১৮ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ১০:০০

আইনের শাসন সূচকে বাংলাদেশের অধোগতি প্রসঙ্গে

-ড. মো. নূরুল আমিন

॥ এক ॥
২০২১ সালের আইনের শাসন সূচকে বিশ্বের ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪-এ নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক World Justice Project (WJP) তাদের এক ঘোষণায় এই তথ্য পরিবেশন করেছে। এর ফলে সূচকে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্কোর আগের বছরের ০.৪১ থেকে কমে ০.৪০-তে নেমে আসলো।

রিপোর্টে দেখা গেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ায় নেপালের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল, ৭০তম, এরপর শ্রীলংকা ৭৬তম, ভারত ৭৯তম, বাংলাদেশ ১২৪তম, পাকিস্তান ১৩০তম এবং আফগানিস্তান ১৩৪তম। উল্লেখ্য যে, আইনের শাসনে প্রথম যে তিনটি দেশের কার্যক্রম ভাল সে দেশগুলো হচ্ছে ডেনমার্ক (স্কোর ০.৯০), নরওয়ে (স্কোর ০.৯), ফিনল্যান্ড (স্কোর ০.৮৮) অন্যদিকে নিম্নতম স্কোর নিয়ে ভেনিজুয়েলা (০.২৭), কম্বোডিয়া (০.৩২) এবং কঙ্গো (০.৩৫) তলানির তিনটি দেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মানবাধিকারের অবস্থা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যে মানবাধিকারের অবস্থা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, দুর্নীতির অনুপস্থিতি, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা আইনের প্রায়োগিক অবস্থাসহ ৪৪টি সূচকের ভিত্তিকে এখানে স্কোর নির্ণয় করা হয় এবং এর প্রত্যেকটিতেই বাংলাদেশের অবস্থা করুণ। আইনের শাসন বিষয়ে সংস্থাটি আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুসরণ করে। উল্লেখ্য যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডিকে (Dicey) আইনের শাসনের একটি সংজ্ঞা নিয়েছেন যা সারাবিশ্ব মেনে চলে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনটি উপাদান প্রয়োজন। তার ভাষায়:
1) That there should be no sanctions without breach, meaning that nobody should be punished by the state unless they had broken law.
2) That one law should govern every one including both ordinary citizen and state officials.
3) That if the rights of the individuals were not second by a written constitution it must be secured by the decisions of judies in ordinary law. (: Cathelin Eliat and France Quinx English Legal System. P-8).
অর্থাৎ ১. আইন ভঙ্গ না করা পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেয়া যাবে না। একই আইন ও পদ্ধতিতে সাধারণ জনগণ ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিচার করতে হবে। আইন সকলের জন্যই সমান হবে। ব্যক্তি অর্থাৎ নাগরিকের অধিকার যেখানে সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত হয়নি, সেখানে আদালতের রায়ে তা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।

বাংলাদেশে আইনের শাসনের এই প্রথম ও অপরিহার্য উপাদানটিই প্রতিনিয়ত লংঘিত হচ্ছে। গত ১৪ বছর ধরে সরকার বিরোধী কোন দলই কোন সভা, সমাবেশ, মিটিং বা মিছিল করতে পারে না। ঘরোয়া বৈঠকে তারা একত্রিত হতে পারেন না। সরকার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনা বলে এগুলোকে অভিহিত করে এই সময়ে লক্ষ লক্ষ বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করে হাজার হাজার মামলা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন একটি মামলায়ও সরকার তাদের বিরুদ্ধে নাশকতার চক্রান্তের একটি ঘটনাও প্রমাণ করতে পারেননি। অথচ বিনা অপরাধে হতভাগ্য এই নাগরিকরা জেল খাটছেন, পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে উৎকোচ নিচ্ছে; আদালতে হাজিরা বাবত তারা হয়রানির শিকার হচ্ছে। এই হয়রানি আর্থিক ও দৈহিক।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে সুশাসন সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা দরকার।
সুশাসনের কতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের গ্যারান্টি, সম্পূর্ণ উন্মুক্ত বহুদলীয় সমাজ, আইনের শাসন, সমাজ ও ব্যক্তির জীবন, সম্পদ ও সম্মানের নিরাপত্তা আইনগত ও শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টি, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, স্বচ্ছ, দক্ষ, ফলপ্রসূ এবং জবাবদিহিতাসম্পন্ন জাতীয় সরকার, দুর্নীতি বিরোধী প্রচেষ্টা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং স্বাধীন সংবাদ মাধ্যম শিক্ষা ও পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়ন এবং একটি স্থিতিশীল মুদ্রাবাজার সংরক্ষণ। এই বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে এটা পরিষ্কার যে, অংশীদারিত্ব ভিত্তিক উন্নয়ন, মানবাধিকার, গণতন্ত্রায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সুশাসনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত হলে দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে এবং দ্রব্যমূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বা নাগালের মধ্যে থাকে।

