১৬ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ১১:২৬

বাংলা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক ফলাফল নিয়ে পর্যবেক্ষকদের গবেষণা

-আসিফ আরসালান

এই লেখাটি লিখছি ১৩ এপ্রিল, ৩০ চৈত্র, বৃহস্পতিবার। পরের দিন অর্থাৎ ১লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। প্রচন্ড গরমের মধ্যে এই লেখা শুরু করেছি। অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম, আজ অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ৩০ চৈত্র ঢাকায় সবচেয়ে বেশি গরম পড়েছে। শুধু ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের মধ্যে তাপমাত্রা ঢাকায় সর্বোচ্চ, অর্থাৎ ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চৈত্র মাস থেকে গরম পড়ে। এই ৩০ দিনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ঢাকায় রেকর্ড করা হয়েছে। জানি না, পরের দিনগুলো কেমন যাবে। ১লা বৈশাখের খরতাপকে উপলক্ষ করে অনেক কবিতা ও গান লেখা হয়েছে। যেমন একটি হলো, ‘দারুণ অগ্নিবানে’। আরেকটি হেমন্ত মুখার্জীর কন্ঠে গীত হয়েছে, ‘চৈত্রের স্তব্ধ দুপুর’।

প্রকৃতিতে আগুন জ্বালা মাস চলছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমন উত্তাপ নাই। এর একটি কারণ অবশ্যই পবিত্র মাহে রমজান। আজ নয়, বছরের পর বছর ধরে মাহে রমজানে রাজনীতি উত্তাপ ছড়ায় না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সরকারী দল ও বিরোধী দলের মধ্যে এই মুহূর্তে তেমন সাংঘর্ষিক অবস্থা দেখা না গেলেও বাংলাদেশের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দেশের উচ্চ মহলে এবং দেশের বাইরে এক বা একাধিক জাঁদরেল দেশের মধ্যে এমন কিছু কিছু কথা বলা হচ্ছে যেগুলোর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী।

এই তো দু’চার দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর মার্কিন প্রবাসী জ্যেষ্ঠ পুত্র সজিব ওয়াজেদ জয় বলেছেন যে, আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রয়েছে কতগুলি ভন্ড। আমেরিকা সম্পর্কে এমন কঠোর মন্তব্য তিনি এমন সময় করলেন যার দুই এক দিন পরেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেনের সাথে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে মিলিত হতে যাচ্ছিলেন।

এদিকে যে রাত্রে অর্থাৎ সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ১২ টায় দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক হওয়ার কথা (ইতোমধ্যে সে বৈঠক হয়েও গেছে)। সেই দিন অর্থাৎ সোমবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি সংসদের বিদায়ী অধিবেশনে তার ভাষণ দিতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অত্যন্ত কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেন। ঢাকার অনেক পত্র পত্রিকায়ই ঐ দিন যে লিড নিউজ করা হয়েছিল তার অধিকাংশের শিরোনাম ছিল, ‘ওয়াশিংটন ডিসির দিকে তাকিয়ে সবাই’। ঠিক সেই সময় প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, ‘বিশ^ব্যাপী সরকার ওলট পালট করার ক্ষমতা আমেরিকার আছে, একথা সত্য।’ একথা বলার পর তিনি যে কথা বলেন সেটি আরো কঠোর। দৈনিক সমকালের দ্বিতীয় প্রধান সংবাদের শিরোনাম, “দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার আনতে চাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র”। সমকালের ঐ খবরের প্রথম প্যারায় বলা হয়েছে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পারে, পাল্টাতেও পারে। তারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, আবার দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্তদের পক্ষ হয়েই তারা ওকালতি করছে। তারা অর্থাৎ আমেরিকা এখানে অর্থাৎ বাংলাদেশে এমন একটি সরকার আনতে যাচ্ছে যার গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। শুরু হবে একটি অগণতান্ত্রিক ধারা। সেই ক্ষেত্রে কিছু বুদ্ধিজীবী সামান্য কিছু পয়সার লোভে এদের তাঁবেদারি পদলেহন করেন।” বৃহস্পতিবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐ মারাত্মক অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেন। বাংলাদেশের জেলা পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সমাবেশে তিনি বলেন, দেশে বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছে। আপনারা সকলে সতর্ক থাকুন।

