১৭ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১১:৫৪

ব্যবসায়ীদের চোখে ঘোর অন্ধকার

ঈদের অগেই মার্কেট খুলতে চান তারা

বঙ্গবাজারের পর রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির শিকার ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। গত দুই দিন তারা এক কঠিন সময় পার করেন। অগ্নিকাণ্ডের ২৭ ঘণ্টা পর আগুন সম্পূর্ণভাবে নির্বাপণ হলেও ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়নি। ঈদের আগেই তারা যেন পুরোদমে ব্যবসা চালু করতে পারেন, সেজন্য সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামনা করছেন।

এদিকে একদিন বন্ধ থাকার পর নিউমার্কেট এবং এর আশপাশের সব দোকান খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে রোববার এসব মার্কেটে খুব একটা বেচাকেনা হয়নি। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগুন আতঙ্কের কারণে ক্রেতারা মার্কেটে আসছেন না। তবে তাদের আশা, শিগগিরই আতঙ্ক কাটিয়ে ক্রেতারা মার্কেটে আসবেন। আবারও সরগরম হবে নিউমার্কেটের নিউ সুপার মার্কেটসহ ওই এলাকার ব্যবসায়িক কার্যক্রম। ঈদের বেচাকেনা যখন পুরোদমে জমে উঠেছিল, ঠিক তখন আগুনে ছাই হয়ে যায় নিউ সুপার মার্কেটের প্রায় ৬০০ দোকান। এসব দোকানে কাজ করা কয়েক হাজার কর্মচারী এখন কর্মহীন।

এদিকে শনিবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিটের সাড়ে তিন ঘণ্টার চেষ্টায় এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে রোববার সকাল ৯টায় আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ ঘোষণা করা হয়। এরপরই শুরু হয় মার্কেট পরিষ্কারের কাজ। এদিন সরেজমিন মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, সিটি করপোরেশন ও মার্কেট কর্মীরা মিলে আগুনে পোড়া বর্জ্য পরিষ্কারের কাজ করছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে ভোরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, শেষরাতে কেন বারবার আগুন লাগছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে? রোববার তেজগাঁও বাজার কলোনির নিম্ন-আয়ের মানুষের মধ্যে ইফতার ও ঈদসামগ্রী বিতরণ শেষে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোনো না কোনো কারণ থাকে। ইলেকট্রিক সমস্যা, শর্ট সার্কিট কিংবা নাশকতাও থাকে। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত না। আমাদের সবার মনে প্রশ্ন, ঘনঘন আর শেষরাতেই কেন আগুন লাগছে।’ পরপর আগুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, তদন্ত করে সুনিশ্চিত হওয়া ছাড়া এ বিষয়ে বলা যাবে না। বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ১১ দিনের মাথায় নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় ছয় শতাধিক দোকান। মার্কেট বণিক সমিতি বলছে, আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহৃত পানিতে আরও একশ দোকানের মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিন তলা ওই মার্কেটে দোকান ছিল সব মিলিয়ে প্রায় ১৩শ। এদিকে নিউমার্কেটের নিউ সুপার মার্কেট ছাড়া সব মার্কেটই রোববার খুলে দেওয়া হয়। খুলে দেওয়া হয়েছে চাঁদনী চক এবং গাউছিয়াসহ পার্শ্ববর্তী মার্কেটগুলোও।

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বলেন, রোববার সকাল ৯টায় আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা হয়। এরপর পুলিশের কাছে ভবন বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর কোনো আগুনের আলামত ভবনে নেই। তিনি বলেন, ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলার বেশির ভাগ দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আরও জানান, আগুনে ফায়ার সার্ভিসের ২৪ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন। তাদের বেশির ভাগের শ্বাসনালিতে সমস্যা হয়েছে।

