকিট।
বগি কেনা হচ্ছে, তবে আসন কমছে

২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে রেলে নজর দেয় আওয়ামী লীগ। গত ১৩টি বাজেটে রেলকে এক লাখ দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এই অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ১৮ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকা। এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হলেও রেলে বগি ও আসন কমছে। যদিও রেলের মহাপরিচালক কামরুল আহসান বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে বগি ও আসনের সম্পর্ক নেই।
গত অক্টোবরে প্রকাশিত রেলওয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক দশকে ২১০টি ব্রডগেজ এবং ২৯০টি মিটারগেজ বগি কেনা হয়েছে। আরও ৪৫০ বগি ক্রয় প্রক্রিয়াধীন। অক্টোবরের পর চীন থেকে ৪৫টি এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৪০টি বগি এসেছে। সব মিলিয়ে ৫৮৫টি নতুন বগি কেনা হলেও ট্রেনের বহরে বগি ও আসন কমছে।

রেলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালে আন্তঃনগর ট্রেনে বগি ছিল ৮৮৬টি। ওই বছরের ঈদুল ফিতরে মেরামত করে বহরে যোগ করা হয় ১৩৮টি বগি। আট বছর পর এসে, দেশের অভ্যন্তরে চলা ৫২ জোড়া আন্তঃনগর ট্রেনের বগি ৭২২টি। ঢাকা থেকে ঈদযাত্রায় যে ৩৬ আন্তঃনগর ট্রেন চলবে, তাতে বগির সংখ্যা ৪৭৫টি। আর বাড়তি যোগ করা হবে ৫০টি। যদিও রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন মার্চে জানিয়েছিলেন, ৫৩টি বগি যোগ করা হবে। তবে বগির অভাবে তা পারেনি রেল।

বগির মতো কমছে আসনও। ২০১৮ সালের ঈদুল ফিতরে ঢাকা থেকে আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা ছিল ৩১। এতে আসন ছিল ২৫ হাজার ৩৪৫। পাঁচ জোড়া ঈদের বিশেষ ট্রেনে আসন ছিল ৩ হাজার ৮৯০ আসন। সব মিলিয়ে আসন ছিল ২৯ হাজার ২৩৫। গত পাঁচ বছরে পাঁচটি ট্রেন বাড়লেও আসন বাড়েনি। বিদেশ থেকে হাজার কোটি টাকায় বগি আমদানি করা হলেও এবারের ঈদযাত্রায় ৩৬ ট্রেনে আসন সংখ্যা ২৫ হাজার ৭৭৮। বিশেষ ট্রেন মিলিয়ে এ সংখ্যা ২৮ হাজারের কিছু বেশি।

২০১৯ সালের ঈদুল ফিতরে ৩৩টি নিয়মিত এবং চারটি বিশেষ ট্রেনে আসন সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ২২৪। পরের দুই বছর করোনার কারণে ঈদযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটে। গত বছরের ঈদযাত্রার ৩৬ ট্রেনে আসন ছিল ২৬ হাজার ৬৬৪, যা এ বছরের চেয়ে প্রায় এক হাজার বেশি। লাখো কোটি টাকা খরচ করে নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ইঞ্জিন-বগি কিনলেও আসন কেন কমছে? এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। তবে একে অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফল বলছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. সামছুল হক।

উত্তরবঙ্গে বগি দিতে পারছে না রেল
ঢাকা থেকে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ১৩টি আন্তঃনগর ট্রেন চলে। ওই তিনটি বিভাগ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ঈদ ছাড়াও স্বাভাবিক সময়ে এই অঞ্চলের টিকিটের চাহিদা থাকে বেশি। গত ৭ এপ্রিল ঈদযাত্রার ট্রেনের আগাম টিকিট বিক্রি শুরুর মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় ঢাকা থেকে রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের জেলাগুলোতে চলা ১০ ট্রেনের সব টিকিট।

এসব রুটের টিকিটের এত চাহিদা থাকলেও বগি বাড়াতে পারেনি রেলওয়ে। রেলের তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমাঞ্চলের ১৩ ট্রেনে বগির সংখ্যা ১৮১। এবারের ঈদে মাত্র ৭টি অতিরিক্ত বগি যোগ করা হয়েছে। গত ঈদুল আজহায় যোগ করা হয়েছিল ৩৩ বগি। এ হিসাবে এবারের ঈদযাত্রায় পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনে ২৬টি বগি কমেছে।

রেলের পূর্বাঞ্চলে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ) মিটারগেজ ট্রেন চলে। পশ্চিমাঞ্চলে চলে ব্রডগেজ ট্রেন। ইঞ্জিন ও বগি চলাচল উপযোগী রাখা রেলের রোলিং স্টক (আরএস) বিভাগের দায়িত্ব। পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনে এবারের ঈদযাত্রায় বগি কমার কারণ জানতে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর আলম চৌধুরীর কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। জানানো হয় তিনি বৈঠকে রয়েছেন। পরবর্তী সময়ে টেলিফোনেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

