১৪ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩৭

ন্যায্যমূল্য পাবে না কৃষক

ধান ৩০ টাকা, চাল ৪৪ টাকা সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ সরকারের

সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোট সাড়ে ১৬ লাখ টন ধান-চাল কিনবে সরকার। ধান কেনা হবে কৃষকের কাছ থেকে, চাল সরবরাহ করবেন মধ্যস্বত্বভোগী তথা ব্যবসায়ীরা। সরকার এবার প্রতি কেজি বোরো ধান সংগ্রহের মূল্য নির্ধারণ করেছে ৩০ টাকা। কিন্তু সরকারি হিসাবেই প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ২৯ টাকার বেশি। ফলে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকারও টার্গেট অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সভাপতিত্বে গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। এবার ৪ লাখ টন ধান ও ১২ লাখ ৫০ হাজার টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রতি কেজি সেদ্ধ চালের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৪ টাকা। আগামী ৭ মে থেকে ৩১ আগস্ট, অর্থাৎ চার মাসে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সময় নির্ধারণ করেছে সরকার। বৈঠকে কেজি ৩৫ টাকা দরে ১ লাখ টন গম সংগ্রহের সিদ্ধান্তও হয়।

ধানের কম দর নির্ধারণ কৃষকের স্বার্থ পরিপন্থি বলে মনে করছেন প্রান্তিক চাষিরা। তাঁরা বলছেন, মিল মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় চালের দর নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ধানের ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বার্থ প্রতিফলিত হয়নি। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি কেজি চালে মিল মালিকদের ২ থেকে ৩ টাকার বেশি লাভ থাকবে। অন্যদিকে, সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে গেল কৃষককে ২ থেকে ৩ টাকা লোকসান গুনতে হবে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়া এলাকার কৃষক আলতাফ হোসেন সমকালকে বলেন, মিল মালিকরা সরকারের সঙ্গে দেন-দরবারের পর তাঁদের মতো করে চালের দাম বাড়িয়ে নেন। সেই সুযোগ কৃষকদের থাকে না। কৃষকদের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় ধানের বাজারদর সবসময় কম নির্ধারণ করা হয়। এবারও স্পষ্টতই কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন না।

তবে ধানের উৎপাদন মূল্য অনুযায়ীই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, এবার ধানের উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ২৯ টাকা। আমরা মনে করেছি, ধান-চাল কেনার ক্ষেত্রে আমরা সঠিক দাম নির্ধারণ করেছি। আশা করছি, সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারব। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এবার প্রতি কেজি বোরোর উৎপাদন খরচ হিসাব করা হয়েছে ২৯ টাকা ৫৩ পয়সা ও চালের ৪১ টাকা ৯৮ পয়সা। এই দুই ক্ষেত্রের তুলনামূলক চিত্র অনুযায়ী এবার ধানের দাম ৪৭ পয়সা আর চালের দাম ২.০২ টাকা বাড়ানো হয়েছে।

ধানের নতুন ধর কতটা যৌক্তিক হয়েছে হয়েছে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, সারাদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে এ দাম নির্ধারণ হয়। জমির ভাড়া, বীজতলা প্রস্তুত, বীজতলা থেকে চারা উত্তোলন, ক্ষেতে রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, পারিবারিক শ্রম, শ্রমিক খরচ, উপকরণ খরচ, সেচ, খড়ের দাম, ধানের কুঁড়ার দামসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় দাম নির্ধারণ করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এর পর নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভরা মৌসুমে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা যেভাবে ধান সংগ্রহ করেন, সরকারও সেভাবে করলে নতুন দাম ঠিক আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার তার গুদামে ধান সংগ্রহের জন্য বসে থাকে। সেখানে খরচ করে কৃষককে যেতে হয়। তাও সবার ধান রাখা হয় না। টাকা পরিশোধ করা হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। এসব কারণে সংগ্রহ মূল্য ৩০ টাকার বেশি হওয়া উচিত।