॥ দুই ॥
চিত্রের অপর পিঠ। ঐ দিনই সোমবার আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে রাত ১২ টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকটি শুরু হয় রাত ১২ টা ২০ মিনিটে। ১১ এপ্রিল সকালে ডেইলি স্টারের প্রিন্ট সংস্করণে প্রথম পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে যে খবর ছাপা হয় সেই খবরে বলা হয় যে বৈঠকটি শেষ হয় ১২ টা ৪০ মিনিটে। অর্থাৎ ঐ মিটিং স্থায়ী হয় মাত্র ২০ মিনিট। মার্কিন সাইডে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিংকেন ছাড়াও আর যারা এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন স্টেট কাউন্সিলর ডেরেক শোলে, এ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি অর্থাৎ সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলিয়েটা নয়েস, উপ সহকারী মন্ত্রী কারা ম্যাকডোনাল্ড এবং উপ সহকারী মন্ত্রী আফরিন আক্তার। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ডেরেক শোলে এবং আফরিন আক্তার এর মাত্র মাস খানেক আগে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ঐ একই সময়ের কিছু আগে এবং পরে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং হোয়াইট হাউজের নিরাপত্তা কর্মকর্তা আইরিন লেবাউচার।

এই চার জন উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর শেষে ঢাকা ত্যাগ করার সময় বলেছিলেন যে, তারা স্বদেশ ফিরে গিয়ে তাদের সফর সম্পর্কে তাদের মন্ত্রণালয় অর্থাৎ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট করবেন। সেই সব রিপোর্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্থনি ব্লিংকেন পর্যালোচনা করবেন এবং ১০ এপ্রিল ওয়াশিংটনে ড. মোমেনের সাথে মি. ব্লিংকেনের যে বৈঠক হবে সেই বৈঠকে বাংলাদেশের বক্তব্য শোনা হবে এবং মার্কিন বক্তব্য জানানো হবে। সুতরাং বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মিডিয়া এবং এক শ্রেণীর বিদেশী মিডিয়া যথার্থই রিপোর্ট করেছে যে মোমেন ব্লিংকেন বৈঠকের দিকে সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ^ তাকিয়ে আছে।

বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু তারপর বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে যেভাবে খবর প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হলো না। বরং একাধিক পত্র পত্রিকা পড়ে অনেকে জানতেই পারেনি যে এমন একটি বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাযোগ্য প্রস্তুতি নিয়ে আমেরিকা গেছেন। আমেরিকা যাওয়ার আগে দৈনিক প্রথম আলোর সংবাদ মোতাবেক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং গ্রহণ করেন। এই মিটিংটি ছিল এমনই Crucially important meeting. বাংলাদেশের পক্ষে এই বৈঠকে যোগদান করেন আমেরিকায় কর্মরত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান, উপ দূতাবাস প্রধান ফেরদৌসি শাহরিয়ার, উত্তর আমেরিকা সংক্রান্ত মহা-পরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলম।

এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক শেষ হওয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপ প্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেন, সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পৃথিবীর কালাকানুনগুলোর মধ্যে অন্যতম (Bangladesh digital security act is one of the world’s most draconian laws for journalist.) ডেইলি স্টারের ১২ এপ্রিলের রিপোর্ট মোতাবেক, বেদান্ত প্যাটেলের কাছে সাংবাদিকরা সজিব ওয়াজেদ জয়ের মন্তব্য এবং নেত্র নিউজের সহযোগিতায় বাংলাদেশের ওপর ডয়চে ভ্যালে নির্মিত এবং ব্যাপকভাবে ভাইরাল হওয়া ডকুমেন্টারি সম্পর্কেও প্রশ্ন করেন। প্যাটেল আরো বলেন যে, আমেরিকা এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখছে এবং বাংলাদেশকেও খতিয়ে দেখার অনুরোধ করেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য আমেরিকা বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছে।

মোমেন ব্লিংকেন মিটিং সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমেরিকা এবং সেই সাথে সমগ্র গণতান্ত্রিক বিশ্ব তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ওপর। আমেরিকা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন হবে অবাধ সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক। আমেরিকা আরো মনে করে যে আগামীতে বাংলাদেশে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেটি হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি মডেল। অর্থাৎ বাংলাদেশ আগামী দিনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে হবে একটি আদর্শ।

