১৬ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:৩৬

চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড ৪২.২

বাতাসে আগুনে হলকা

-আরো এক সপ্তাহ বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই

বাতাসে আগুনে হলকা। নাকেমুখে বাতাস লাগলেই মনে হয় যেন আগুনের ছিটা আঘাত হানছে। বাতাস নেই বলেই চলে। যেটুকু আছে তাও সহ্য করার মতো না। গত ৫ এপ্রিলের পর থেকে প্রতিদিনই দেশে তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হচ্ছে। গতকাল শনিবারও উচ্চ তাপমাত্রা নতুন শীর্ষ ছুঁয়েছে চুয়াডাঙ্গায়। সেখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকাতেও কম না। এখানে গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

গত ১০ দিন যাবৎ অনেক গরম থাকলেও তখন বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কম থাকায় ঘাম হতো না। গতকাল থেকে বাতাসে বেড়েছে আর্দ্রতার পরিমাণ। আকাশে কিছুটা মেঘও ছিল। ফলে শরীরে দেখা যাচ্ছে ঘাম। ঘামের কারণে মানুষ আরো বেশি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। গতকাল ভোরে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে মোটামুটি ঘন কুয়াশা। সকাল ৮টায়ও সূর্য স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না কুয়াশার জন্য। কুয়াশার কারণে ঘাম বাড়ে। গতকাল শনিবার সকালে ঢাকায় বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ছিল ৮৬ শতাংশ। তবে বিকেলে আর্দ্রতা কিছুটা কমে যায়। ঢাকায় গতকাল বিকেলে আর্দ্রতা ছিল ৩৫ শতাংশ। গতকাল সারাদিনই মানুষের ঘাম ঝরেছে শরীর থেকে।

এই কুয়াশা এক ধরনের মেঘই, কিন্তু তা থেকে বৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। আকাশে সামান্য মেঘ অথবা কুয়াশা শুধুই ঘাম বাড়াবে, বাড়বে গরমের অনুভূতি। কানাডার সাসকাচোয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহের আগে বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। কারণ দক্ষিণ দিক থেকে অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর থেকে আর্দ্রতাপূর্ণ বাতাস আসা বন্ধ রয়েছে। তবে ২২ এপ্রিলের দিকে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে সামান্য বৃষ্টি হতে পারে। তবে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের ওপারে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। সেখানে মেঘ সৃষ্টি হবে স্থানীয়ভাবে। তার কিছুটা আঁচ সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে লাগতে পারে। এ কারণে দেশের সার্বিক তাপমাত্রার কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।

নরসিংদীর শিবপুরের মাস্টার্সের ছাত্র রিয়াদুল হক জানিয়েছেন, তারা কয়েক দিন থেকে শেষ রাত হতে বেশ কুয়াশা দেখছেন। দিনে প্রচণ্ড তাপমাত্রায় কষ্ট পেলেও শেষ রাতে বেশ আরাম বোধ করছেন, কারণ তখন না গরম ও না শীত অবস্থা থাকে। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে আগুনে হলকা। দুপুরের দিকে খোলা আকাশে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। মাঠে কাজ করা দুরহ হয়ে পড়েছে। ছাতা মাথায় দিয়েও খোলা আকাশের নিচে ঘুরতে গেলে অচেতন হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তাই কৃষকরা কিছুক্ষণ কাজ করে বাড়ি চলে আসছেন অথবা ছায়ায় বিশ্রাম নিতে বাধ্য হচ্ছেন। ঘন ঘন পানি পান করতে না পারলে শরীর কাজ করে না, মনে হয় ভেতরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো ঝিম মেরে আছে।

চুয়াডাঙ্গায় গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে ৪২.২ ডিগ্রি। এর আগে ২০১৪ সালে ৩১ মেও ৪২.২ ডিগ্রি তাপমাত্রা উঠে সেখানে। চলতি গরমের মৌসুমে অবশ্য চুয়াডাঙ্গাতেই সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা উঠে। এর আগে ১৯৭২ সালে রাজশাহীতে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪৫.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

ঢাকা শহরে গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকা শহরে এটাই চলতি বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। অবশ্য ২০১৪ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সেদিন যশোরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল।

