১৭ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১২:০৬

লোডশেডিংয়ে কাবু জীবন

বেড়েই চলেছে প্রচণ্ড গরম। অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। এমনিতেই তীব্র তাপদাহে মানুষ হাঁসফাঁস করছে। এর মধ্যে নতুন করে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে গতকাল দেশে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

গ্রীষ্মের তীব্র তাপদাহে গত কয়েক দিন ধরে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে শহর ও গ্রামে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েই চলেছে। বাড়তি চাহিদা পূরণ করতে পারছে না বিতরণ কোম্পানিগুলো। এরমধ্যে প্রতিটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের ফিডার এখন লোডশেডিংয়ের জন্য শাটডাউন রাখা হচ্ছে।

দেশে একের পর এক রেকর্ড গড়ছে রাজধানীর তাপমাত্রা। রোববার ঢাকায় গত ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দুপুর ১টা পর্যন্ত ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ১৯৬৫ সালে রাজধানীবাসী সবচেয়ে উত্তপ্ত দিন পার করেছিল। তখন ঢাকার তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তাপ প্রবাহের বর্তমান পরিস্থিতি আরও তিন দিন চলবে, এরপরে তীব্রতা কমবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, আগামী ১৯ তারিখের পর দেশের পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া সারা দেশে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে ২৩ তারিখের পর।

অন্যদিকে গরমের কারণে বেড়ে গেছে বিদ্যুতের চাহিদা। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারার কারণে শহর থেকে গ্রামে সর্বত্র শুরু হয়েছে লোডশেডিং। অসহনীয় লোডশেডিংয়ের কথা বলতে গিয়ে পুরান ঢাকার বাড্ডানগর লেনের বাসিন্দা হান্নান মিয়া মানবজমিনকে বলেন, কয়েকদিন ধরে তীব্র তাপদাহ। অন্যদিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং। গতকাল দুপুরে প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও দুপুর ১টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা লোডশেডিং করেছে ডিপিডিসি। ভৈরবের বাসিন্দা রুনা বিবি জানান, গত কয়েকদিন ধরেই দিনে এবং সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ আসা- যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। আসছে প্রায় এক ঘণ্টা পর। এই ঘটনা একবার নয়। সন্ধ্যার পর কয়েকবার আধা ঘণ্টা করেও বিদ্যুৎ চলে যায়। খুলনা থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, অস্বস্তিকর গরমের মধ্যে শুরু হয়েছে দফায় দফায় লোডশেডিং। দুপুর, সন্ধ্যা, গভীর রাত কিংবা ভোর কোনো নিয়মই মানছে না বিদ্যুতের লুকোচুরি। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দফায় দফায় লোডশেডিংয়ে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে খুলনার জনজীবন। এদিকে তীব্র তাপদাহে শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা-ভ্যানচালকরা অস্থির হয়ে পড়েছেন। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে কৃষক ও খেটে খাওয়া মানুষেরা। শহরের বেশ কিছু সড়কের পিচ গলে যেতে দেখা গেছে। শুক্রবার খুলনায় মওসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তীব্র গরমের মধ্যে বাতাসের আর্দ্রতা কমে গেছে। নগরীর শেখপাড়া এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ হোসেন জানান, শনিবার সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ চলে যায়। তারাবির নামাজের সময় আরেক দফা গিয়েছে। রাত ২টা ২১ মিনিটে লোডশেডিং শুরু হয়ে ছিল এক ঘণ্টা। আবার ভোর সাড়ে ৫টায় লোডশেডিং শুরু হয়। এবারও বিদ্যুৎ ছিল না এক ঘণ্টা। তিনি বলেন, প্রচণ্ড গরমে ফ্যান চালিয়েও ঘরে থাকা যায় না। ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো’র) প্রধান প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রচণ্ড গরমে বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। লোড বেড়ে যাওয়ায় ট্রান্সফর্মারসহ লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এসব মেরামতে সময় লাগছে। এ ছাড়া সরবরাহ কম থাকায় কিছু লোডশেডিং হচ্ছে। তবে পরিমাণে কম।

এদিকে, ঢাকার দুই বিতরণ কর্তৃপক্ষের মধ্যে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি) জানায়, তারা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ দিচ্ছে। তবে কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে লাইন ও ট্রান্সফরমার সমস্যার কারণে। অন্যদিকে, ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো) জানায়, গতকাল রামপুরার লাইনের সমস্যার কারণে ২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হয়েছে। ডেসকো’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী মানবজমিনকে বলেন, গরমের কারণে বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। ডেসকো’র অধীন এলাকায় চাহিদা ছিল ১২৮০ মেগাওয়াট। এরমধ্যে লাইনের সমস্যার কারণে কিছু সময়ের জন্য ২০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

পিডিবি’র দাবি, গতকাল সন্ধ্যায় সারা দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। এই সময়ে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন হয় ১৪ হাজার ৯৯৯ মেগাওয়াট। ফলে ৯২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোডশেডিং করতে হয়েছে। সর্বনিম্ন উৎপাদন হয় ১২ হাজার ১০ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, ঢাকায় মোট বিদ্যুতের চাহিদা ৪ হাজার ৮৬৯ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে গতকাল লোডশেডিং করা হয়েছে ১৮০ মেগাওয়াট। চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয়েছে ১২৫ মেগাওয়াট। খুলনায় ১ হাজার ৭৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং করা হয়েছে ১৫০ মেগাওয়াট। রাজশাহীতে ১ হাজার ৫৬৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয়েছে ১৩৫ মেগাওয়াট। কুমিল্লায় ১ হাজার ৩৩৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয়েছে ১১০ মেগাওয়াট। ময়মনসিংহে ১ হাজার ১০১ মেগাওয়াটের বিপরীতে লোডশেডিং হয়েছে ১১২ মেগাওয়াট। সিলেটে ৪৯৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। এখানে লোডশেডিং হয়েছে ৪০ মেগাওয়াট। বরিশালে ৪০১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। রংপুরে ৮৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে লোডশেডিং হয়েছে ৭০ মেগাওয়াট।

বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৪৮ লাখ। বিতরণ লাইন রয়েছে ৬ লাখ ২৯ হাজার কিলোমিটার। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০০ ভাগ। সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ রয়েছে।

https://mzamin.com/news.php?news=51628