১৬ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:২৮

ইতিবোধের হোক জাগরণ

সালাহউদ্দিন বাবর

আজকে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে ইতিবাচকতা নিয়ে যে বোধ-চিন্তা, সেটা খুব তলানিতে পৌঁছেছে। হয়তো তাকে এভাবেই বর্ণনা করাই সঠিক হবে, তার অবস্থান এখন মাইক্রোস্পিক মাইনোরিটির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছেন, তাদের আচরণ ও অনুশীলনে নেতিবাচকতাকে নিত্যদিনের সঙ্গী করেই নিয়েছেন। ইতিবাচকতা তাদের চেতনাকে যেন কোনোভাবেই স্পর্শ করতে পারছে না। সে কারণে সর্বত্র নেতিবাচকতার বিষবাষ্প রাজনৈতিক সামাজিক পরিমণ্ডলকে দূষিত করে ফেলেছে। তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে মানুষের কষ্ট বেদন আর অনুপাত। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আশা করা এই মুহূর্তে একেবারেই অসম্ভব।

ইতিবাচক ধারণার প্রতিষ্ঠা, চর্চা ও পরিবর্ধন করা রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনগুলোরই অন্যতম অ্যাজেন্ডা হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। অথচ নেতিবাচকতার অবস্থান এখন সর্বত্র, পাকাপোক্ত। সেটা অবদমন করে তার বিপরীত ব্যবস্থার বিকাশ ঘটিয়ে জনগণের স্বস্তি, প্রশান্তির দিকে অগ্রসর হওয়া এখন জরুরি। আর একটা কথা সবার, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনে রাখতে হবে। এই বোধ-ধারণার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লিখিত দুই সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে। কেননা ইতিবাচকতা ভিন্ন সমাজ রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্রের কাণ্ডারি, যারা এই মুহূর্তে, তারা ঠিক সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন বলে মনে করার কোনো উদাহরণ নেই।

আসলে ইতিবোধের সংক্ষিপ্ত ধারণা হয়তো এমন হতে পারে ব্যক্তি সমাজ ও সব পর্যায়ের মানুষ যখন আশাবাদী চিন্তাকে লালন করে অগ্রসর হতে পারবে। তবে খুব বেশি আশা করা নয়, যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে তেমন নয়। বরং সেটা পূরণ করার মতো সাধ্যকে বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো বিষয় সমাধানের জন্য আত্মনিয়োগ করা, প্রত্যয়ী হওয়া এবং ইতিবাচক ফলের জন্য প্রত্যাশী হওয়াই মূল কথা। সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের পর যতটুকু সাফল্য আসবে তাতে তৃপ্ত ও স্বস্তিবোধ করাই ইতিবাচকতা বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। অতিরঞ্জন করা বা বাগাড়ম্বর করা নয়। যদি তেমন কিছু হয়, তবে তা হবে ইতিবাচকতার বিপরীত শব্দ। সর্বশেষ কথা, কোনো নেতিবাচক ধারণার সাথে কোনোভাবেই ইতিবাচক ভাবনার তুলনা হতে পারে না।

প্রথমে ছোট একটা উদাহরণ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে আজকের নেতিবাচকতা অনুশীলন কীভাবে অগ্রসর হচ্ছে সেটা অনুধাবন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। যেমন পবিত্র রমজানের পূর্বে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ রাজনৈতিক নির্বাহীদের পক্ষ থেকে বলা হলো, এবার রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর সরবরাহ বাড়ানো হবে। সে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসন সব উদ্যোগ নেবে।’ কেউ যদি এখন জানতে চায় প্রশাসনের উচ্চারিত বিধি ব্যবস্থাগুলো কী ছিল এবং সেটা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব কিভাবে কতটুকু আনজাম দেয়া হয়েছে, তার ফলাফল কেমন হয়েছে, তার সন্তোষজনক জবাব দেয়ার কোনো কর্তৃপক্ষ কি রয়েছেন? কিন্তু সাধারণভাবে এতটুকু জানা গেছে, মূল্য পরিস্থিতি নিচে নামানোর উদ্যোগের কোনো উদাহরণ ছিলই না বরং সব কিছু উল্টো দিকে গেছে। এই পর্যবেক্ষণকে অবশ্যই অসত্য বলাই যাবে না। তার জন্য আরও একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে।