এ দিকে শহরে এসি মেশিনে অফিস করলেও গ্রামেগঞ্জে সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা নেই। ঢাকা শহরে বিদ্যুতের লোডশেডিং কম থাকলেও গ্রামের দিকে অনেক লোডশেডিং হয়ে থাকে। সেখানে রেফ্রিজারেটরে রক্ষিত তরিতরকারি ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই আবার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়তে হয়। অন্য দিকে মোবাইলের চার্জারও শতভাগ চার্জ করা যায় না। গ্রামের মানুষ যেমন খোলা আকাশের হাঁটতে পারছেন না প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে, তেমনি কৃষকের ক্ষেতের ফসল পুড়ে যাচ্ছে। আগা পুড়ে যাচ্ছে ফসলের। ফলে সামনে সার্বিক উৎপাদন ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আজ রোববারও সারা দেশের তাপমাত্রা বাড়তে পারে বলে আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে। আজ ঢাকা, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা, বাগেরহাট, যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়ায় তীব্র তাপ প্রবাহ বয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
চুয়াডাঙ্গায় অতিজরুরি ছাড়া বের না হওয়ার পরামর্শ

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানান, তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা চুয়াডাঙ্গাবাসীর। গতকাল বেলা ৩টায় জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এ নিয়ে টানা ১৪ দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হলো। মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ শেষে এবার অতি তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে এই জেলায়। তাপদাহে আমের গুটি, ধানের শীষ ঝরে যাচ্ছে। সবজিসহ সব ধরনের চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। হাসপাতালে শিশু রোগীর সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।

চুয়াডাঙ্গা প্রথম শ্রেণীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রকিবুল হাসান জানান, টানা ১৪ দিনের মতো এ জেলায় দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। তিনি বলেন, সহজে দেখা মিলছে না বৃষ্টির। এবারের গরমে ভিন্নমাত্রা রয়েছে। বাতাসের আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই তাপদাহের মধ্যে ঠোঁট শুকিয়ে ফেটে যাচ্ছে। বাতাসে জলীয় বাষ্প কম থাকায় মূলত এমন হচ্ছে। সকালে সূর্য ওঠার পর থেকে তীব্র রোদ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এ রোদ যেন আগুনের ফুলকি হয়ে ঝরছে।
এ দিকে প্রচণ্ড গরমে কর্মজীবী মানুষেরা চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন। শিশু ও বৃদ্ধরা দুর্ভোগে পড়েছেন। প্রখর রোদের ঘাম ঝরানো তাপমাত্রার কারণে শ্রমজীবী ও নিম্নআয়ের লোকজন চরম বিপাকে। রোজার মাস হওয়ায় একটু স্বস্তি পেতে ঠাণ্ডা শরবত, পানি, আইসক্রিম খেয়ে তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করতে পারছে না সাধারণ মানুষ। তিন-চার দিন আরো তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। একটানা তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় হিট স্ট্রোক, হৃদরোগ, ডায়রিয়া, শিশুদের নিউমোনিয়াসহ গরমজনিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে প্রতিদিনই ৭০-৮০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে ডায়রিয়া ও টাইফয়েড রোগীই বেশি। সদর হাসপাতালের আরএমও ডা: ফাতেহ আকরাম জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বেশির ভাগই গরমজনিত রোগে আক্রান্ত।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, তীব্র তাপদাহের কারণে বোরো ধান, আমের গুটি ঝরে শুকিয়ে যাচ্ছে। আমগাছে পানি স্প্রে এবং বোরো ধানসহ সব ধরনের সবজি ক্ষেতে প্রতিদিনই সেচ দিতে এবং সেচের পানি ধরে রাখার পরামর্শ দিচ্ছে কৃষি কর্মকর্তারা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে।

এ দিকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রায় এই জেলাবাসীর ত্রাহি অবস্থা। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন ও জেলা তথ্য অফিসের পক্ষ থেকে অতিপ্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে বের না হওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সে সাথে নানা ধরনের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, জেলার সব স্থানে মাইকিং করে জনসাধারণকে সতর্ক করা হচ্ছে। তারা যেন অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হয়।
পাইকগাছায় ঝরে পড়ছে আমের গুটি

পাইকগাছা (খুলনা) সংবাদদাতা জানান, বিগত আট বছরের মধ্যে এবার খুলনায় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। উপকূলের তাপমাত্রা আরো বেশি। গত কয়েক মাস এ অঞ্চলে বড় ধরনের বৃষ্টিপাত হয়নি। টানা বৃষ্টিহীনতা আর খরায় পাইকগাছা উপজেলায় আমের গুটি ব্যাপকহারে ঝরে পড়ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার আমগাছে প্রচুর মুকুল ও গুটি ধরে। তবে বৃষ্টির অভাবে গুটি ঝরে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন আমচাষি ও বাগান মালিকরা।

উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উপজেলায় ৫৮৫ হেক্টর আম বাগান রয়েছে। পাইকগাছায তাপমাত্রা বাড়ার পরও আমের গুটি যেটুকু ঝরছে সেটি স্বাভাবিক। চাষিদের হতাশার কিছু নেই। বেশি গুটি ঝরছে মনে হলে সেচ দিতে হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/741807