১৯ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ২:৩১

বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ডেও লোডশেডিং ছাড়ছে না গ্রামে

 দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আবারও রেকর্ড হয়েছে। গত সোমবার রাত ৯টায় দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। এর আগে, গত ১৩ এপ্রিল সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ১৫ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট। এছাড়াও গত ১২ এপ্রিল ও ১১ এপ্রিল রাতেও দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়। ১২ এপ্রিল বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৯৩২ মেগাওয়াট। আর ১১ এপ্রিল রাত ৯টায় ১৪ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল। বর্তমানে দেশের বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। প্রচ- গরমে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না দেশের বিভিন্ন বেশির ভাগ জেলার মানুষ। কারিগরি কারণে রাজধানী ঢাকায় এবং বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি থাকায় ঢাকার বাইরে কিছু এলাকায় লোডশেডিংয়ে ভুগছেন মানুষ।

এদিকে সারা দেশের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি এবং খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। গতকাল মঙ্গলবার এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রতিমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে শিগগিরই ফের স্বস্তিদায়ক পরিবেশ ফিরে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন। ফেসবুকে গ্রাহকদের উদ্দেশে তিনি লেখেন (বানান ও বাক্যরীতি অপরিবর্তিত), ‘এ বছর গ্রীষ্ম, সেচ মৌসুম এবং রোজা একসঙ্গে হওয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে সেটা আমরা আগেই ধারণা করেছিলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে আমরা আমাদের পূর্ব প্রস্তুতির স্বাক্ষরও রেখেছি। কিন্তু গত ৫০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভেঙে বর্তমানে যে নজিরবিহীন দাবদাহ চলছে তাতে ধারণার চেয়েও বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ফলে দেশের অনেক জায়গায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের প্রচ- কষ্ট হচ্ছে। এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্ভোগের জন্য আমরা আন্তরিক সহমর্মিতা ও দুঃখ প্রকাশ করছি। সেই সঙ্গে সবার অবগতির জন্য জানাতে চাই, পরিস্থিতি উত্তরণে বিদ্যুৎ বিভাগ সর্বাত্মক কাজ করছে। খুব শিগগিরই আবারও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ ফিরে আসবে। সম্মানিত গ্রাহকবৃন্দ, ধৈর্য ধরার জন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। নসরুল হামিদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ করছেন। গত দশ বছরে বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন হলেও এখনও লোডশেডিং থেকে মুক্তি মেলেনি। তবে এবার লোডশেডিংয়ের জন্য জ্বালানি সংকটকে অনেক বড় করে দেখা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী মে মাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ চাহিদা ধরে ১৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। টানা প্রচ- গরমের কারণে এপ্রিলেই চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছে গত রাতে ১৫ হাজার ৬০৪ মেগাওয়াট। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে গরম থাকছে বেশি। এ সময় সর্বোচ্চ উৎপাদন করা হচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এতে কখনো কখনো ঘাটতি থাকছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি। পরিস্থিতি গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে ভালো। তখন ডলার-সংকটে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের জন্য সরকার পরিকল্পিত লোডশেডিং করেছিল। এবার গরমের শুরুতে কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে লোডশেডিং ঠেকানো যাবে বলে আশা করেছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। ৬ এপ্রিল থেকে দিনে ৭৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে ভারতের আদানি গ্রুপ। দেশের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা থেকে এখন পাওয়া যাচ্ছে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি। তবে নিজস্ব কয়লায় চালিত বড়পুকুরিয়ায় একটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তিন দিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ডিসেম্বরে উৎপাদন শুরুর পর ইতিমধ্যে কেন্দ্রটি কয়েক দফায় বন্ধ হয়েছে। কারিগরি কারণে আশুগঞ্জ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট বন্ধ হয়ে আছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য বলছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে ২২ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। এর মধ্যে জ্বালানির (গ্যাস, তেল, কয়লা, পানি) অভাবে উৎপাদন করা যাচ্ছে না দুই হাজার মেগাওয়াট। আর যান্ত্রিক ত্রুটি ও রক্ষণাবেক্ষণে থাকার কারণে উৎপাদন করা যাচ্ছে না ৩ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট। সব বিতরণ সংস্থাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে পিডিবি। এরপর তা গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। ঢাকার বাইরে চারটি সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে ঢাকার বাইরে। গতকাল সোমবার দিনের বেলায় সর্বোচ্চ উৎপাদনের সময়েও সারা দেশে লোডশেডিং হয়েছে এক হাজার মেগাওয়াটের বেশি। এর আগে রাত একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত দেশে লোডশেডিং হয়েছে দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তবে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার জানান বলেন, রামপালসহ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র কারিগরি ত্রুটির কারণে বন্ধ আছে। সেগুলো মেরামত করা হচ্ছে। চাহিদা মেটাতে রেকর্ড বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এখনো সর্বোচ্চ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেষ্টা চলছে।