॥ তিন ॥
দৈনিক সমকালের রিপোর্ট মোতাবেক, বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদেরকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, নির্বাচন একা একা হয় না। নির্বাচন অবাধ ও স্বচ্ছ করা শুধুমাত্র সরকারের দায়িত্ব নয়। এজন্য বিরোধী দলকেও এগিয়ে আসতে হবে। সমকালের রিপোর্ট মোতাবেক, “বিরোধীদের অংশগ্রহণ ছাড়া অবাধ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে না” (সমকাল প্রথম পৃষ্ঠা, ১২ এপ্রিল বুধবার)।

॥ চার ॥
সংগ্রামের প্রিয় পাঠক ভাইয়েরা, আমরা আগেই বলেছি যে এই বৈঠক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকের পরবর্তী রিপোর্ট যতটুকু পাওয়া গেছে ততটুকু আমরা ওপরে তুলে ধরলাম। বৈঠকটি কি সফল হয়েছে? নাকি ব্যর্থ হয়েছে? সেই বিবেচনা করবেন দেশের বিজ্ঞ জনসাধারণ।

শুরু করেছিলাম ১লা বৈশাখ নিয়ে। শেষ করবোও একই বিষয় নিয়ে। ১লা বৈশাখ পালনের তো কেউ বিরোধী নাই এদেশে। কিন্তু এক শ্রেণীর তথাকথিত প্রগতিবাদী বন্ধুরা ১লা বৈশাখের ওপর মনোপলি কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠা করতে চান। এজন্য তারা প্রতি বছরই ১লা বৈশাখের পূর্বাহ্ণে নিরাপত্তা, সম্ভাব্য হামলা ইত্যাদি জুজুর ভয় তোলেন। আমাদের জানা মতে বাংলাদেশের ১৬ কোটি ৯৮ লাখ মানুষের মধ্যে একজনও ১লা বৈশাখ উদযাপনের বিরোধী নন। তবে দিনটি কিভাবে পালিত হবে সেটি নিয়ে মতান্তর থাকতেই পারে। কেউ যদি জন্তু জানোয়ারের মুখোশ পরে বৈশাখী শোভাযাত্রা করার সাথে একমত না হন তাহলে তার দ্বিমত করার স্বাধীনতা থাকতেই পারে। এই লেখার সময় আমি কোনো একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে দেখলাম, টাঙ্গাইলে শহীদ মিনারে ১লা বৈশাখের দিন সন্ধ্যায় আগত ব্যক্তিবর্গকে ইফতার করানো হবে। কেউ যদি এভাবে ১লা বৈশাখ উদযাপন করতে চান তাহলে তাদেরকেও সেই স্বাধীনতা দেওয়া হোক। অযথা ব্যাপক পুলিশী উপস্থিতিতে দিবসটির আবেগ ও উচ্ছ্বাসের পথে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি কারো কাছেই বাঞ্ছনীয় নয়। একটি সময় ছিল যখন দিবসটি হালখাতা এবং মিষ্টি বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

যারা এপার বাংলা ওপার বাংলার বন্ধুত্ব নিয়ে মশগুল, তারা দেখুন, ওপার বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে কিভাবে দিবসটি পালিত হয়। বাংলাদেশে প্রগতিবাদী বন্ধুরা যেভাবে শুরু করেছিলেন সেই পান্তা আর ইলিশের উদ্ভট সংস্কৃতি চালু হতে পারেনি। জনগণ সেটি গ্রহণ করেনি। প্রগতিবাদী বন্ধুদেরও বলবো, আর সচেতন মানুষদেরও বলবো, দেখুন তো বাংলা নববর্ষে পশ্চিম বঙ্গের কালিঘাটে কী হয়? আমাদের দেশে তো চৈত্র সংক্রান্তিকেও সার্বজনীন করার একটি চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটি সফল হয়নি। জনগণের হৃদয়তন্ত্রীতে যে সুর বেজে চলেছে সেই সুরের ঝঙ্কার না তুলে অপরিচিত কোনো সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ ব্যর্থ হতে বাধ্য।

https://dailysangram.com/post/522207