১৬ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৪২

তীব্র তাপদাহের দুর্যোগ

কড়া সুর্যের তেজে রোদের আগুন ঝলসে পড়ছে চারদিকে। মেঘের ছায়া বৃষ্টির একটু শীতল ফোঁটা নেই। টানা তাপপ্রবাহ মাঝারি থেকে তীব্র, তীব্র থেকে আরও তীব্রতর হচ্ছে। ভয়াল দুর্যোগ পরিস্থিতির রূপ নিয়েছে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে চলমান তাপদাহ। তীব্র গরমে-ঘামে হাঁপাচ্ছে মানুষ। সারা দেশে থমকে গেছে স্বাভাবিক জনজীবন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তেমন কেউ ঘরের বাইরে যাচ্ছেন না। রাস্তাঘাট সড়কে পিচ গলছে। বৃষ্টির জন্য মসজিদে মসজিদে ঘরে ঘরে আল্লাহর দরবারে মানুষ আকুল হয়ে ফরিয়াদ করছেন।

গেল শুক্রবার পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ-১৪৩০ বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছে তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়েই। এখন দেশের ৬৪ জেলাতেই তাপপ্রবাহ বিস্তৃত হয়েছে। যা স্মরণকালের মধ্যে নজিরবিহীন। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানী ঢাকায় তীব্র তাপপ্রবাহে পারদ উঠেছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গত ৫৮ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড। গতকাল দুপুরবেলা রাজধানী ঢাকায় ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত তাপানুভূতি ছিল ৪৬ ডিগ্রি! অবিরাম তাপদাহে উত্তপ্ত কড়াইয়ে পরিণত হয়েছে উপচেপড়া জনসংখ্যার অপরিকল্পিত ঢাকা মহানগরী।

ঢাকায় ২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিলেও তাপমাত্রা একই (৪০.২ ডিগ্রি) অবস্থানে ছিল। ১৯৬৫ সালে ৪২ ডিগ্রি সে. সর্বোচ্চ রেকর্ড করা হয়। গতকাল দেশে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড করা হয় দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা চুয়াডাঙ্গায় ৪২.২ ডিগ্রি সে.। আগের দিন সেখানে পারদ ছিল ৪১.৭ ডিগ্রিতে। চুয়াডাঙ্গায় গতকালসহ টানা ১৪ দিন যাবৎ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চলমান তাপদাহ পরিস্থিতি আরও অন্তত ৫ দিন অব্যাহত থাকতে পারে। আবহাওয়া বিভাগ জানায়, সমগ্র খুলনা বিভাগজুড়ে এবং ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা ও পটুয়াখালী জেলাসমূহের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের অবশিষ্ট অঞ্চলের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। দিনের তাপমাত্রার সাথে রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পরদও ঊর্ধ্বমুখী রয়েছে। এরফলে গরমের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা মৌসুমের এ সময়ের স্বাভাবিকের চেয়ে স্থানভেদে ২ থেকে ৫ বা ৬ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত বেশি রয়েছে।

দেশজুড়ে টানা অসহ্য গরমে-ঘামে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পেটের পীড়া, জ্বর-সর্দি-কাশি, চর্মরোগ, গলাব্যাথা, শ^াসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগব্যাধিতে প্রত্যেক ঘরে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অসংখ্য মানুষ হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছে। হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডাক্তারের চেম্বারে দিন-রাত রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। তীব্র গরমের সাথে রাস্তাঘাট, সড়কে বায়ুদূষণ ও ধোঁয়াদূষণ বেড়ে গিয়ে মানুষের চলাচলে, রোগ-দুর্ভোগ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তাপদাহের কষ্টের সাথে যোগ হয়েছে বিদ্যুতের লোডশেডিং, বিভ্রাট এবং পানির সঙ্কট। বেড়েছে রোজাদারদের কষ্ট-দুর্ভোগ।