লোডশেডিংয়ে রংপুর বিভাগে ময়মনসিংহের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ ভুগছেন। রংপুরের পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা বলছেন, ১৩ এপ্রিল থেকে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ কমে আসে। এতে বাধ্য হয়ে এলাকাভেদে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। সোমবার ঘাটতি ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়তে থাকে। এক ঘণ্টা বা দেড় ঘণ্টা পরপর লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ৫৫ শতাংশ তাদের অধীনে। গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে গ্রাম এলাকাতেও। কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘাটতি বেশি হচ্ছে। রাতেও হচ্ছে কিছু কিছু। সংস্থাটির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। লোড ভাগাভাগি করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।

গত শনিবার সর্বোচ্চ দুই হাজার ২২৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে আরইবি। সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং করা হয়েছে খুলনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে। এরপর বেশি লোডশেডিং হয়েছে রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলে। ঢাকা বিভাগে লোডশেডিং ছিল নামমাত্র। আর বরিশাল অঞ্চলে কোথাও তেমন লোডশেডিং করা হয়নি।

রাজধানী ঢাকাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদামতো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন আধুনিকায়ন করা হয়নি। তাই এখন বাড়তি সরবরাহ নিতে পারছে না কোনো কোনো বিদ্যুৎ বিতরণ ট্রান্সফরমার। আকস্মিকভাবে ট্রিপ (বন্ধ হয়ে যাওয়া) করে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গতকাল ট্রান্সফরমার বিকল হওয়ায় ভোর থেকে কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিলেন বনশ্রী এলাকার মানুষ। গ্রীষ্মে ডেসকোর সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এবার ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়েছে। এ সময় ডিপিডিসির স্বাভাবিক চাহিদা থাকার কথা ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৬৫ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিড থেকে চট্টগ্রামে বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগ ও নগর কমিটি। দেশব্যাপী প্রচ- দাবদাহে অতিষ্ঠ জনগণ ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে জনজীবন মারাত্মকভাবে ব্যহত হওয়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে এ দাবি জানান তারা। মঙ্গলবার ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, ক্যাব চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারন সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, সহ-সভাপতি সাংবাদিক এম নাসিরুল হক, ক্যাব মহানগরের সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু, সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, ক্যাব চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সভাপতি আবদুল মান্নান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।

স্টাফ রিপোর্টার, মাদারীপুর থেকে জানান, মাদারীপুরে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন জেলার বাসিন্দারা। জানা গেছে, গরম বাড়ার পর থেকেই মাদারীপুরে লোডশেডিং বাড়তে শুরু করে। গত কয়েকদিন ধরে রাতে নিয়ম করে বিদ্যুৎ থাকছে না। গত সপ্তাহে ১২-১৪ ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখেছে জেলার মানুষ। এ অবস্থায় জেলার গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। রাতে নির্ঘুম কাটাচ্ছেন লোকজন। রাতে তিন-চারবার করে বিদ্যুৎ যায়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় ধরে বিদ্যুৎ থাকছে না। হাসপাতালের রোগীরাও চরম কষ্ট পাচ্ছেন। স্বাভাবিক কাজ-কর্ম ব্যাহত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানেও।

