১৬ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৪০

ভোরে আগুনের হানা, নানা প্রশ্ন

নিউ সুপার মার্কেটে আগুনে পুড়ে ছাই পারিবারিক ব্যবসা। কান্নায় ভেঙে পড়লেন নারী। ছবি: জীবন আহমেদ
বঙ্গবাজার থেকে নিউ সুপার মার্কেট। দু’টি মার্কেটই কাপড়ের। মার্কেটগুলোর দূরত্ব যেমন বেশি নয় ঠিক তেমনি দু’টিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময়ও কাছাকাছি। রহস্যময় ভয়াবহ অগিকাণ্ডে বঙ্গবাজারের সাড়ে ৩ হাজার ব্যবসায়ীর স্বপ্ন পুড়েছে কিছুদিন আগে। কোটিপতি থেকে অনেক ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। যারা ব্যাংক ঋণ আর ধারদেনা করে ব্যবসা করছিলেন তারা এখন নিঃস্ব। দান-অনুদান ও নতুন করে ঋণ করে ব্যবসায়ীরা পুড়ে যাওয়া স্থানে চৌকির ওপর আবার নতুন করে ব্যবসা শুরু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। এখনো বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন হয়নি। বঙ্গবাজারের পোড়া গন্ধ শেষ হতে না হতেই গতকাল ভোরে নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে কয়েক শতাধিক ব্যবসায়ী নিঃস্ব হলেন। ঈদের আগে পরপর দু’টি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নতুন রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।

বড় দু’টি মার্কেটে আগুনের সূত্রপাত প্রায় একই সময়ে। ভোরবেলা। রমজান মাসের এই সময়ে বেশির ভাগ মানুষ ঘুমে থাকেন। নীরব থাকে রাজধানীর পথঘাট। এই সময়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নানা প্রশ্ন সামনে আসছে। বঙ্গবাজারের অগ্নিকাণ্ডের পেছনে সিটি করপোরেশনের বহুতল ভবন নির্মাণের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে দাবি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। ঠিক একইভাবে নিউ সুপার মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের পেছনেও সিটি করপোরেশনের ফুট ওভার ব্রিজ ভাঙার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও সিটি করপোরেশন এসব অভিযোগ নাকচ করেছে। জানিয়েছে নিউ মার্কেটের আগুনের সঙ্গে ফুট ওভার ব্রিজ ভাঙার কোনো সম্পর্ক নেই।

ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) সমিতির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, সেহরির সময় সিটি করপোরেশন থেকে একটি টিম নিউ সুপার মার্কেটের পূর্ব পাশের সিঁড়ি বিনা নোটিশে ভাঙতে আসেন। নিরাপত্তারক্ষীরা সিটি করপোরেশনের লোকদের নিষেধ করেছিলেন। ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা শোনেননি। শেষমেশ নিরাপত্তাকর্মীরা অন্তত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করার কথা বলেন। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে ব্রিজের সিঁড়ি ভাঙা শুরু করেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে মার্কেটের ৩ তলায় বিকট শব্দ হয়ে আগুন লেগে যায়। আগুন লাগা মার্কেটের ব্যবসায়ী ফারুক বলেন, শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগেছে। মূলত ব্রিজের সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে শর্ট সার্কিট হয়। চারদিকে শুধু কাপড়ের দোকান। ওয়েল্ডিংয়ের আগুন মার্কেটে প্রবেশ করে আগুন লেগেছে। ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট বণিক সমিতির বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব কাজী আবুল খায়ের বলেন, সিটি করপোরেশন নিয়ম মেনে ব্রিজ ভাঙেনি। বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ না করার কারণে আগুন লেগেছে বলে মনে হচ্ছে। নিউ সুপার মার্কেটের ইলেকট্রিশিয়ান বলেন, সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে আমি ভোরবেলা ব্রিজ ভাঙার খবর পেয়েছি। আমাকে ফোন করে সে বলে মার্কেটের পূর্ব পাশের ওভারব্রিজ ভাঙতে আসছে।

ওখানে ইলেকট্রিক লাইন আছে ভেবে আমি দ্রুত সেখানে চলে যাই। কিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর আগেই মার্কেটে আগুন লেগে যায়। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, গত বছরের রমজান মাসে সিটি করপোরেশন এই ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। এরপর এক বছর চলে গেল। তারা কোনো উদ্যেগ নিলো না। আর এখন ঈদের সময় নিউমার্কেট এলাকা কতো ব্যস্ত। এখনই তাদের ব্রিজ ভাঙতে হবে কেন? মালিক সমিতির সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ বলেন, রাত ৩টার দিকে করপোরেশনের লোকরা যখন ব্রিজ ভাঙতে আসে তখন তারা সেখানে ইলেকট্রিক লাইন আছে সেটি খেয়াল করেনি। তাই ব্রিজ ভাঙার সময় শক্তিশালী কিছু ব্যবহার করতে গিয়ে শর্ট সার্কিট হয়। পরিকল্পিতভাবে ব্রিজ ভাঙতে গিয়ে আগুন লেগেছে।

এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবির কয়েক ঘণ্টা পরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এক বিবৃতিতে বলেছে, আগুনের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কাজের সম্পর্ক নেই। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, নিউ মার্কেট সংলগ্ন একটি পথচারী পারাপার সেতুর সঙ্গে নিউ সুপার মার্কেটের সংযোগ দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। আগুন লাগার আধা ঘণ্টারও আগে তাদের কাজ শেষ হয়। সিটি করপোরেশন বলছে, ঢাকা নিউ মার্কেটের সঙ্গে সংযুক্ত পথচারী পারাপার সেতুটি (ফুটওভার ব্রিজ) গত বছরই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়। তখন সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ফলক ঝুলিয়ে দেয়া হয় এবং সেতুটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে লোকজন চলাচল করছিল, যা অত্যন্ত অনিরাপদ। এমতাবস্থায় দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে গত ১২ই এপ্রিল সেই সেতুটির সঙ্গে মার্কেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় শনিবার রাত ২টা থেকে ভোর ৫.১৫টা পর্যন্ত সেতুটির সঙ্গে মার্কেটের ২য় তলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং করপোরেশন কার্যক্রম শেষ করে। ভোর ৫টা ৫০ মিনিটে আগুন লাগে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। সুতরাং অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের সময় থেকে আধা ঘণ্টারও বেশি আগে সম্পন্ন সেতুর সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ কার্যক্রমের দৃশ্যত ও অদৃশ্য কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই।
তারপরও কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সেতু অপসারণের সঙ্গে আগুন লাগাকে একসূত্রে গাঁথার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এই অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে করপোরেশন কর্তৃক সেতু বিচ্ছিন্নকরণের ন্যূনতম কোনো সংযোগ নেই। এ ছাড়া সেতু বিচ্ছিন্নকরণ স্থান থেকে ৪০০ ফুটেরও অধিক দূরত্বে আগুন লেগেছে। এ সময় কোনো গ্যাস কাটার ব্যবহার করেনি। হুইল এস্কেভেটর ব্যবহার করে সেতু বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। আর বিচ্ছিন্নকরণ স্থানে করপোরেশনের কর্মকর্তা, ডিপিডিসি’র কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন যাতে করে নিরাপদে এই কার্যক্রমটি সম্পন্ন করা যায়। এ ছাড়াও সেতুর সঙ্গে মার্কেটের সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের আগে থেকেই সেতুর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।

এদিকে, পর পর দুটি মার্কেটে ভোরবেলা অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন মার্কেটে একের পর এক আগুনের ঘটনা ষড়যন্ত্র বা নাশকতা কিনা, তা খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, আমরা ইদানিং লক্ষ্য করছি রাজধানীর কয়েকটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এখানে যদি কোনো নাশকতার ঘটনা থাকে তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঈদের আগে কেন মার্কেটে মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অনুরোধ করবো এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। কেন মার্কেটগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন সরকারের ব্যর্থতার কারণেই একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা রহস্যজনক।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ফায়ার সার্ভিস বলেছে মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া এমন বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে যেকোনো ছোট্ট দুর্ঘটনায় ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে। পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সবগুলো বিষয় খতিয়ে দেখছি। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্য কোনো কারণ আছে সেটাও দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, এর আগে বঙ্গবাজারে একটি বড় ধরনের আগুনের ঘটনা ঘটেছে। গত রাতে হাজারীবাগের ট্যানারিতেও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। সুরিটোলায় গুদামে আগুন লেগেছে। সিদ্দিকবাজারের ক্যাফে কুইন ও নিউমার্কেটের পাশের শিরিন ম্যানশনে বিস্ফোরণের ঘটনা দুটোতেও মামলা নেয়া হয়েছে। বঙ্গবাজারের ঘটনায় পুলিশ কমিটি না করলেও তদন্ত কাজ চালিয়েছে।

পুড়ে যাওয়া মার্কেট পরিদর্শন শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, একটি সুনির্দিষ্ট সময়ে বারবার অগ্নিকা- ঘটছে, তাই আমরা শঙ্কিত। এসব ঘটনা নাশকতা কিনা তা গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানাই। র‍্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, নিউ সুপার মার্কেটে লাগা আগুন নাশকতামূলক ঘটনা কিনা তা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমে র‍্যাবের তদন্ত দল কাজ করছে।

ওদিকে বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ড নিয়ে সিটি করপোরেশন একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সেখানে কমিটির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে সিগারেট বা কয়েলের আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। যদিও ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বঙ্গবাজারে বহুতল ভবন নির্মাণ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। দ্বন্দ্বের কারণে আগুন লেগেছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

https://mzamin.com/news.php?news=51474