বাংলাদেশের অবস্থা : একটি উন্নয়নকামী দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিস্ফুটন এখনও অবান্তর প্রাপ্তির পর্যায়ে রয়েছে। শাসন পদ্ধতি হিসেবে এখানে গণতন্ত্র এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কিংবা পটভূমি থাকুক বা না থাকুক যাদের অর্থ আছে তারাই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেন। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন একটি ব্যয়বহুল ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সাধারণ মানুষের ভূমিকা এক্ষেত্রে খুবই কম এবং তারা নিছক নিষ্ক্রিয় ভোটার হিসেবে কাজ করে। গত দু’টি জাতীয় নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এতে করে তারা শাসক দলের প্রজায় পরিণত হয়েছে।

ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে রাজধানী এবং স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচিত সংস্থাগুলোর হাতে ক্ষমতা এবং সম্পদের পরিমাণ খুব কম। সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান প্রকট এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধার বেশির ভাগই ধনীরা পায়। নীতি নৈতিকতা ১৯৭২ সাল থেকে লোপ পেতে শুরু করেছে। এর পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসন এখনও সম্ভব হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি খাতে দুর্নীতির বিচরণ অবাধ এবং এর ফলে ২০০০ সাল থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে। উপরোক্ত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গর্বিত কৃতিত্ব রয়েছে। দেশটি ১৯৭১-৭৫ সালের তলাবিহীন ঝুড়ি অভিধা থেকে মুক্ত হয়ে কার্যত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। জনগণের শিক্ষার হার ১৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৬৪%-এ উন্নীত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ ১৯৭১ সালের ৯৫ লাখ টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে সারাদেশে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অপ্রচলিত পণ্যের রফতানির ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।

শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। ৬টি মারাত্মক রোগের প্রতিরোধক টিকা দান এবং পল্লী এলাকায় নিরাপদ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে যথাক্রমে শতকরা ৯৯ এবং শতকরা ৯৭ ভাগ সাফল্য অর্জিত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুবিধা বঞ্চিত শিশু ও মেয়েদের ভর্তির হার উল্লেযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের জাতীয় উৎপাদন তথা জিডিপির প্রবৃদ্ধি হারও। শতকরা বার্ষিক প্রায় ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এগুলো আমাদের সাফল্য এবং গতিশীলতার পরিচায়ক। উপরোক্ত সাফল্য এবং অর্জন সত্ত্বেও আমাদের শাসন ব্যবস্থার এমন কিছু দিক আছে যেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। একটি দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা তার ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনৈতিক দলসমূহ ও সংস্থা এবং পরাশক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সারা বিশ্বে শাসন ব্যবস্থাকে প্রভাবান্বিত করে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। আন্তর্জাতিক সাহায্যে ডিক্টেশন, বহুত্বে বড় ভাইগিরি, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ প্রভৃতি সার্বভৌমত্বকে যেমনি ক্ষুন্ন করে। তেমনি সুশাসনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
দেশ পরিবেশ, পরিস্থিতি মানুষের মেধা মননশীতার ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের পরিবেশ ও মানুষের মননশীলতা, নাগরিক চেতনাবোধ জবাবদিহিতার পদ্ধতি এবং দায়িত্বশীলতার সাথে আমাদের অবস্থার তফাৎ রয়েছে। এই তফাতের কারণে এই দেশগুলোর কোনো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বা আদর্শকে আমাদের সমাজে রোপণ করা যায় না এবং করলেও তার শেকড় গজাতে পারে না। এই সহজ কথাটা না বুঝেই অনেক দেশী-বিদেশী তাত্ত্বিক গণতান্ত্রিক বিকাশের নামে অনেক অবান্তর প্রস্তাব করেন যা বিদ্যমান অবস্থায় এদেশের মাটির জন্য উপযোগী নয়। সুশাসনের অম্বেষায় আমাদের বাস্তবের মুখোমুখি হওয়াটাই বাঞ্চনীয়।