বিদ্যুৎ ঠিক মতো না থাকায় বিপাকে পড়েছে ব্যবসায়ীরাও। ঈদের সময় হওয়ায় সব ধরনের পণ্যের বাজারে ভিড় বেশি। কিন্তু তীব্র গরমে ক্রেতা পাচ্ছেন না বিক্রেতারা। আবার ভিড় হলেও লোডশেডিংয়ের কারণে বিক্রেতারা ব্যবসা করতে পারছেন না। গরমে অসহায় হয়ে পড়ছেন উভয়ই। বিদ্যুৎ না থাকলে গরমে কেনা-কাটাও বন্ধ হয়ে যায় অনেকের।

জেলার কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় রোগীদের অবস্থায় শোচনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। প্রচ- গরমে স্বাস্থ্য ঝুঁকি আরও বাড়ছে। মাদারীপুর বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) ৩৩ হাজার গ্রাহকের ষোল মেগাওয়াটের বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১২ মেগাওয়াট। অপরদিকে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৩ লাখ ৬৫ হাজার গ্রাহকের ৭৫ মেগাওয়াটের বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৫৫ মেগাওয়াট। যে কারণে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না
ওজোপাডিকোর মাদারীপুরের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, সারা দেশেই লোডশেডিং হচ্ছে। দুয়েকদিনের মধ্যেই এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে ধারণা করছি। অতিরিক্ত গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে দ্বিগুণ। যে কারণেই এ সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

জয়পুরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান, জয়পুরহাটে গত ১৩ এপ্রিল থেকে দৈনিক প্রায় ১০ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। এতে গ্রাম ও নগরবাসীর জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো কারণ হিসেবে তাপদাহে অত্যাধিক পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদাকে দায়ী করেছেন। জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সূত্রে জানা যায়, দেশে চলমান তাপদাহ ও পবিত্র মাহে রমজান মাসের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অত্যাধিক বেড়ে যাওয়ায়
রামপাল ৫০০ (মেগা ওয়ার্ড) থামাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র অশ্বগঞ্জ ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ও চট্টগ্রাম (রাউজান) ২১০ মেগা ওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ত্রুটির কারণে বন্ধ থাকায় এবং হাটহাজারী ১৩২-৩৩ কেভি গ্রিট উপকেন্দ্রে চঞ বিস্ফোরণের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ লোডশেডিং হচ্ছে। দফতরগুলো আশা করছেন খুব দ্রুত এর সমাধান হবে।

জয়পুরহাট পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার মো. আব্দুল লতিফ বলেন, তাদের প্রতি ঘণ্টায় যে পরিমাণ বিদ্যুৎ চাহিদা দরকার তার চেয়ে কম সাপ্লাই হাওয়াই এ লোডশেডিং হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, গত সোমবার ভোর ৪ টায় আমাদের চাহিদা ছিল ৭৫ মেগাওয়াট কিন্তু আমরা জয়পুরহাট, বগুড়া ও নওগাঁ গীড থেকে পেয়েছি ৪৯ মেগাওয়াট। এতে লোডশেডিং হয়েছে ২৬ মেগাওয়ার্ড। এভাবেই প্রতি ঘণ্টায় আমরা চাহিদার চেয়ে যোগান কম পাচ্ছি। প্রতিদিন গড়ে আমাদের ১৪১ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দরকার। সেখানে আমরা পাচ্ছি ৮০ থেকে ৯৫ মেগা ওয়ার্ড এজন্যই মূলত ২৪ ঘণ্টায় দশ ঘণ্টা বিদ্যুৎ লোডশেডিং হচ্ছে।
অন্যদিকে যাপাট সদরের নেস্কোর নির্বাহী প্রকৌশলী সুমন সূত্রধর বলেন, গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের চাহিদা ছিল ১২.৫ মেগাওয়াট আমরা বিভিন্ন বীর থেকে যোগান পেয়েছি ৮.৩ মেগাওয়াট। বিদ্যুতে ঘাটতি ছিল ৪ মেগাওয়াট।

ঝালকাঠি জেলা সংবাদদাতা জানান, ঝালকাঠিতে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত চার দিন ধরে জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মৃদু তাপপ্রবাহ। জেলায় তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় আবহাওয়া অফিস। বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছে তারা। তীব্র রোদ আর গরমে শিশুরা নদীর পানিতে নেমে প্রশান্তি খুঁজছে। অনেকে কাজ ফেলে স্বস্তির জন্য নদীর তীরে পার্কে বসে সময় কাটাচ্ছেন।

হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ‘তাপপ্রবাহের কারণে ডায়রিয়া, জ্বর, ঠা-া, কাশির মতো রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে শিশুরা ডায়রিয়া ও ঠা-া-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।’ তাই গরমে রাস্তায় কম বের হওয়া ও পানি বেশি পান করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

নাটোর জেলা সংবাদদাতা জানান, নাটোরে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে জমিতে সেচ কাজ ব্যাহত হচ্ছে। বাড়ছে অসুস্থ বয়োবৃদ্ধদের হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি। নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী এমদাদুল হক জানান, নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ ২৫ শতাংশ কম বিদ্যুৎ পাওয়ায় কারণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

মুরাদনগর (কুমিল্লা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ উপজেলার বাসিন্দারা। দৈনিক ১০-১২ বার লোডশেডিং হওয়ায় বিঘিœত হচ্ছে মুসল্লীদের নামাজ পড়া ও ঈদের বেচাকেনায়। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে ফ্রিজ, টিভি, ফ্যান, কম্পিউটার, বাতিসহ ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এমন অবস্থায় হাঁপিয়ে উঠছে গ্রাহকদের জনজীবন।

উপজেলার মুরাদনগর, কোম্পানীগঞ্জ রামচন্দ্রপুর, বাঙ্গরা বাজারের ব্যবসায়ীরা বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বারবার লোডশেডিং হয়। উপজেলার কাপড় দোকান মালিকরা বলেন, মাত্র ঈদ বাজার জমে উঠেছিল। প্রচ- গরম আর বিদ্যুতের ভোগান্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে ক্রেতারা বাজারে আসছেন না। এতে বেচাকেনা কম হওয়াতে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এদিকে, প্রচ- গরমে শিশু ও বৃদ্ধদের অনেকেই জ্বর, সর্দি, কাশি ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে স্থানীয় হাসপাতালসহ চিকিৎসা কেন্দ্রে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি সেবাগ্রহীতার ভিড় বাড়ছে। এ বিষয়ে উপজেলা সদরের মুরাদনগর পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের এ, জি, এম মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ এবং কোম্পানীগঞ্জ জোনাল অফিসের ডিজিএম এ কে এম আজাদ বলেন, গরম বেশি থাকায় ইদানিং বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু জাতীয় গ্রিডে সঙ্কট থাকায় আমরা বরাদ্ধের মাত্র ৩০-৪০% বিদ্যুৎ পাচ্ছি। আশাকরি আগামী ১৮ থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে আসবে।

গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, প্রচ- গরমে গফরগাঁওয়ে ঈদের বাজারে কিছুটা ভাটা পড়েছে। গত কয়েক দিন ধরে উপজেলা সদরসহ আবহমান গ্রামবাংলার নজিরবিহীন লোড শেডিং চলছে। উপজেলা সদরে তেমন একটা লোড শেডিং নেই যা সদরের বাইরে থেকে তুলনামুলক কম। আবহমান গ্রাম বাংলার পল্লী বিদ্যুৎ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটানা ৪ ঘণ্টাাও বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না।

গফরগাঁও পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোশারফ হোসেন জানান, প্রচ- গরমে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে গেছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি যাতে ভালভাবে বিদ্যুৎ দিতে পারি। চরআলগী ইউনিয়নের চরমছলন্দ গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোড়ের পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক মো. মুর্শিদ মিয়া জানান, ৩ নম্বর চরআলগী ইউনিয়ন হচ্ছে সবজির ইউনিয়ন। খরার ফলে আমনসহ নানান ধরনের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি। কোন কোন গ্রামে আগাম আমন ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে । গরমের ফলে শ্রমিকরা ধান কাটতে পারছে না।