ড. জাহাঙ্গীর আরও বলেন, বেসরকারি কোম্পানি বা বড় আড়তদাররা যেমন কৃষকের মাড়াইখলা থেকে ধান সংগ্রহ করেন, ঠিক তেমনিভাবে সরকারেরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক ভালো হয়েছে। সরকার চাইলে এমন উদ্যোগ নিতে পারে। সব কৃষি উপকরণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এ পরিস্থিতিতে এক বিঘা জমিতে বোরো ধান উৎপাদনে ব্যয় কেমন– জানতে চাইলে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সাধুবাড়ী গ্রামের কৃষক গোলাম রব্বানী ও ফজলুর রহমান জানান, জমি প্রস্তুতের জন্য হালচাষ বাবদ ব্যয় ২ হাজার টাকা, টিএসপি ২০ কেজি ৪৮০ টাকা, এমওপি (পটাশ) ২০ কেজি ৪৮০ টাকা, ইউরিয়া ১০ কেজি ২২০ টাকা, জিপসাম ২০ কেজি ২২০ টাকা, দস্তা ১ কেজি ২০০ টাকা, সালফার ৩ কেজি ১০৫ টাকা, ম্যাগনেশিয়াম সার ৪ কেজি ১২০ টাকা। এরপর জমির আইল কাটা বাবদ শ্রমিক ব্যয় ২০০ টাকা। ধানের চারা রোপণ বাবদ ১ হাজার ২০০ টাকা। আগাছা প্রতিরোধে কীটনাশক ও ইউরিয়া ৫ কেজি বাবদ ২০০ টাকা। জমি নিড়ানি বাবদ শ্রমিক ব্যয় ৫০০ টাকা।

তারা জানান, দ্বিতীয় দফায় আবার ইউরিয়া সার ৩০ কেজি ৬৬০ টাকা, এমওপি (পটাশ) ১০ কেজি ২৪০ টাকা ও ড্যাপ সার ৫ কেজি ১০০ টাকা। জমি সেচ বাবদ ২ হাজার ৫০০ টাকা। প্রয়োজন অনুযায়ী কীটনাশক ব্যয় ১ হাজার ২০০ টাকা। ধান কাটা ও মাড়াই বাবদ ৪ হাজার টাকা এবং বীজ ও বীজতলা তৈরি বাবদ ১ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয়েছে মোট ১৫ হাজার ৬২৫ টাকা। আর বর্গাচাষিদের ক্ষেত্রে লিজ বাবদ আরও ৭ হাজার টাকা বৃদ্ধি পাবে।
এই দুই কৃষক আরও জানান, এক বিঘা জমিতে সর্বোচ্চ ২০ মণ ধান উৎপাদন হতে পারে। সরকারের গোডাউনে ধান দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা থাকতে হবে। চিটা থাকা যাবে না। এ ছাড়া নানামুখী হয়রানি তো আছেই।

ঘোলাগাড়ী গ্রামের কৃষক মতিয়ার রহমান জানান, এবারও সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, ওই দামে ধান সরবরাহ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে তাঁদের ৩০ টাকার ওপর খরচই হবে। তাই সরকারের গোডাউনে ধান দিতে গেলে তাঁদের লোকসান গুনতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সাত্তার মণ্ডলের মতে, সরকার যে দাম ঘোষণা করেছে, এতে প্রান্তিক কৃষকদের জন্য দাম ওঠানো কষ্টকর হবে। যাঁরা বেশি পরিমাণে ধান উৎপাদন করেন বা মজুত রেখে বিক্রি করতে পারেন, তাঁদের তুলনামূলক বেশি লাভ হবে। সাধারণ কৃষকদের কথা চিন্তা করলে দামটা কেজিপ্রতি দু-এক টাকা বেশি হলে ভালো হতো। তবে, বাজার স্থিতিশীল রাখতে ধানের দাম বাড়াতে সরকারকে একটু রক্ষণশীল থাকতে হয়।

গত বছর খোলাবাজারে ধানের দাম বেশি থাকায় সরকার লক্ষ্য অনুযায়ী ধান সংগ্রহ করতে পারেনি। এ কথা স্বীকার করে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, এবার ধানের দাম বাড়ানো হয়েছে। এমনিতেই বাজারে দামটা একটু বেশি আছে। আমরা যে দাম বাড়িয়েছি, তা বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকও পূরণ হয়নি গত বছর বোরো মৌসুমে ধান ২৭ টাকা ও চাল ৪০ টাকা কেজি নির্ধারণ করেছিল সরকার। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর বোরো মৌসুমে ৬ ছয় লাখ ৫০ হাজার টন ধান ও ১৩ লাখ ৬১ হাজার টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৪৮ টন ধান ও ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৪৭৯ টন চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও সংগৃহীত হয়নি। এবারের বোরো মৌসুমেও ধানের ক্ষেত্রে এমনটা হবে বলে মনে করছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা।

বর্তমানে ধান-চালের মজুত এবং দামের দিক থেকে তুলনামূলক স্বস্তিতে আছে সরকার। গতকালের হিসাব অনুযায়ী সরকারি গুদামে ১৭ লাখ ৩০ হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত আছে। সেই সঙ্গে বোরো ধান কাটা শুরু হওয়ায় মোটা এবং সরু উভয় চালের দাম কমতির দিকে রয়েছে।

 

 

https://samakal.com/bangladesh/article/2304167731