গত ২৫ মার্চ দৈনিক সমকালের একটি লিড ছবি ছিল। (পাঠক, আপনারা ইচ্ছা করলেই মোবাইলে সার্চ দিলে সে ছবি দেখতে পারেন) সে ছবির ক্যাপশনে লেখা আছে, ‘সাশ্রয়ী মূল্যে টিসিবি পণ্য কিনতে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। ভোর থেকে দাঁড়িয়েও অনেকে খালি হাতে বাড়ি ফিরে যান।’ সেই ছবির সাথে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে তার একটির শিরোনাম হচ্ছে ‘সুলভ মূল্যের পণ্য যেন সোনার হরিণ’। সাব হেডিং হচ্ছে ‘রাজধানীর ২০ স্থানে মুহূর্তে সব পণ্য বিক্রি শেষ’। অপর জাতীয় দৈনিক ‘নয়া দিগন্ত’-এ ওই একই দিন প্রকাশিত প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম হচ্ছে ‘বিফলে সরকারের সব পদক্ষেপ’। সে রিপোর্টটি থেকে সামান্য কিছু অংশ এখানে উদ্ধৃত করা হলো, ‘রমজানের অনেক আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে নানা পদক্ষেপের কথা বলে আসছিল সরকার।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিন্তু কোনো পদক্ষেপই কাজে আসেনি। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক অনেক বাজার ঘুরে এসে এই রিপোর্ট করেছেন। তার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে কোথাও চড়ে যাওয়া দামের কোনো কমতি নেই।

ঘোষিত প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তব প্রতিফলনের ক্ষেত্রে যে বিরাট তারতম্য বা ব্যবধান, এখানেই মূলত নেতিবাচকতার অবস্থান। এ পর্যায়ে যা কিছু বলা হয়েছে তার পেছনে সত্যতা থাকতে হবে। না হলে তাকে কী বলা উচিত, সেটি উচ্চারণ করা ভব্যতার বাইরে। বস্তুত এমন নেতিবাচকতা পুরো সমাজকে উদ্বিগ্ন ও আশাহত করছে। যারা নিত্য এমন অনুশীলনের চর্চা করছেন, তাদের কাছে এসব হয়তো কোনো অর্থ তৈরি করছে না। যেমন রুটিন মতো বলতে হয়, তাই বলা। কোথাও জবাবদিহিতার কোনো অনুশীলন নেই। কর্তৃপক্ষের এমন কথায় ও কাজের দূরত্ব কী অর্থ তৈরি করে থাকে? যার যার বিবেকের কাছে এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সঠিক জবাবটাই পেয়ে যাবেন। আমরা এখনো বিশ্বাস করি, সবার বিবেক বিবেচনা ঘুমিয়ে নেই। যদি কারো সেটা একান্তই ঘুমিয়ে গিয়ে থাকে, চেষ্টা করা উচিত তাকে জাগানো। সবাই যদি এমন করে নেতিবাচকতার গণ্ডি ভেঙে ইতিবাচকতার চর্চা শুরু করেন, যা কিছুই করণীয় তার ৫০ ভাগের কিছু বেশি সমাধান করা হয়, তবে ধীরে ধীরে ইতিবাচকতা তোরণ দিয়ে প্রবেশ করা সম্ভব হবে এবং প্রশান্তির এক নতুন ভুবনে সবাই উপনীত হতে পারব।

আজকে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া খুব জরুরি, সেটা হলো নেতিবাচকতা থেকে ইতিবাচকতার দিকে মুখ ফেরানো। এর প্রথম পদক্ষেপ কী হতে পারে সেটা বলা কঠিন কিছু নয়। এ দেশের সংবিধানে পরিষ্কার করে বলা আছে, এই ভূখণ্ডের মালিক মোক্তার হচ্ছে এই বদ্বীপের প্রায় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের জনপদে যে যেখানে বসবাস করুন না কেন এবং তিনি নিরন্ন হন, দারিদ্র্যসীমার মধ্যে অবস্থান করুন বা মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের মানুষই হন, সবাই এই ভূখণ্ডের স্বত্বাধিকারী। তাদের অভিপ্রায় অভিব্যক্তি ও আকাক্সক্ষাকে পূরণ করাকেই ধরে নিতে হবে সর্বোচ্চ দায়িত্ব কর্তব্য ও অত্যাবশ্যক বিষয়। এখানে কোনো কনসেশন বা ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। কোনো ব্যক্তি গোষ্ঠী বা দলের এতে দ্বিমত করার এতটুকু অবকাশ নেই। এই বোধকেই বলতে হবে ইতিবাচকতা। এর ভিন্নতাকেই বলতে হবে নেতিবাচকতা যা কোনোভাবে দেশ দশের কল্যাণে আসতে পারে না। এটাই সর্বজনীনতা। এ থেকে স্বতন্ত্র চিন্ত যারাই করুন তারা অবশ্যই দেশবাসীর অভিপ্রায় অনুভূতি ও সুস্থ জীবনবোধের বিপক্ষ। যারা প্রতিপক্ষ আজ হোক বা কাল হোক তাদের এ দেশের ইতিহাসের এমন এক জায়গায় স্থান করে নিতে হবে, যা পাঠযোগ্য নয়। ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যাত হবেন তাঁরা।