রোববার দুপুরে কামরুল হাসান নামের এক ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, নিউ সুপার মার্কেটে আমাদের তিনটি দোকান ছিল। এর মধ্যে দুটি দোকান পুড়ে গেছে। একটি দোকানের মালামাল বের করতে পেরেছি। ঈদের আগেই আবার ব্যবসা শুরু করতে চাই। এ কারণেই দোকান পরিচ্ছন্নের কাজ করছি। পুড়ে যাওয়া মালামাল এবং ধ্বংসাবশেষ সরাতে ২-১ দিন সময় লাগবে বলে তিনি জানান। নতুন করে ব্যবসা শুরুর প্রত্যাশা ব্যক্ত করে ইয়াসিন আরাফাত নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ঈদের আগে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমরা চাই, ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের যেন সহযোগিতা করা হয়।

এদিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিটের পরিদর্শক মোর্তুজা কবিরের নেতৃত্বে একটি দল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। শাহজাহান সাংবাদিকদের আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন পোড়া অংশ আলামত হিসাবে সংগ্রহ করেছি। এগুলো সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। তারপর এ বিষয়ে মতামত দেওয়া যাবে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী শাহ আলম বলেন, অগ্নিকাণ্ডে মালিকরা একেবারে নিঃস্ব। সকাল ৬টায় আগুনের খবর পেয়ে আমরা এসে দেখি পুরো দোকানে আগুন। একটা মালও বের করতে পারিনি। দোকানে ৫ লাখ টাকা ক্যাশ ছিল। পুরো টাকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। দ্রুত সময়ে মার্কেট সংস্কার করে ব্যবসায়িক পরিবেশ ফিরিয়ে দিলে সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। তিনি বলেন, ১০ লাখ টাকার মালামাল ছিল, এর মধ্যে ৬ লাখ টাকা ঋণ। আমি আগে একটা দোকানে চাকরি করতাম। ঋণ করে এখন একটি দোকানের একপাশ কিনেছি। এই ক্ষতি কীভাবে পোষাব, এটা একমাত্র আল্লাহ ভালো জানেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অগ্নিকাণ্ডের শিকার নিউ সুপার মার্কেটসংলগ্ন সেই ভাঙা ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলাচল করছেন পথচারীরা। ব্রিজের দুই পাশের ওঠানামার সিঁড়ি সিটি করপোরেশন ভেঙে দিলেও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ব্রিজটি ব্যবহার করছেন পথচারীরা। ঈদ উপলক্ষ্যে নিউমার্কেটসহ আশপাশের মার্কেটে বাড়ছে জনসমাগম। এতে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভারব্রিজটিতে বাড়ছে চাপ। এ অবস্থায় ঝুঁকিপূর্ণ সিঁড়িটি দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে শিশু, নারী ও বৃদ্ধরা।
জমি বিক্রি করে ১১ লাখ টাকা দিয়ে চার মাস আগে দোকান নেন মো. সজীব। ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয়তলার ২৩০ নম্বর দোকান ছিল তার। পুড়ে যাওয়া মার্কেট দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সজীব বলেন, ‘শুক্রবার রাতে দোকানদারি করে গেছি। এর আগে তেমন বেচাকেনা ছিল না। শুক্রবারই বেশি বেচাকেনাটা শুরু হয়েছে। শুক্রবার বেচাকেনা সাইরা রাত ৪টায় বাসায় গেছি। সকালে ফোন দিছে যে তোগো মার্কেট পুইড়া গেছে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ ও ২০১৬ সালে দুই দফায় নিউ সুপার মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সিটি করপোরেশন। কিন্তু প্রভাবশালীদের বাধার কারণে তখন মার্কেট খালি করা যায়নি। ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশেই ব্যবসা পরিচালনা করছিলেন ব্যবসায়ীরা। তেতলা মার্কেটটির ছাদ ও চারপাশের দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে পলেস্তারা আগে থেকেই খসে পড়ছে। পিলারে ধরেছিল বড় বড় ফাটল। তাই যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা করছিল ডিএসসিসি।

তদন্ত কমিটি গঠন : নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে নয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। করপোরেশনের সচিব আকরামুজ্জামানের সই করা দপ্তর আদেশের মাধ্যমে রোববার এ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ডিএসসিসি অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীনকে আহ্বায়ক এবং প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীনকে সদস্য সচিব করে এ কমিটি গঠন করা হয়।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/666177