১৮ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:৫২

সর্বত্র আগুন আতঙ্ক

বায়তুল মোকাররম ও উত্তরা বিজিবি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড

রাজধানীজুড়ে মার্কেটে মার্কেটে আগুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত কয়েক দিনে রাজধানীর বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ কয়েকটি মার্কেটে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় এখন বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ী, বিক্রেতা ও ক্রেতাদের মধ্যে আগুন আতঙ্ক বিরাজ করছে। গতকাল সোমবারও রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বায়তুল মোকাররম স্বর্ণমার্কেট এবং উত্তরার বিজিবি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ দিকে, রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। মানুষের বাসা-বাড়িতেও দেখা দিয়েছে এই আতঙ্ক। বিশেষ করে প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে যেমনি এসির ওপর চাপ পড়ছে, তেমনি বিদ্যুতের শর্ট সার্কিটের ঘটনাও ঘটছে। দু-একটি বাড়িতে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে।

গতকাল রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ দুটি মার্কেট ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড থেকে রক্ষা পেয়েছে। বায়তুল মোকাররমের দোতলায় স্বর্ণের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আগেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। অপর দিকে উত্তরা মার্কেটেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

হঠাৎ করেই রাজধানীতে মার্কেটে মার্কেটে আগুনের ঘটনা নিয়ে গতকাল বিজিবি সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
মন্ত্রী বলেন, আমরা মনে করি এসব কিছুর পেছনে যদি কোনো উদ্দেশ্য থাকে, কোনো নাশকতা থাকে বা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ধরিয়ে দিয়ে থাকে, সেটাও আমাদের কাছে চলে আসবে। আমরা সে জন্য কাজ করছি।
তিনি বলেন, আমরা নাশকতা চিন্তা করছি, আমরা মনে করছি, কেউ উদ্দেশ্য করে এটা করাতে পারে। তদন্তের পরে আমরা বিস্তারিত বলতে পারব। এটা নিয়ে চিন্তায় রয়েছি, আমরা এটা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছি। প্রধানমন্ত্রী একটা নির্দেশনা দিয়েছেন সে অনুযায়ী কাজ করছি।

মন্ত্রী বলেন, আপনারা দেখছেন গত ৫৮ বছরের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চলছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশেও দেখলাম হিট স্ট্রোকে মানুষ মারা যাচ্ছে। ঢাকায় ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা, যেটা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়। এই অবস্থায় একটা জিনিস আমরা লক্ষ্য করছি- আমাদের মার্কেটগুলোতে হঠাৎ আগুন লাগছে। আমরা বঙ্গবাজারে আগুন দেখেছি, নবাবপুরে ইলেকট্রিক মার্কেটে আগুন দেখেছি। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়ার পরেও প্রায় রোজই আমরা আগুনের দৃশ্যটা দেখছি।

প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন যে- হঠাৎ করে একই সঙ্গে এত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে কেন? সেই ঘটনাগুলো আমরা তদন্ত করছি। আমাদের একটা টিম আগে থেকেই কাজ করছিল। যে টিম কাজ করছিল, তাদের এই আইটেমটাও আগুন লাগার মূল কারণটা কী, উৎসটা কী, তদন্ত করার জন্য তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যোগ করেন তিনি।

মন্ত্রী আরও বলেন, অগ্নিকাণ্ডে যারা সর্বস্বান্ত হচ্ছেন, প্রধানমন্ত্রী সব সময় তাদের জন্য চিন্তা-ভাবনা করছেন, তাদের ব্যবস্থা করছেন। আপনারা এও দেখেছেন বঙ্গবাজারে আগুন ধরার সময় আমাদের ফায়ার সার্ভিসের ১৪টা গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। যে গাড়িগুলো আগুন নেভাবে, সেগুলো ভাঙচুর করা হলো। ভিডিওর মাধ্যমে আমরা যাদেরকে চিহ্নিত করেছি, যাদেরকে ধরেছি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মনে হয়েছে তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ভাঙচুরগুলো করেছে। তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। বিভিন্ন দলের অ্যাকটিভিস্ট বলে তারা পরিচয় দিয়েছে। এ সব কিছু নিয়েই আমাদের তদন্ত চলছে। আমরা আশা করি, তদন্তের পর আপনাদের আরও কিছু জানাতে পারব। ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী এসব অগ্নিকাণ্ডের পেছনে সিটি করপোরেশনের ইন্ধন থাকতে পারে, সে ক্ষেত্রে তদন্তে নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি উঠে আসবে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিটি করপোরেশন এখানে কী করবে? বঙ্গবাজারকে অনেক আগেই সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস পরিত্যক্ত মার্কেট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তারপরও তো তারা কোর্টের একটা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মার্কেট করছিল। সিটি করপোরেশন নিজের কাজ করছে। এগুলো নিয়ে অনেকে হয়তো বিভ্রান্তিকর নিউজ ছড়াতে পারে। সব কিছুই আমরা তদন্ত করে দেখছি। তিনি বলেন, ঈদের ছুটিতে ফায়ার সার্ভিস থাকবে, যেখানে দুর্ঘটনা হবে, সেখানে অ্যাম্বুলেন্স থাকবে। সবগুলো মার্কেটে তারা সবসময় সচেষ্ট থাকবে, যাতে করে আগুন না ধরে। এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিস সব মার্কেটেই গিয়েছে, পরীক্ষা করে তারা কিছু নির্দেশনা দিয়েছে, যাতে সংশ্লিষ্ট সবাই সতর্ক থাকতে পারে। আর নিরাপত্তার কথা যেটা বলেছেন, দেশে যে সব জায়গায় মার্কেট রয়েছে, সেখানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমাদের পুলিশ বাহিনী করছে।