আগেই বলেছি গণতন্ত্র আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। তেমনি রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক ভিতও আমাদের দেশে দুর্বল। অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ভিশন মিশন ও গোল যেমনি নেই তেমনি তাদের নেতা কর্মীদের প্রশিক্ষণ, চরিত্র গঠন অথবা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুশীলনের ব্যবস্থা ও নেই। সরকারি দলে গেলে লাল মোড়া দাবড়ানো এবং বিরোধী দলে গেলে হরতাল অবরোধ, বিক্ষোভ, জ¦ালাও-পোড়াও সংসদ বর্জন কোনো কোনো বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অনেক রাজনৈতিক দল আছে যাদের নেতৃত্বের প্রকৃতি, দলীয় তহবিলের উৎস ও ব্যবহার, গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের মাপকাঠি ও পদ্ধতি সম্পর্কে জনমনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

প্রত্যেকটি দলই নিজেদের গণতান্ত্রিক নীতিমালার অনুসারী বলে দাবি করে। কিন্তু একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য কোনো বৃহত্তম দলের মধ্যে তার অনুশীলন খুব একটা দেখা যায় না। ত্যাগ-তিতিক্ষা বা জ্ঞান অভিজ্ঞতা নয়, সুপ্রিম লিডার নির্বাচনে অনেক দলে উত্তরাধিকারীই প্রধান বিবেচ্য বিষয়ে পরিণত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিই দলের প্রধান নেতায় পরিণত হয় এবং গর্বের সাথে তা বলে বেড়ায়। কোনো বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ বা সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করা কেন্দ্রীয় কমিটি বা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের জন্যও বিরাট একটা ঝুঁকির ব্যাপার। ভুল সিদ্ধান্ত অথবা দল পরিচালনায় ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে কোনো রজনৈতিক দলের প্রধানকে কখনো পদত্যাগ করতে দেখা যায় না। আবার কেউ কেউ আছেন পবিত্র মক্কায় গিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণের ঘোষণা দিয়েও রাজনৈতিক অনাচার অব্যাহত রাখেন। ব্যক্তি পূজা, ব্যক্তি বন্দনা, রাজনৈতিক কালচারে পরিণত হয়েছে।

জীবিত-মৃত নেতারাই অনেক রাজনৈতিক দলের কাছে প্রধান মূলধন। দেশের রাজনীতির সুষ্ঠু বিকাশ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দেশ শাসনের যোগ্যতা অর্জনের পথে এগুলো গুরুত্বপূর্ণ বাধা হিসেবে কাজ করে। দলের ভিতরে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং দল ভাঙা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সুশাসনের জন্য সুসংবাদ প্রয়োজন। আইন প্রণয়ন এবং জাতিকে দিক-দর্শন দেয়া তাদের কাজ। তারা গণতন্ত্রের পাহারাদারও। কিন্তু তারা যখন আইন ভঙ্গ করেন তখন গণতন্ত্র পালানোর পথ পায় না। গত কয়েকটি সংসদের দিকে তাকিয়ে দেখলে মাননীয় এমপিদের কত ভাগ ব্যবসায়ী অথবা রাজনীতিবিদ এবং কত ভাগ খদ্দের তা সহজেই বুঝা যাবে। যারা অর্থ দিয়ে নমিনেশন কিনে পয়সা খরচ করে এমপি হবেন, মুনাফাসহ পুঁজির টাকা উঠাতে যদি তারা চেষ্টা করেন তাহলে তাদের কি দোষ দেয়া যায়? রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে সুশাসনের সমস্যা হয় না।

