১৬ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৩৯

রোগীরা বিদেশমুখী আস্থার সংকটে

নিয়মের শিথিলতায় সামান্য রোগেও বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা

 দিন যত যাচ্ছে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত তত উন্নতি করছে। জটিল রোগের চিকিৎসাও কমবেশি শুরু হয়েছে। এ খাতে একদিকে সরকারি বরাদ্দ বাড়ছে।

অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগও বেড়ে চলছে। তবু বিদেশমুখী রোগীর সংখ্যা বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। বছরে অন্তত ৮ লাখ মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশ ভ্রমণ করছেন বলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে জানা গেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।

তারা মনে করেন, রোগীদের বিদেশমুখিতার প্রধান কারণ দেশীয় স্বাস্থ্যসেবার প্রতি অনাস্থা। এরমধ্যে আছে দেশীয় চিকিৎসক ও সেবা ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থাহীনতা, রোগ নির্ণয়ে ত্রুটি, সময়মতো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা না পাওয়া, চিকিৎসকের আন্তরিকতা ও সদ্ব্যবহারের ঘাটতি ইত্যাদি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার উপ-পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে প্রতিবছর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি চিকিৎসক হিসাবে অবশ্যই আমাদের ব্যর্থতা। এর পেছনে কিছু বাস্তব কারণ রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে প্রধানতম হচ্ছে চিকিৎসক ও রোগীদের আচরণগত সমস্যা-উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া কম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে অতিরিক্ত রোগীর ভিড়। ফলে তারা রোগীকে ইচ্ছামতো সময় দিতে পারেন না।

এ চিকিৎসক মনে করেন, রোগীদের বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে হলে সবার আগে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। চিকিৎসকদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। রোগ শনাক্তে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সরঞ্জাম ও হাসপাতাল অবকাঠামো বাড়াতে হবে। চিকিৎসা ব্যয় নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে যেমন স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগ লাগবে, তেমনি মানুষকেও সচেতন হতে হবে।

জানা গেছে, এক দশক আগেও শুধু সমাজের বিত্তশালীরা উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যেতেন। বর্তমানে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তদেরও অনেকে এ পথে হাঁটছেন।

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী ও ভিআইপি হিসাবে পরিচিতদের ৩৫ শতাংশ চিকিৎসা নিতে বাইরের দেশে যাচ্ছেন। তারা ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, কোরিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে বেছে নিচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নীতিমালা ছিল। সেখানে উল্লেখ ছিল কেউ বাইরে চিকিৎসা নিতে চাইলে সেটির প্রয়োজন আছে কিনা, কত ডলার খরচ হবে, সেই হিসাব-নিকাশ করা হতো। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটি খরচের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিত। এই নীতিমালার পরিবর্তন হয়েছে।

এখন রোগীরা যে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র নিয়ে ব্যাংক থেকে ডলার নিতে পারছেন। নিয়মের শিথিলতায় সামান্য রোগ-ব্যাধিতেও বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এতে করে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পেছনে প্রথম কারণ চিকিৎসকদের প্রতি রোগীদের অনাস্থা। দ্বিতীয় কারণ রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যকার সম্পর্কের ঘাটতি। তৃতীয়ত চিকিৎসা পরবর্তী সম্পূর্ণ ফলাফল না পাওয়া। আরেকটি কারণ রোগ সম্পর্কে রোগীর জ্ঞান কম থাকা। এতে অনেকেই বিদেশ নির্ভর হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশিরা ২০১৯ অর্থবছরে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন, ২০২০ অর্থবছরে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন, ২০২১ অর্থবছরে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন এবং ২০২২ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়কালে বিদেশে চিকিৎসার জন্য শূন্য দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন।

ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটিতে গমনকারী মোট বিদেশি নাগরিকের ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশই ছিল বাংলাদেশি। এ সময় ভারতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যটক গেছে বাংলাদেশ থেকে। ২০২১ সালে ২৪ লাখ বাংলাদেশি ভারতে গেছেন। এরমধ্যে ৭৭ দশমিক ৬ শতাংশ গেছেন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে।

যেসব রোগের চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে : সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে ক্যানসার, হার্ট, কিডনি, লিভার, টিউমার, অর্থোপেডিক্স, বন্ধ্যাত্ব, মানসিক প্রতিবন্ধী, হরমোন, ফিজিওথেরাপি, প্লাস্টিক সার্জারি ও চোখের চিকিৎসা নিতে মানুষ বিদেশে বেশি যাচ্ছেন। এছাড়া ফুলবডি চেকআপের জন্য এমপি, মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী ও বিত্তশালীদের অনেকে বছরে অন্তত একবার বিদেশ যাচ্ছেন। তাদের কেউ রাষ্ট্রীয় কাজ, কেউ চিকিৎসা এবং কেউ আবার পর্যটন ভিসায় যান।

