১৭ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১২:০৮

নিউ সুপার মার্কেটে আগুন

৬০০০ ব্যবসায়ী, কর্মচারীর কান্না

দোকান নম্বর ৩০৭। মেঘ-বৃষ্টি গার্মেন্টস। দোকানের সামনে বসে আহাজারি করছিলেন আশরাফুল। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা পাচ্ছিলেন না তার সহকর্মীরা। শুধু একটি নয়, তার ৩টি দোকান পুড়ে গেছে। ৩ দোকানে ৭০ লাখ টাকার কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য এখন পুড়ে ছাঁই। ঈদ উপলক্ষে বাড়তি টাকার পণ্য কেনার জন্য তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এখন তিনি নিঃস্ব। শুধু আশরাফুলই নন তার মতো প্রায় ৬০০০ ব্যবসায়ী ও দোকান-কর্মচারী ব্যবসা এবং কর্মস্থল হারিয়ে এখন নিঃস্ব। তাদের বোবা কান্নায় ভারি নিউ মার্কেট এলাকা।
ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটের ৫০০টি দোকান পুড়ে গেছে।

বাকিগুলো আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলোতে আগুন ধরেনি সেগুলো থেকে মালামাল সরিয়ে নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মার্কেটে মোট ১২৭৫টি দোকান। প্রত্যেক দোকানে মালিক ও কর্মচারীসহ গড়ে ৫ জন করে কাজ করতেন। এ হিসেবে ৬ হাজারের বেশি মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে এই অগ্নিকা-ের ঘটনা।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এখন কী করবেন দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা অবিলম্বে সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। বিনা সুদে তারা ব্যাংক ঋণ চেয়েছেন।

এদিকে, ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটকে ২০১৬ সালেই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছিল ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু, মার্কেট কর্তৃপক্ষ ব্যবসার কথা চিন্তা করে সেখান থেকে দোকান সরাননি। এতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কোনো শক্ত উদ্যোগ নিতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের চিন্তা ছিল যে, দোকান থেকে একবার উঠে গেলে তারা আর এখানে ফিরে আসতে পারবেন না। এই শংকা থেকে তারা অন্য কোনো স্থানে যাননি।

এইদিকে ঈদ উপলক্ষে নিউমার্কেট ও তার আশপাশের মার্কেটগুলো চালু করা হয়েছে। মার্কেট ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তৎপর থাকতে দেখা গেছে।

দোকান মালিক ও কর্মচারীরা জানান, ঈদ উপলক্ষে নতুন পোশাক তোলেন ব্যবসায়ীরা। শুধু ঈদের ব্যস্ততা সামাল দিতে অতিরিক্ত কর্মচারী-বিক্রয়কর্মী নিয়োগ দেন তারা। চাঁদরাত পর্যন্ত চলে ব্যস্ততা। ভালো ব্যবসা হলে মালিকদের পক্ষ থেকে কর্মচারীদের বেতনের পাশাপাশি বাড়তি বোনাসও দেয়া হয়। আগুনে ব্যবসায়ীরা যেমন নিজদের সম্বল হারিয়েছেন তেমনি দোকান-কর্মচারীরা তাদের কর্মস্থল হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছেন। দোকান পুড়ে যাওয়ায় তারা এখন বেতন বোনাস পাবেন কোথা থেকে?

গতকাল সকালে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, বিষন্ন মনে ব্যবসায়ীরা তাদের দোকান থেকে পোড়া জিনিসপত্র সরাচ্ছিলেন। কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে যারা মার্কেট পরিদর্শন করতে গিয়েছেন তাদের কাছেই তারা দাবি করেছেন যে, যাতে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ঈদের বেচাকেনা যখন পুরোদমে জমে উঠেছে ঠিক তখনই আগুনে ছাই হয়ে গেছে তাদের দোকান। এসব দোকানে কাজ করা কয়েক হাজার কর্মচারী এখন কর্মহীন। তারাও মালিকের সঙ্গে ক্ষতির মুখে পড়েছেন। আগুনে ৬ হাজার ব্যবসায়ী ও কর্মচারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মার্কেটের ৩ তলায় থাকা দোকানের মালিক সুমন জানান, বছরের বড় অঙ্কের ব্যবসা হয় ঈদে। কেউ কেউ বাড়তি পণ্য কিনেন বেশি বিক্রয় করার জন্য। কেউ ব্যাংক ঋণ করেছেন। আগুনে সব গেছে।

শাহ আলম নামে আরেক দোকানের মালিক জানান, দোকানের কর্মচারীরা বেচাকেনা করেন। সামনে ঈদ। তাদের বেতন-বোনাস দিতে পারবো না। কারণ আগুনে সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। তার দোকানে নগদ টাকাও পুড়েছে।

মার্কেটের কর্মচারী শহীদ জানান, মালিকের কান্না দেখে আমি বোবা হয়ে গেছি। আমারও পরিবার আছে। বেতন-বোনাস না পেলে পরিবারের ঈদ কীভাবে হবে। এক আগুনে মালিক নিঃস্ব হয়ে গেছেন। আমরাও অসহায় হয়ে পড়েছি।

এদিকে, পুরোপুরি অপসারণ না হওয়ায় রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেটের মধ্যবর্তী ফুট ওভারব্রিজ দিয়ে পথচারী পারাপার অব্যাহত রয়েছে।

গতকাল দুপুরে গাউছিয়া ও নিউমার্কেটের উভয় প্রান্তে ফুট ওভারব্রিজের সিঁড়ি ভাঙা অবস্থায় দেখা গেছে। ফলে রাস্তা পারাপারে পথচারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে ওভারব্রিজের উপরে ও নিচের ফুটপাথে হকারদের পোশাক বিক্রি করতে দেখা গেছে।
জাহাঙ্গীর নামে এক পথচারী বলেন, অন্য ফুট ওভারব্রিজ অনেক দূরে হওয়ায় গাউছিয়া প্রান্ত থেকে এই ফুট ওভারব্রিজে উঠলাম। এইখানেও ভাঙা, উঠতে ও নামতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এর আগে ফুট ওভারব্রিজটিতে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছিল। তারপরও মানুষকে এটি ব্যবহার করতে দেখা যায়।

এদিকে, রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেটের আগুনের ঘটনাকে নাশকতা বলে সরকার জনগণের সঙ্গে মশকরা করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। গতকাল দুপুরে রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের তিনি এ মন্তব্য করেন। জিএম কাদের বলেন, যেসব ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সহযোগিতা করার জন্য দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। পাশাপাশি এই আগুনের ঘটনা কেন বারবার ঘটছে তা খুঁজে বের করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

ঢাকা নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. মারুফ হোসেন জানান, তারা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণের দাবি করেছেন। পাশাপাশি দ্রুত যাতে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় ফিরতে পারেন তারও তিনি দাবি জানান। শামসুল নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, তাদের দোকানের কোনো ইন্স্যুরেন্স করা ছিল না। এতে তারা কোনো ক্ষতিপূরণ পাবেন না।

 

https://mzamin.com/news.php?news=51629