॥ দুই ॥
সরকারি কাজ কর্মে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য সংসদীয় পদ্ধতিতে স্থায়ী কিমিটি হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। পারস্পারিক অসহযোগিতা ও বিরোধিতার কারণে আমাদের দেশের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটিগুলো কখনো সময় মতো গঠন ও কার্যকর হয় না। যারা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পান না তাদের মধ্যে কোনো কোনো দল শপথ না নেয়ার শপথ করেন। আবার এই শপথ ভেঙে শপথ নিয়ে অধিবেশনে যোগ দেবেন না বলে ঘোষণা দেন।
অধিবেশনে যোগ দিয়ে আবার নানা অজুহাত দেখিয়ে ওয়াক আউট করে বছরের পর বছর সংসদে না গিয়ে বেতন-ভাতাও নেন। সুশাসনের জন্য সরকারের জবাবদিহিতার পাশাপাশি হরতাল অবরোধ, রাজপথে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের জন্য দায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এখন তো বাঁশ ও নেই বাঁশীও নেই। নির্বাচন, নির্বাচিত পার্লামেন্ট এবং বিরোধী দলও নেই। একে একে বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্থাগুলো ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

স্থানীয় উদ্যোগ এর ব্যাপারে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের বহু জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন পুল, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছে। কিন্তু ৮০ ও ৯০ এর দশকে সিভিল সোসাইটির অংশ হিসেবে এখানে হাজার হাজার এনজিও আত্মপ্রকাশ করে। বাহ্যতঃ স্বাস্থ্য সেবা, দারিদ্র্য বিমোচন, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, পরিবেশ উন্নয়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রে সরকারকে সাহায্য করার কথা থাকলেও কার্যত তারা সরকার থেকেও শক্তিশালী সমান্তরাল আরেকটি সরকারে পরিণত হয়। তাদের বিশাল তহবিলের উৎস ও ব্যবহার রহস্যের সৃষ্টি করে। তাদের কেউ কেউ আবার রাজপথে সহিংস আন্দোলনে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলকে সন্ত্রাসী জনশক্তি সরবরাহের ঠিকাদারে পরিণত হয়। ফলে তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব দাতা সংস্থা ও দেশ সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কথা বলেন আবার তারাই আপত্তি তোলেন সরকার এনজিওদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনা।

এনজিওদের মালিক কারা, ব্যক্তি বিশেষ না সমাজ এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। সকলের সহযোগিতা ছাড়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় না। সুশাসনের পার্টনার এখানে সকলেই। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। আমাদের দেশে শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ মুসলিম শাসনামলে সম্পূর্ণ আলাদা ছিল, ব্রিটিশ আমলে শাসন বিভাগের সাথে একত্রিভূত করা হলেও দেওয়ানী আদালত শতকরা ৭৫ ভাগ আলাদা ছিল। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকারী ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারকার্য চালানোর ফলে আপত্তি দেখা দেয়। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরাই এই নিয়মটি চালু করেছেন। ফৌজদারী ও রাজস্ব আদালত ছাড়া থানা থেকে শুরু করে উপরের স্তরের সকল আদালত, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন ও প্রশাসন বিভাগ থেকে আলাদা ছিল। তথাপিও বিচারকার্যে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা এবং নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য পাকিস্তান আমল থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও আলাদা করার জন্য আমরা দাবি করে এসেছি। ১৯৭২ সালে প্রথম যখন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করা হয় অতি সহজে একাজটি তখন করা যেতো। কিন্তু তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তা করেনি। ১৯৯৯ সালে এই দলটির দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারকে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা তারা কার্যকর করেনি।
চারদলীয় জোট সরকার তার ক্ষমতার মেয়াদে তা শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করেননি। কেয়ারটেকার সরকার এই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করেছিলেন, কিন্তু তাও টিকেনি। এখন বিচারকদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, নিরপেক্ষতা, নীতিবোধ ও বিচারিক দক্ষতার সাথে যদি আখেরাতের জবাবদিহিতার ভয় যুক্ত হয় তাহলে আশা করা যায় যে স্বাধীন বিচার বিভাগ সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাইলফলক তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এ কাজটি নিশ্চিত করা না গেলে বিচারের আদালত বিচারের দোকান হয়ে পড়বে এবং বিচারকরা রাজনীতিতে জড়িয়ে প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের প্রতিহিংসার শিকার বানাতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না বলে আমার বিশ্বাস।

https://dailysangram.com/post/522379