রমারমা মেডিকেল ট্যুরিজম : জানা গেছে, দেশে সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ, ব্যাংকক হাসপাতাল, এ্যাপোলো হাসপাতাল, ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল ও সেন্ট্রাল জেনারেল হাসপাতালের রেফারেল অফিস রয়েছে। মর্ডান ক্যানসার হাসপাতাল গুয়াংজুর সাব হাসপাতাল, ফোরটিস হাসপাতাল রেফারেল সেন্টার, ব্রিটিশ চ্যারিটির ওয়ান পাউন্ড জেনারেল হাসপাতালসহ (সিলেট) বেশকিছু প্রসিদ্ধ হাসপাতালের নামেও বিভাগীয় শহরে সাব অফিস খোলা হয়েছে।

এছাড়া বেঙ্গালুরুর কিডওয়াই মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট অব অনকোলজি, শঙ্কর নেত্রালয়, জয়দেব ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওলজি, মালা হসপিটাল, মানিপাল হার্ট ফাউন্ডেশন, চেন্নাইয়ের শঙ্কর নেত্রালয় হসপিটাল, এ্যাপোলা হসপিটাল, খ্রিস্টান মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল চেন্নাই, তামিলনাড়ু হসপিটাল, মালারা হসপিটাল, এ্যাপোলো ক্যানসার হাসপাতাল, দিল্লির ইসকট হার্ট ইনস্টিটিউট অ্যান্ড রিসোর্স ক্লিনিক, রাম মনোহার লহিয়া হসপিটাল, ন্যাশনাল হার্ট ইনস্টিটিউট দিল্লি গোবিন্দ বালাপথ হসপিটাল, বেত্রা হসপিটাল অ্যান্ড মেডিকেল রিসোর্স সেন্টার, মুম্বাইয়ের মুম্বাই হসপিটাল অ্যান্ড মেডিকেল রিসোর্স সেন্টার, পিডি হিন্দুজা, টাটা মেমোরিয়াল প্রভৃতি হাসপাতালের দেশি-বিদিশি প্রতিনিধিরা এ দেশের কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালের যোগসাজশে স্বল্পমূল্যে উন্নত চিকিৎসার আশ্বাসে রোগী ভাগাচ্ছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের চোখ ফাঁকি দিয়ে রোগী দেখা, ভিসা প্রসেসিং ও এয়ার টিকিটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।
মেডিকেল টুরিস্টদের লক্ষ্য করে আন্তর্জাতিক হাসপাতাল চেইনগুলো এদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ লক্ষ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করছে। হাসপাতাল চেইনগুলোর মধ্যে এ্যাপোলো, এভারকেয়ার, জাপানের গ্রিন হসপিটাল সাপ্লাই ও থাইল্যান্ডের থনবুরি হেলথকেয়ার গ্রুপের মতো হাসপাতাল চেইনগুলো এগিয়ে আসছে।
ঢাকায় ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের কর্মকর্তারা যুগান্তরকে জানিয়েছে, বাংলাদেশি মেডিকেল ট্যুরিস্টরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় যায় ভারতে। করোনা মহামারির আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের ১৬ লাখেরও বেশি ভিসা দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী লকডাউনেও জরুরি পরিস্থিতিতে ভিসা প্রদান বন্ধ করেনি। ওই বছর দেশটি প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার বাংলাদেশিকে ভিসা দিয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ ৯৬ হাজার মেডিকেল ভিসা। ২০২২ সালে ভারত সরকার ১২ লাখ বাংলাদেশিকে ভিসা দিয়েছে। এদের প্রায় ৪ লাখ মেডিকেল ভিসা।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেমন জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় রোগীও বেশি। অনেকে হাসপাতালে জায়গা না পেয়েই যাচ্ছে। হয়রানি ছাড়াই দ্রুত রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসাপ্রাপ্তির জন্য যাচ্ছে। একশ্রেণির মানুষের অনেক অর্থকড়ি থাকায় তারা সামাস্য অসুখেও বিদেশে যাচ্ছেন। প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রের ঘাটতি রয়েছে। তবে প্রধান কারণ আস্থার সংকট। বিদেশনির্ভরতা বন্ধ করতে হলে চিকিৎসকদের রোগীবান্ধব হতে হবে। চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে রোগীদেরও সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব থাকতে হবে। হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। হাসপাতালে সব ধরনের চিকিৎসা সরঞ্জাম, স্বাস্থ্যকর্মী ও জনবল নিশ্চিত করতে হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/665809