১৬ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৩৭

নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা

মার্কেটে সিরিজ আগুন নিয়ে রহস্য

আসছে ঈদ। জমে উঠেছে পোশাক-কাপড়ের ব্যবসা-বাণিজ্য। ব্যবসায়ীদের মুখে আনন্দের হাসি। এমন সময় যেন প্রলয়ংকারী ঝড় বইছে ব্যবসায়ীদের ওপর। একের পর এক আগুনে জ্বলছে রাজধানীর বড় বড় মার্কেট। পুড়ছে শত শত কোটি টাকার সম্পদ। কোটিপতি ব্যবসায়ী নিমেষেই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। চলতি মাসের শুরুতে বঙ্গবাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যায় পাঁচ সহস্রাধিক দোকান। এরপর নবাবপুরের পুড়ে ছাই হয় ২০টির মতো গোডাউন। সর্বশেষ শনিবার রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগল। এতে শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এর আগে গত মাসে সায়েন্সল্যাব ও সিদ্দিকবাজারে দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবন ধসে ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। ঈদের আগে সিরিজ আগুন ও বিস্ফোরণ সব মহলেই রহস্য তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে-রাজধানীর এই সিরিয়াল অগ্নিকাণ্ডগুলো কি কেবলই কাকতালীয় দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একযোগে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র‌্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাশকতার আলোচনার মাঝে যেন অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় মার্কেট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ঢাকা না পড়ে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ঢাকার পোশাকাদি বেচাবিক্রির জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় দুটি এলাকায় ঈদের আগে এমন আগুন কখনোই দুর্ঘটনা হতে পারে না। এর পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। বঙ্গবাজারের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশনকে দুষছিলেন কতিপয় ব্যবসায়ী। নিউ সুপার মার্কেটের আগুনের ঘটনায়ও সিটি করপোরেশনকে দুষছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন থাকতে পারে। অপরদিকে বিএনপির পক্ষ থেকেও বড় বড় মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনাকে রহস্যজনক উল্লেখ করে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি উঠেছে। ফায়ার সার্ভিস ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে। আগুনের ঘটনাগুলো ষড়যন্ত্র বা নাশকতা কিনা তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। পুলিশ মহাপরিদর্শক জানিয়েছেন, অগ্নিকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা তারা খতিয়ে দেখছে। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান শনিবার রাতে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে আজ তিনি সব পক্ষের সঙ্গে বসে আলোচনা করবেন।

আগুনের এই ঘটনাগুলো নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ঈদের আগ মুহূর্তে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ আগুন ভোরে ঘটছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি। এই সময়েই কেন রাজধানীর মার্কেটগুলোতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানাব, বারবার এসব ঘটনার পেছনে কোনো নাশকতা রয়েছে কিনা, এগুলো একই সূত্রে গাঁথা কিনা-তারা যেন বিষয়টি গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখেন।

তবে নিউ সুপার মার্কেটের আগুন নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, গত রমজান মাসে মার্কেটের পূর্ব পাশের সিঁড়ি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছিল সিটি করপোরেশন। কিন্তু গত এক বছরেও তারা এ বিষয়ে কিছু করেনি। শুক্রবার দিবাগত রাতে মার্কেটের পূর্ব পাশের সিঁড়ি বিনা নোটিশে ভাঙতে আসেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে সকাল পৌনে ৬টার দিকে মার্কেটের নিচতলা ও তিনতলায় বিকট শব্দ হয় এবং ধোঁয়া বের হতে থাকে। সিটি করপোরেশনের এ কাজের কারণে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। যদিও সিটি করপোরেশন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারা বলছে, আগুনের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের কাজের সম্পর্ক নেই। দাপ্তরিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই তারা কাজ করেছেন। আগুন লাগার আধা ঘণ্টারও আগে তাদের কাজ শেষ হয়।

ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ) বণিক সমিতির সাবেক নেতা ইশতিয়াক আহমেদ নিরাপত্তারক্ষীদের বরাত দিয়ে বলেন, ভোর ৫টার দিকে একদল লোক নিউ সুপার মার্কেটের পূর্ব পাশের সিঁড়ি বিনা নোটিশে ভাঙতে আসেন। সিটি করপোরেশনের লোক। নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের অনেকবার নিষেধ করেন। সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। অন্তত আগে বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে নিতে বলেন। কিন্তু তা না করেই সিঁড়ি ভাঙা শুরু করেন সিটি করপোরেশনের লোকজন। এরপরই মার্কেটের ভিতর থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। তবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, বঙ্গবাজার এবং নিউমার্কেটের আগুন লাগার সময় একই। তবে আমি মনে করছি না এটা কোনো ষড়যন্ত্র। তার পরও তদন্ত কমিটি হবে, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দেবে। এর আগে তদন্ত কমিটি (বঙ্গবাজারের) যে রিপোর্ট দিল তাতে আমরা দেখলাম মশার কয়েল বা সিগারেটের আগুন থেকে। এখন তদন্ত ছাড়া হঠাৎ কোনো কিছু বলা মুশকিল।

শনিবারের অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ও ভবনে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন। মেয়র বলেন, বারবার আগুনের ঘটনায় আমরা শঙ্কিত। এসব ঘটনা নাশকতা কি না সেটা খতিয়ে দেখা উচিত। সরকার এসব ঘটনা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করবে বলে আশা করি।

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শাহিদউল্লাহ বলেন, শুনেছি কিছুদিন আগে ফুটপাত থেকে হকারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকে কেউ এমন করেছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ নাশকতা মনে করলে আগে দেখতে হবে, এ ঘটনায় কে বা কারা লাভবান হয়েছে।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শনিবার বিকেলে রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, আমরা ইদানীং লক্ষ্য করছি রাজধানীর কয়েকটি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ডের প্রতিটি ঘটনা বাংলাদেশ পুলিশ খতিয়ে দেখছে। এখানে যদি কোন নাশকতার ঘটনা থাকে তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এদিকে নিউ সুপার মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডস্থল পরিদর্শন করেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। এরপর তিনি জানান, অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোন নাশকতা আছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এদিকে র‌্যাবের পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো ধরনের নাশকতা রয়েছে কিনা এ বিষয়ে তাদের গোয়েন্দারা কাজ করছেন। এদিকে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নানা বক্তব্য, ফায়ার সার্ভিসের অনুরোধ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মধ্যে ঘটনাটিকে একপাক্ষিকভাবে না দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামালের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঈদের আগে সকাল বেলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে। ফলে অনেকেই সন্দেহ করছেন এটি নাশকতা হতে পারে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, নাশকতার আলোচনায় যেন অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় মার্কেট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ঢাকা না পড়ে। কারণ যেই মার্কেটগুলোতে আগুন লাগছে সবগুলোই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। সবগুলোতেই প্রচুর পরিমাণে দাহ্য পদার্থের উপস্থিতি ছিল। অপরদিকে আগুন নেভানোর জন্য প্রস্তুতি ও পর্যাপ্ত সরঞ্জাম কোনোটিই তাদের ছিল না। মার্কেটগুলোর পরিচালনা কমিটি বরাবরই অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো উপেক্ষা করেছে। নিয়মিত মহড়াসহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অ্যাক্টের নির্দেশনাগুলো মানেনি। এ কারণে আগুন লাগলেই তা ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এজন্য আগুন লাগলেই কাউকে দোষারোপ না করে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে মার্কেট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান এই বিশেষজ্ঞ।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/665805