১৯ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ২:৩৩

ক্যাডার ও নন-ক্যাডার দ্বন্দ্বে ১৯০০ শিক্ষকের দুর্ভোগ

দেশের বেসরকারি কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধারাবাহিকভাবে জাতীয়করণের পর থেকে আত্তীকরণ নিয়ে শুরু হয়েছে ক্যাডার ও নন-ক্যাডার দ্বৈরথ। ১৯৮১ সালের বিধি অনুযায়ী সে সময়ের শিক্ষকরা নন-ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ২০০০ সাল থেকে নতুন বিধিমালা অনুযায়ী জাতীয় করা কলেজ শিক্ষকদের বিসিএস (সাধারণ) শিক্ষা ক্যাডার হিসেবে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে দুইভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়। এর ফলে ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আত্তীকৃত শিক্ষকদের নিয়মিতকরণ, স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি বন্ধ হয়ে যায়, যার সমাধান দীর্ঘ ১২ বছরেও হয়নি। এমন ভুক্তভোগী প্রায় এক হাজার ৯০০ শিক্ষক।

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষকদের ক্যাডারভিত্তিক নিয়োগের কোনো সুযোগ নেই। তবে পদোন্নতিসহ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মেহেরপুরের মুজিবনগর সরকারি ডিগ্রি কলেজে ২০১২ সালে সহকারী অধ্যাপক ছিলেন রেজাউল হক। আত্তীকৃত হওয়ার পর তিনি প্রভাষক হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সব চাকরিতে পদোন্নতি হয়, বেতন বাড়ে। দীর্ঘদিন চাকরি করার পর পদ ও বেতন কমে, এমন অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম।’

ভোলা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক থেকে আত্তীকৃত হয়ে প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন হোসাইন মো. জাকির। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমার এক শিক্ষার্থী এই কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছে। আর আমি সহকারী অধ্যাপক থেকে প্রভাষক হয়েছি। বর্তমানে সে আমার স্যার।’

শ্যামনগর হাজী মহসীন কলেজের প্রভাষক প্রতাপ কুমার রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এক শিক্ষার্থী সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আর আমি সহকারী অধ্যাপক থেকে প্রভাষক হয়েছি। এর চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে?’

গাজীপুরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কলেজের প্রভাষক মোবারক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবারের কাছে আমি এখন হাসির পাত্র।’

ভুক্তভোগী শিক্ষকদের তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ৬৩টি কলেজ জাতীয় করা হয়েছে। বিধিমালা-২০০০ অনুযায়ী বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হিসেবে এডহক নিয়োগ পেয়েছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। অথচ নিয়োগের দীর্ঘ ১২ বছর পরও চাকরি নিয়মিত হয়নি ৪৬০ জন শিক্ষকের, তিন থেকে ছয় বছর পর্যন্ত চাকরি স্থায়ীকরণ থেকে বঞ্চিত ২৭৫ জন শিক্ষক এবং সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও তিন থেকে আট বছর পর্যন্ত পদোন্নতিবঞ্চিত ৭৩ জন শিক্ষক। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৯০০। জাতীয় করা মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ হিসাব করলে ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরো বাড়বে।

মাউশির কলেজ শাখার পরিচালক অধ্যাপক শাহেদুল খবির চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, শিক্ষকরা ক্যাডার ও পদোন্নতি দুটিই চান। ২০০০ বিধি অনুযায়ী তাঁদের ক্যাডার প্রক্রিয়া চলমান ছিল। ২০১৬ সালে শিক্ষকদের একটি অংশ ১৯৮১ সালের বিধি অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতা চেয়ে মামলা করেন। তখন প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়, ২০০০ বিধিতে তাঁদের যে ক্যাডার পদ দেওয়া হয়েছে, তা সঠিক হয়নি। বরং ১৯৮১ বিধিতে তাঁদের পদোন্নতির বিধান থাকা জরুরি।

পরিচালক বলেন, ‘ক্যাডারদের নিজস্ব বিধি আছে, সে অনুযায়ী চলবে। আদালতের রায়ে যেহেতু আছে ১৯৮১ সালের আত্তীকরণ বিধিমালা অনুযায়ী তাঁদের ক্যাডার করা যাবে না, এ জন্য যাঁদের নিয়মিতকরণ, স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি আটকে আছে, তাঁদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছি।’