সমগ্র দেশে বিরাজমান বৈরী আবহাওয়ায় তীর্যক রোদের দহনে পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে ফল-ফসল, ক্ষেত-খামার, জীববৈচিত্র্য-প্রকৃতিরাজ্য। আম, লিচুর গুটি, কাঁঠালের মোছাসহ মৌসুমী ফলমূলের গুটি তীব্র রোদে শুকিয়ে ঝরে যাচ্ছে। নদী, খাল, পুকুর-দীঘিসহ পানির উৎসগুলো শুকিয়ে তলানিতে ঠেকেছে। মাঠের ফসল, বাগান মাঠেই শুকিয়ে যাচ্ছে।

পানির অভাব পূরণের জন্য কৃষক কৃত্রিম সেচের খরচ মেটাতে পারছে না। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বা স্টক ক্রমাগত নিচের দিকে নেমে যাওয়ার ফলে সেচের পানিও মিলছে না। সর্বত্র দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট। অবিরাম তাপদাহের কারণে রিকশা, ভ্যান ও ঠেলাচালক, কুলি, দিনমজুর, হতদরিদ্র, নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট বেড়েছে। আয়-রোজগার কমে গেছে।

এদিকে আবহাওয়া বিভাগ ও বৈশি^ক আবহাওয়া-জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস মতে, দেশে চলমান তাপপ্রবাহের দুর্যোগ আগামী ১৯ বা ২০ এপ্রিল পর্যন্ত আরও অন্তত ৪ থেকে ৫ দিন চলতে পারে। এ সময়ে রাজশাহী, খুলনা বিভাগে দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৩, এমনকি ৪৪ ডিগ্রিতেও পৌঁছাতে পারে। এরপর আগামী ২১ এপ্রিল (পবিত্র জুমাতুল বিদা) থেকে মেঘ-বৃষ্টি-শিলাবৃষ্টি, দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার সাথে সাথে আবহাওয়ায় পরিবর্তনে স্বস্তির আভাস দেয়া হয়েছে। মেঘ-বৃষ্টি ও দমকা বাতাসের ঘনঘটা শুরু হলে গরমের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে যাবে।

পূবালী বায়ুর সাথে পশ্চিমা বায়ুর সংযোগ হলে মেঘ-বৃষ্টির ঘনঘটা তৈরি হবে। তাছাড়া বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর থেকে বাংলাদেশ এবং আশপাশ অঞ্চল অভিমুখে জলীয়বাষ্প তেমন পর্যাপ্ত হারে এখনও আসেনি। সবকিছুই নির্ভর করছে আবহাওয়ার মতিগতির উপর। তীব্রভাবে পড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব।

চুয়াডাঙ্গায় ৪২.২, ঢাকায় ৪০.৪ ডিগ্রি
দেশে চলমান তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। গতকাল সন্ধ্যায় আবহাওয়া বিভাগ জানায়, দেশের চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়ে রেকর্ড করা হয়েছে ৪২.২ ডিগ্রি সে.। ঢাকায়ও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা আরো বেড়ে হয়েছে ৪০.৪ এবং সর্বনি¤œ তাপমাত্রাও আরো বেড়ে হয়েছে ২৭.৯ ডিগ্রি সে.। আগের দুই দিনে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৪০.২ এবং ৩৯.৫ ডিগ্রি।

তাছাড়া ফরিদপুরে ৪১.৩, পাবনায় ৪১.২, যশোর ও কুষ্টিয়ায় ৪০.৮, মোংলায় ৪০, রাজশাহীতে ৩৯.৫, সাতক্ষীরা ও বান্দরবানে ৩৯.৪ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত মাঝামাঝি তাপমাত্রাকে ‘মৃদু’, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রির মাঝামাঝি তাপমাত্রাকে ‘মাঝারি’ এবং ৪০ ডিগ্রি থেকে তদুর্ধ্বে তাপমাত্রাকে ‘তীব্র’ তাপপ্রবাহ হিসেবে গণ্য করা হয়।

আজ রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়া পূর্বাভাসে আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান জানান, আকাশ অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলাসহ সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে। ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া জেলাসমূহের উপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দেশের অবশিষ্টাংশের উপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে।

সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় আবহাওয়ার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। এরপরের ৫ দিনের শেষের দিকে বৃষ্টি, বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে।

https://dailyinqilab.com/national/article/569029