ঝিনাইগাতী (শেরপুর) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, শেরপুর গারো পাহাড় অঞ্চল ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় বিদ্যুতের ঘন ঘন যাওয়া আসায় অতিষ্ট হয়ে পড়েছে জনজীবণ। এই দুঃসহ্য গরমে সাধারণ মানুষ রাতদিন লোডশেডিংয়ের তীব্র যন্ত্রণায় এখন অতিষ্ট। অর্ধেক ঘাটতির কথা ব্যাতিত বিদ্যুৎ বিভাগ কোন সদুত্তোর ও দিচ্ছেন না। কাংশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান ও ধানশাইল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ঘন ঘন বিদ্যুতে আসা যাওয়ার খেলায় বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিদ্যুতের এ অবস্থা সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। দ্রুত এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চান এলাকাবাসী।

’ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের ব্যবসায়িরা জানান, নজিরবিহীন গরমে ঈদ বাজারে বিদ্যুৎ না থাকাটা কতটা অমাণবিক তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। কোন প্রকার নোটিশ/ মাইকিং ছাড়া বিদ্যুতের এই ঘন ঘন আসা যাওয়ার খেলায় আমরা ব্যবসায়িরা বলি হচ্ছি। টানা বিদ্যুৎ না থাকাটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। দিনে রাতে ২০-২৫ বার করে ও বিদ্যুৎ চলে যায়। টানা বিদ্যুতের অভাবে আইপিএস চার্জ ও করা যাচ্ছেনা। আইপিএস চার্জ হলেও গরমের মধ্যেই রাতে অন্তত. আলো জ¦ালিয়ে ব্যবসা করা যেতো। অন্ধকারে বেচা-বিক্রি ও কম হয়।

’বিদ্যুৎ বিভাগের ঝিনাইগাতীর আবাসিক প্রকৌশলী বলেন, মোট চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাচ্ছি। তাতেই পুরো এলাকা ভাগাভাগি করে সাপ্লাই দিতে হচ্ছে। ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফারুক আল মাসুদ বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগের আবাসিক প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হবে।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কুলাউড়া কার্যালয়ের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগে কারিগরি জনবল এবং বাহন সঙ্কটের কারণে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের দাবি জনবল সঙ্কট থাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হিমসিম পোহাতে হচ্ছে।

বিদ্যুতের বিক্রয় ও বিতরণ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, কুলাউড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের অধীনে উপজেলা, হাসপাতাল, ব্রাহ্মণবাজার, ঘাগটিয়া, নার্সারি, কাদিপুর, সিরাজনগরসহ ৭টি ফিডারের মাধ্যমে গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ ৭টি ফিডার চালু রেখে গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবাহের জন্য নির্বাহী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৬৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা থাকলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৩১ জন। এরমধ্যে দীর্ঘদিন যাবৎ ৪১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে।

পাহাড়, চা বাগান ও হাওর বেষ্টিত বিশাল উপজেলা বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগে সরবরাহ সচল রাখতে কারিগরি লোকবল স্বল্পতার কারণে প্রতি শিফটে মাত্র ৩ জন কারিগরি কর্মচারী দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। শিফট চলাকালীন সময়ে ৭টি ফিডারে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে গ্রাহক অভিযোগ থাকে। অথচ ৩ শিফটের প্রতি শিফটে বাহনসহ ৩ জনের ২টি করে কারিগরি দল রাখা হলে গ্রাহকদের ভোগান্তির পরিমাণে অনেক লাঘব হত। এছাড়াও বিদ্যুৎ অফিসে গাড়ী চালক সঙ্কট রয়েছে।

এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কুলাউড়া কার্যালয়ের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাসেল আহমাদ বলেন, কারিগরি জনবল ও বাহন সঙ্কট নিরসন বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে আরও ৯ জন কারিগরি কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হলে অথবা ‘কাজ নাই মজুরি নাই’ ভিত্তিতে জনবল রাখার অনুমতি দেওয়া হলে এবং পাশাপশি আরও ৩টি মোটরসাইকেল বরাদ্দ করা হলে গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সেবার গতি আরও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশা করেন।
সাতক্ষীরা জেলা সংবাদদাতা জানান, সাতক্ষীরায় বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে গতকাল মঙ্গলবার সদরের ব্রষ্মরাজপুর এলাকায় গ্রামের মহিলারা ঝাঁটা মিছিল বের করেন। এসময় তারা নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবি জানান।

https://dailyinqilab.com/national/article/569587