মাউশি সূত্রে জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় করার সময় কলেজ শিক্ষক-অশিক্ষকদের আত্তীকরণ করার বিষয়ে কোনো বিধি ছিল না। তখন শিক্ষকদের আত্তীকরণ বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী এডহক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই বিধিতে শিক্ষকদের নন-ক্যাডার হিসেবে পদায়ন এবং জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। পরে ‘জাতীয়করণকৃত কলেজ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা ২০০০’ চূড়ান্ত হলে এর অধীনেও শিক্ষকদের এডহক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই বিধিতে আত্তীকৃত শিক্ষকদের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। ভুক্তভোগী শিক্ষকদের এই বিধি অনুযায়ী নিয়মিতকরণসহ স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলমান ছিল। তবে ১৯৮১ সালের বিধি অনুযায়ী আত্তীকৃত শিক্ষকরা এই বিধিতে জ্যেষ্ঠতা এবং ২০০০ বিধি অনুযায়ী ক্যাডারভুক্তির দাবিতে ২০১৬ সালে আদালতে প্রায় ৪৫টি মামলা করেন। মামলার কারণেই শিক্ষকদের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। আদালতের রায় অনুযায়ী, শিক্ষকদের এখন ক্যাডারভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই।

২০২১ সালে আদালতের রায় উল্লেখ করে মাউশি থেকে একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ‘রায়ে আত্তীকৃত শিক্ষকদের নন-ক্যাডার ঘোষণা করা হয়েছে। বিধিমালা ২০০০-এর ৬ (৫) ও বিধিমালা ১৯৮১-এর ৮ বিধিতে জাতীয় করা কলেজের শিক্ষকদের বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করার বিধান নেই। এ কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের ক্যাডার পদে নিয়মিতকরণের সুযোগ নেই।’

অথচ জাতীয় করা কলেজ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা ২০০০-এর ৬ (৫) বিধিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘এই বিধি অনুসারে কোনো ব্যক্তিকে এডহক নিয়োগ নিয়মিত করা হলে সংশ্লিষ্ট পদে তাঁর আত্তীকরণ সম্পন্ন হবে। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে নিয়মিতকরণের আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে তিনি ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন বলে গণ্য করা হবে।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারি কলেজ শিক্ষক ফোরামের (বাসকশিফো) সভাপতি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘যে মামলার কথা বলে আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, তা আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমাদের কোনো শিক্ষক এই মামলার সঙ্গে জড়িত নন। ১৯৮১ সালের বিধিতে আত্তীকৃত ১৮টি মহিলা কলেজের শিক্ষকরা মামলাটি করেছেন। সেই বিধি অনুযায়ী তাঁদের ক্যাডারভুক্তির সুযোগ নেই বলে রায়ে জানানো হয়েছে। এই রায়ের সুযোগ নিয়ে মাউশির কিছু কর্মকর্তা আমাদের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার পাঁয়তারা করছেন।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাউশির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, কেউ সরাসরি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার হচ্ছেন, কেউ বা আত্তীকৃত হয়ে ক্যাডারভুক্ত হচ্ছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই ক্যাডারের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। আত্তীকৃত শিক্ষকদের চাকরি নিয়মিতকরণ শুরু হলে তাঁরা পদোন্নতি পেয়ে মাউশি বা আঞ্চলিক অফিসগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে যাবেন, যা বিসিএস দিয়ে আসা অনেক ক্যাডার কর্মকর্তা চান না। ক্যাডারভুক্ত শিক্ষকরা বিধি ২০০০-এর আলোকে নিয়মিতকরণসহ সব সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলেও পছন্দের ব্যক্তি বা অশিক্ষকদের ক্ষেত্রে আত্তীকরণ প্রক্রিয়া চলমান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একই সঙ্গে আত্তীকৃত অনেক শিক্ষককে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হিসেবেই অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। বান্দরবান সরকারি মহিলা কলেজের তপন কুমার দাসকে কুমিল্লার নবাব ফয়েজুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়েছে। লোহাগড়া আদর্শ সরকারি মহাবিদ্যালয় থেকে তরফদার সাজ্জাদ হোসেনকে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে বদলি করা হয়েছে।

আবার ২০০০ বিধিমালায় শিক্ষকদের চাকরি নিয়মিতকরণ, স্থায়ীকরণ ও পদোন্নতি বন্ধ থাকলেও একই বিধিতে অশিক্ষকদের আত্তীকরণসহ সব কার্যক্রম চলমান। গত বছরের ১৬ আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের এক কার্যালয় আদেশে সাত কর্মচারীকে আত্তীকরণ বিধিমালা ২০০০ অনুযায়ী এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পদায়ন করা হয়েছে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2023/04/19/1272765