রেলওয়ের মহাপরিচালক কামরুল আহসান সমকালকে বলেন, ২৫ থেকে ৩০টি ব্রডগেজ বগির বাকি সব কিছু ঠিক থাকলেও চাকায় সমস্যা রয়েছে। সে কারণে এগুলোকে এবারের ঈদযাত্রায় যোগ করা যায়নি। বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছে না। আর ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চাকা আমদানি করা যাচ্ছে না। এ কারণে বগিগুলো চলাচল উপযোগী করা যাচ্ছে না।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় ইউক্রেন যুদ্ধ। ঈদুল আজহা হয় ছয় মাস পর, গত জুলাইয়ে। তখন যুদ্ধের উত্তাপ আরও বেশি ছিল। সে সময়ে বগি মেরামত করা গেলে, এখন করা যাচ্ছে না– এ প্রশ্নে মহাপরিচালক যুদ্ধ শুরুর পর চলতে চলতে এগুলো বিকল হয়েছে।

এবারের ঈদযাত্রায় রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের জন্য যে ৭টি অতিরিক্ত বগি দিয়েছে, এর পাঁচটি যোগ করা হয়েছে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের নির্বাচনী এলাকা পঞ্চগড় রুটে চলা একতা, দ্রুতযান ও পঞ্চগড় এক্সপ্রেসে। এই রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ার বগি দেওয়া হয়েছে দুটি। নন-এসি কেবিন বগি যোগ করা হয়েছে একটি। শোভন চেয়ার বগি দেওয়া হয়েছে দুটি।

ঢাকা-রাজশাহী রুটের ধূমকেতু, পদ্মা এবং সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের জন্য দেওয়া হয়েছে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন। বাকি সাতটি ট্রেনে একটিও অতিরিক্ত বগি যোগ করা হয়নি। অথচ লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর এবং নীলসাগর এক্সপ্রেসের টিকিটের চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি।

পূর্বাঞ্চলেও উন্নতি নেই
ঢাকা থেকে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যে চলে ২৩টি আন্তঃনগর ট্রেন। এতে বগির সংখ্যা ২৯৪। গত ঈদযাত্রায় ৪২টি অতিরিক্ত বগি যোগ করা হয়েছিল। এবার যোগ হয়েছে ৪৩টি। একটি মাত্র বগি বেড়েছে। পূর্বাঞ্চলের জন্য মিটারগেজ বগি দেওয়া সম্ভব হলেও ব্রডগেজ বগির কেন সংকট– প্রশ্নে রেলের মহাপরিচালক বলেন, ব্রডগেজ বগি অধিকাংশ পুরোনো।

রেলের সূত্র জানিয়েছে, নতুন আনার পর পুরোনো বগি মেরামত না করে অবসরে পাঠানো হয়। সংস্থাটির এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, নতুন ১০০ বগি দেশে আনার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো ১০০টি মেরামতে পাঠানো হয়। অথচ এগুলো দিয়েই বছরের পর বছর ট্রেন চলছে। আয়ুষ্কাল পেরোনো বগিগুলোর অন্তত কিছু আরও কয়েক বছর চালানো যেত। রংপুর এক্সপ্রেসে বগির সংখ্যা মাত্র ১৩টি। এবারের ঈদে একটিও বাড়তি বগি দেওয়া হয়নি। অথচ একসময়ে ট্রেনটি ১৮ বগি নিয়ে চলেছে।

আসন কমেছে, আবার টিকিটে ভিআইপির থাবা
ঢাকা থেকে রংপুরগামী রংপুর এক্সপ্রেস (৭৭১) ট্রেনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিনে আসন সংখ্যা ৩৩টি। এ বছর শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রি করা হয়েছে। রেলওয়ে আগেই জানিয়েছিল, এ বছর কোনো টিকিট ব্লক করা হবে না। সব সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শুধু ২ শতাংশ টিকিট রেলকর্মীদের জন্য কোটায় রাখা হবে। রেলের বিক্রীত টিকিটের সংখ্যা এবং ক্রেতার তালিকাও প্রকাশ করেছে রেলওয়ে।

তালিকায় দেখা গেছে, আগামীকাল বৃহস্পতিবারের রংপুর এক্সপ্রেসের ৩৩টি এসি কেবিন আসনের ১০টির টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ঢাকা থেকে। আরও তিনটি বিক্রি করা হয়েছে সান্তাহার থেকে। শুক্রবারের রংপুর এক্সপ্রেসেরও এসি কেবিনের ১০টি আসনের টিকিট বিক্রি করা হয়েছে ঢাকা থেকে। তিনটি বিক্রি করা হয়েছে সান্তাহার থেকে। ঢাকা থেকে যে যাত্রীরা সান্তাহারে নামবেন, সেই আসনের টিকিটই বিক্রি করা হয়েছে।

তালিকা অনুযায়ী, ঢাকা-জামালপুর রুটের অগ্নিবীণা এক্সপ্রেসের আগামীকাল বৃহস্পতিবারের ট্রেনে কেবিনের ৩৩টি আসনের টিকিটের ১০টি বিক্রি করা হয়েছে। বেনাপোল এক্সপ্রেসের এসি বার্থের (রাতের যাত্রার কেবিনের বিছানা) ১৮ আসনের মধ্যে ১০টির টিকিট বিক্রি করা হয়েছে। সব ট্রেনেই এভাবে টিকিট ধরে রাখা হয়েছে। কাদের জন্য রাখা হয়েছে বাকি আসনের টিকিট? এর জবাব দেননি রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে এ আসনের টিকিট রাখা হয়েছে ভিআইপিদের জন্য।

https://samakal.com/bangladesh/article/2304168511