আজ যারা নিজেদের মনে করছেন তারাই কেবল দেশে হিতৈষী, এই জনপদের একমাত্র কল্যাণকামী আর সবাই ক্ষতিকর এলিমেনটস। অনুরোধ করছি, সে ক্ষেত্রে সাহস করে জনতার সম্মুখে হাজির হয়ে অবাধ নিরপেক্ষ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটা বাছাইপর্বে শরিক হলে তবেই বোঝা যাবে কে কতটা যোগ্য দক্ষ সক্ষম ও জনপ্রিয়। যারা এমন প্রক্রিয়ার প্রতি নিষ্ঠাবান সমর্থক তারাই ইতিবাচকতায় স্নাত। এর অন্যথার মধ্যে যারা ডুবে থাকতে চান, বুঝতে হবে তারা নেতিবাচক ধারণায় আচ্ছন্ন। এমন সিদ্ধান্তে অটল অবিচল যেসব শক্তি তাদের ও সমর্থকদের আস্থা অর্জন ও সন্তুষ্ট হতে ও করতে পারেন বটে। কিন্তু সেটা ইতিবাচক ধারণার ধারক হতে পারে না। এমন অবস্থায় যারা স্থিত হতে চান, তাদের দিয়ে অবশ্যই রাষ্ট্রের অনুকূলে তেমন কোনো সংযোজন পরিবর্তন পরিমার্জন সাধন সম্ভবপর নয়। তাদের ভিশন মোশন একান্ত নিজ স্বার্থে; পরার্থে নয়, সেজন্য তাদের যত কর্মকাণ্ড সব ঘিরে থাকে প্রদর্শনপ্রিয়তা আর বাগাড়ম্বর করা। তাদের ধৈর্য ও সহ্যের বাঁধ এতই দুর্বল; সেখানে একটু ঘা লাগাকে মনে হয়, পর্বত দুলে ওঠার মতো। অথচ যাদের দায় দায়িত্ব যত বেশি তাদের ঠিক ততটাই নিথর নীরব কষ্টসহিষ্ণু হতে ও অপরের সব আলোচনা সমালোচনাকে শোনার মতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হয়। সমালোচকদের নিজের সম্মুখে ধরা দর্পণ হিসেবে মনে করতে হবে। কেননা কারো পক্ষে তার নিজের মুখমণ্ডল দেখা সম্ভব নয়।

তার মুখের কোথায় কতটুকু কদর্য রয়েছে, তা যখন সে দেখে না, অন্য কেউ সেটা দেখে যদি তার অবস্থান ব্যাপ্তি বলে দেয়। তবে এটাকে মনে করতে হবে, যে তার সুহৃদয় সৃজন কল্যাণকামী। তার কাছ থেকে যতটুকু ন্যায্য প্রতিপন্ন হবে সেটুকু গ্রহণ করার মধ্যে উপকার ভিন্ন আর কিছু হারাবার নেই। নিজেকে পরিপূর্ণ পরিমার্জন পরিশীলিত করার সেটাই পথ। প্রতিপক্ষের উল্লিখিত বাক্যবিন্যাস নিয়ে যদি ক্ষিপ্ত না হওয়া যায় তবে মনে করতে হবে একে সঙ্গী করে দূর পথযাত্রা করা সম্ভব। নিজেকে যদি কাচের তৈরি পাত্রের মতো ঠুনকো, ভঙ্গুর মনে করা হয়; যাকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না মনে করা হয়; তাহলে তাদের সমাজবদ্ধভাবে বাস করা সম্ভব নয়। তাদের লোকালয়কে এড়িয়ে জনবিরল স্থানে চলে যেতে হবে। মানুষের পক্ষে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করার ইতিহাস সেই আদিম যুগ থেকে। এর অন্যথা কোনোভাবেই মানসিক সুস্থতার পরিচায়ক নয়।

নিজেদের এতটা স্বতন্ত্র বানিয়ে নিলে দুটো ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। প্রথমে নিজেদের অতিউচ্চ শ্রেণীর মানুষ, অধিক পারঙ্গম, অতি পরিশুদ্ধ আর সবাই আহম্মক, সীমাহীন অদক্ষ, অর্বাচীন। এমন ভাবতে শেখার অর্থ হচ্ছে, আত্মম্ভরিতা। এমন স্বভাব মনোভাব নিয়ে চলা আর যাই হোক কোনো স্বপ্ন প্রয়াসী বা সৃষ্টিশীল ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজ হতে পারে না। আর একটা তুলনা করা যেতে পারে বদ্ধ জলাশয়ের সাথে। যেখানে সামান্য পানিতে মাছ নয়, ব্যাঙ্গাচির যত উৎপাত হয়। মানুষের মনোভাবের এটা ইতিবোধের জাগরণ ঘটুক, অন্ধকার কলঙ্ক সব দূরীভূত হোক। সৎ বোধের জাগরণ হলেই নিত্য আর কোনো হলাহল জমবে না। মানুষ আত্মসুখের উল্লাসের মধ্য দিয়ে জীবনের উন্মেষ ঘটাক, শত ফুল ফুটুক, হাজারো ফল পরিপক্ব হোক, পত্রপল্লব বিকশিত হোক, পাখী দল মুখরিত হোক।
ndigantababar@gmail.com


https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/741688