১৭ এপ্রিল ২০২৩, সোমবার, ১১:৪৬

ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক

সাধারণত ঈদুল ফিতরের আগেই বেচাকেনা করে থাকেন কাপড়ের মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। বিগত দুই বছরে ব্যবসায়ীরা ভালো বিক্রি করতে পারেননি। বিশেষ করে করোনার বছর ব্যবসা একেবারেই বন্ধ ছিল। পরের বছরও সে ধকল কাটিয়ে ওঠতে পরেনি। এ বছর বুকভরা আশা নিয়ে দোকানে লাখ লাখ টাকার মাল উঠিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। ঈদের আগেই বড় বড় কয়েকটি পাইকারি মার্কেট রহস্যজনক আগুন লাগে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় কয়েকশ দোকান। নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন কয়েক হাজার ব্যাবসায়ী-দোকানি। ঈদের আনন্দতো নেই- নিঃশেষ হয়ে গেছে সারাজীবনের পুঁজি। এখন তারা কোথায় যাবেন, কী করবেন কিছুই বুঁঝে উঠতে পারছেন না। কর্মচারীদের বেন নেই, মালিকের ব্যবসা নেই। মুহূর্তেই চোখের সামনে সব শেষ।

দেশের সর্ববৃহৎ কাপড়ের মার্কেট বঙ্গ বাজার ও পাশের আরও চারটি মার্কেট পুড়ে ভস্মীভূত। বঙ্গবাজারের কোনো অস্তিত্ব নেই। এর রেসে না কাটতেই মাত্র ১১ দিনের মাথায় শনিবার নিউ মার্কেট এলাকার ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লাগে। দু’টি আগুনের ঘটনায়ই যেনো একই সময়ে ঘেটেছে। এ বিপণিবিতানের তৃতীয় তলায় শনিবার ভোরে আগুনের সূত্রপাত হয়। ফায়ার সার্ভিসের ৩০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। ভয়াবহ আগুনে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের কয়েকশ দোকান পুড়ে গেছে। বেশির ভাগই কাপড়ের দোকান। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকার মতো হবে বলে প্রাথমিকভাবে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। অগ্নিকাণ্ডে কেউ মারা না গেলেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২৪ কর্মীসহ অর্ধশত আহত হয়েছেন। গত ৪ এপ্রিল আগুন লাগে বঙ্গবাজারের কয়েককটি মার্কেটে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে বঙ্গবাজারের ২ হাজার ৯৬১টি দোকান পুড়ে গেছে। এ ছাড়া মহানগর মার্কেটের ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের ৫৯টি এবং বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের ৩৪টি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ৩০৩ কোটি টাকা। এরআগে সিদ্দিকবাজারে ভবনে আগুন লাগে। সায়েন্স ল্যাবে বিস্ফোরণ ঘটে।

এসব আগুন নাশকতা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলছেন ব্যবসায়ীরা। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকেও প্রশ্ন উঠছে। ব্যবসায়ী নেতারা বড়বড় মার্কেটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও আগুনের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তিনি বলেছেন, মার্কেটে শেষ রাতের দিকে আগুন কেন? তবে তদন্ত শেষে নিশ্চিত না হয়ে নাশকতার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। গতকাল রোববার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কলোনি বাজারে জনসাধারণের মাঝে ঈদসামগ্রী বিতরণ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পেছনে একটি কারণ থাকে। সেই কারণ হতে পারে ইলেকট্রিক শর্ট সার্কিট থেকে আবার নাশকতাও হতে পারে। নিউ সুপার মার্কেটে লাগা আগুন নাশকতা কি-না তা এখনও আমরা নিশ্চিত নই জানিয়ে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা তদন্ত করছি।’ মন্ত্রী বলেন, আমাদের সবার কাছে একটি প্রশ্ন জাগছে- কেন এত ঘন ঘন এবং শেষ রাতের দিকে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে, এ প্রশ্ন সবার।

এদিকে ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটসহ সাম্প্রতিক সময়ের সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে ‘রহস্যজনক’ বলছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ঈদের আগে বঙ্গবাজারে স্মরণকালের ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তীতে বৃহস্পতিবার নবাবপুর মার্কেটে আগুন লাগার কয়েকদিনের মধ্যে এই নিউ সুপার মার্কেটে আগুনের ঘটনা ‘খুবই রহস্যজনক’। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনাগুলো খুবই রহস্যজনক। ইতোমধ্যে ব্যবসায়ীসহ জনসাধারণের মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। পুনরাবৃত্তির কারণে এসব অগ্নিকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব। অগ্নিকাণ্ডের এসব ঘটনা নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মইন উদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নাশকতার সন্দেহ পোষণ করছেন। সেই সঙ্গে এর সঙ্গে বিএনপির যোগসূত্র রয়েছে কি না, তাও খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন।

অন্যদিকে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। ঈদের আগ মুহূর্তে এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। বারবার এসব ঘটনার পেছনে কোনো নাশকতা রয়েছে কি না তা গোয়েন্দা সংস্থাকে খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, আমরা আপনাদের জন্য ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি। একের পর এক ঘটনা ঘটছে। আমি গোয়েন্দা সংস্থাকে আহ্বান করবো কোনো নাশকতা রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য। তিনি বলেন, নিউমার্কেটের তিন তলায় আগুন লেগেছে। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, ঢাকা ওয়াসার পানিবাহিত গাড়িসহ বিজিবির সদস্যরা কাজ করছে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। তিনি আরও বলেন, এখানে আগুন কেন লেগেছে তা আমরা এখনও জানি না। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছি কিন্তু নির্বাপণ করতে পারিনি। জনসমাগমের জন্য আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।