৫৮টি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব মার্কেট কী করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মার্কেটগুলোর ব্যবসায়ী যারা আছেন, তারা এটার ব্যবস্থা নেবেন। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় মার্কেটগুলো চালাবেন কি না এটা তারা বলতে পারবেন। আমি মনে করি, দ্রুতই ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেবে।

তদন্ত কমিটি কয়টি করা হয়েছে, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। একটি ফায়ার সার্ভিসের, আরেকটি ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি রয়েছে। সেখানে সরকারি সব অফিস, কেবিনেট প্রতিনিধিদের নিয়ে এ কমিটি হয়েছে। সেখানে নতুন অ্যাজেন্ডা দেয়া হয়েছে। এ দুইটি বিষয় যেমন- এই অগ্নিকাণ্ড নাশকতা কি না, রাজনৈতিক কোনো ইন্ধন আছে কি না, এসব বিষয় দেখতে বলা হয়েছে। তারা এটা আরও ডিটেইল তদন্ত করবে এবং দ্রুত প্রতিবেদন দেবে। এ জন্য দুই দিন সময় বাড়ানো হয়েছে। মন্ত্রী জানান, আমরা সব কিছু চিন্তা করছি, সে জন্য তদন্ত করছি।

বায়তুল মোকাররমের স্বর্ণের মার্কেটে আগুন : বায়তুল মোকাররম স্বর্ণের মার্কেটের দ্বিতীয়তলায় বিদ্যুতের লাইনে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গতকাল দুপুর পৌনে ৩টার দিকে এ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ সময় মার্কেটের ব্যবসায়ী, বিক্রেতা ও ক্রেতারা আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মিডিয়া শাখার প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) মো: শাহজাহান সিকদার জানান, স্বর্ণের মার্কেটের দ্বিতীয়তলায় বিদ্যুতের লাইনে আগুন লাগে। বেলা ২টা ৫৩ মিনিটে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। তবে ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট পৌঁছানোর আগেই আগুন নিভে যায়।
মার্কেটের লোকজন জানান, আগুন লাগার সাথে সাথে মার্কেটের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় আগুন নিভেয়ে ফেলা হয়। তবে আগুনের ঘটনায় মার্কেটের কয়েক শ’ স্বর্ণের দোকান মালিক-কর্মচারী ও ক্রেতা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করে বেরিয়ে যায়। এখনো মার্কেটে আগুন আতঙ্ক বিরাজ করছে।

উত্তরায় বিজিবি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড : উত্তরা হাউজ বিল্ডিং এলাকায় বিজিবি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। গতকাল সকাল সোয়া ১০টার দিকে একটি দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়।

ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে সেখানে আগুন লাগার খবর পায়। পাঁচটি ইউনিট পৌনে এক ঘণ্টা চেষ্টার পর বেলা ১১টা ১০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এক তলা টিন শেড ওই আধাপাকা মার্কেটে কাপড়ের দোকান ছাড়াও মোটর সার্ভিসিংয়ের দোকান রয়েছে। আগুন লাগার পরপরই মার্কেটের টিনের চালের ওপর দিয়ে কালো ধোঁয়া বের হতে থাকে। লোকজন ছুটোছুটি করে কাপড়ের রোল বের করে রাস্তায় এনে রাখে।

আগুনের খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো মার্কেটে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশের লোকজন এসে ভিড় করেন সেখানে।
মহানগর পুলিশ উত্তরা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বদরুল হাসান বলেন, মার্কেটের একটি মোটর পার্টসের দোকান থেকে আগুন লাগে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। আগুনে ছয় থেকে সাতটি দোকান পুড়ে গেছে। তবে কেউ হতাহত হননি।
ভয়াবহ আগুন থেকে রক্ষা পেল রংপুরের মতি প্লাজা

রংপুর অফিস জানায়, রংপুর মহানগরীর মতি প্লাজার আগুনে সাতটি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতায় আগুনের ভয়াবহ বিস্তার এবং ক্ষতির হাতে রক্ষা পেয়েছে মার্কেটটি। এতে ৫০ হাজার টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার বেলা সোয়া ৩টায় নগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়ের মতি প্লাজার নিচের একটি ফোমের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। ধোঁয়া দেখার সাথে সাথেই ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দিলে ৫ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে দু’টি ইউনিট এসে আগুন নিভাতে থাকে। এর মধ্যে আরো ৮টি ইউনিট চলে আসে। এসব ইউনিট আসার আগেই ১০ মিনিটের মধ্যেই আগুন নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে ফায়ার সার্ভিস। এর মধ্যে ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যসামগ্রী সরাতে থাকেন। আগুন দেখতে উৎসুক মানুষের ভিড় ঠেকাতে এবং নিরাপত্তায় পুরো এলাকা কর্ডন করে পুলিশ। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন অন্তত ৭-৮টি দোকান আগুন এবং পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত এক লাখ টাকার কাপড়সহ বিভিন্ন মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/742269