ব্যবসায়ীরা জানান, রোজার ঈদের আগে নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা নতুন পণ্য তুলেছিলেন দোকানে। আগুন লাগার পর এখন তাদের ব্যবসায়ীদের হাহাকার করছেন। নিউ সুপার মার্কেটের তিনতলায় যখন জ্বলছে দোকান; সড়কের উপর তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী। আগুনের খবর পেয়েই যেসব দোকানি আসতে পেরেছেন, তাদের মরিয়া হয়ে ঈদের আগে দোকানে তোলা কাপড় সরাতে দেখা গেছে। তবে সবাই যে খুব বেশি রক্ষা করতে পেরেছেন আগুনের পর ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়া বিপণি বিতানের চিত্র দেখেই বোঝা যায়। মধ্যবয়সী আব্দুর রব মুন্সীকে টেনে ধরেও শান্ত করতে পারছিলেন না তার দোকানের কর্মচারীরা; প্রচণ্ড গরমে ঘেমে আর পানিতে ভিজে একাকার হয়েছেন, খুলে ফেলতে হয়েছে পরনের জামাটাও। ঈদ সামনে এই ব্যবসায়ী নতুন পোশাক তুলেছিলেন নিউ সুপার মার্কেটের দক্ষিণ ভবনের দোতালায় নিজের ‘জিহান খাদি ঘর’ নামের দোকানে। আগুনে সেসব পুড়ে তার চোখের সামনে ছাই হয়েছে। ধোঁয়ার কু-লীর মধ্যেই কয়েকটি বস্তা বের করতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু ঈদ সামনে এভাবে দোকান পুড়ে যাওয়ায় তার আহাজারি থামছিল না। নিউ সুপার মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর দোকানিরা তিনতলায় যান মালামাল বের করতে; কিন্তু হঠাৎ আগুন বেড়ে গেলে মই বেয়ে নামার চেষ্টায় দোকানিরা। ।

ঢাকার ব্যস্ততম বিপণি কেন্দ্র নিউ মার্কেট এলাকার ওভারব্রিজ সংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটে একেকটি দোকানের স্বত্ব (পজেশন) বিক্রি হয় প্রায় কোটি টাকায়। একেকটি দোকানের ভেতরে দুটি থেকে তিনটি পর্যন্ত পৃথক দোকান রয়েছে। দোকানের একপাশে একজন প্যান্ট বিক্রি করছে তো আরেক পাশে পাঞ্জাবি। বিক্রিও ভালো, মাস শেষে লাভও ভালো। নিউ সুপার মার্কেট বণিক সমিতির আহ্বায়ক মারুফ হাসান বলেন, এ মার্কেটে এক হাজার ৩০০ দোকান রয়েছে। এর মধ্যে আগুনে প্রায় ৬০০ দোকান পুড়ে গেছে। আগুনের তাপ ও আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহৃত পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও একশ দোকানের মালামাল। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ঈদের আগে বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেটের আগুনের ঘটনায় সারা দেশের ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সারাদিনই সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড় থেকে নীলক্ষেত মোড় পর্যন্ত বিপণি বিতানগুলো বন্ধ ছিল। এখানে নিউমার্কেট, চন্দ্রিমা, গাউছিয়া, নূরজাহান মার্কেট, গ্লোব, ধানমণ্ডি হকার্সসহ অনেকগুলো বিপণিবিতান রয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকেই শুধু ঈদ বাজারের ভিড় শুরু হয়েছিল। দুদিনের মাথাতেই শনিবারের এ ঘটনায় তারা ঈদ বাজার নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন। সোহাগ নামে নিউ সুপার মার্কেটের এক প্যান্ট বিক্রেতা জানান, ঈদ উপলক্ষে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ করে মাল তুলেছিলেন। দুদিনে কিছু বিক্রি করেছেন। বাকি কিছু ভেজা অবস্থায় উদ্ধার করতে পেরেছেন। বেশির ভাগটাই আগুনে ছাই। পাশের চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মনজুর আহমেদ বলেন, এ এলাকার মার্কেটগুলোতে অন্তত পাঁচ হাজার দোকান আছে। আগুনে যারা পুড়েছে তাদের ক্ষতিতো হয়েছেই বাকিদেরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। দোকান খুলতে যত দেরি হবে, ক্ষতির পরিমাণ তত বাড়বে। নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলেন, রোজার শেষ ১০ দিনে সবচেয়ে ভালো বেচাকেনা হয়। এসময় তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ঋণ করে মাল তোলেন। পণ্যের সঙ্গে আগের রাতের বিক্রি করা ক্যাশও গেছে অনেকের। ঈদের বাজারে বেচাকেনা হয় ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত। অনেক রাত অবধি বেচাকেনা চলে। যে কারণে সবাই রাতে ক্যাশের টাকা স্থানান্তর করেন না। ঈদের আগে এ এক বিরাট দুর্যোগ।

https://dailysangram.com/post/522323