১৪ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩৬

রমজানেও থেমে নেই কিশোর গ্যাং

নৈতিক শিক্ষার অভাবে কিশোর অপরাধ বাড়ছে- কমান্ডার খন্দকার আল মঈন
রাত সাড়ে নয়টা তরাবির নামাজ চলছে। সকল মুসল্লি নামাজে মগ্ন। এমন সময় বাইরে ৪ কিশোর এক কিশোরকে মারতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ওই কিশোর মসজিদের অজুখানায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। তাতেও রেহাই মিলেনি। মারধরের এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যায় ওই কিশোর। নামাজ শেষে সাধারন মুসল্লি ওই কিশোরের মাথায় পানি ঢাললে জ্ঞান ফিরে এবং সে বেরিয়ে যায়। গত সপ্তাতে রাজধানীর চৌধুরীপাড়া মসজিদে ঘটেছে এমন ঘটনা। শুধু চৌধুরীপাড়া নয় পবিত্র রমজান মাসে রাজধানী জুড়েই চলছে ‘কিশোর গ্যাংয়ের এমন তৎপরতা। এরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় অপরাধ করছে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রশ্রয়ে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠা কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশি। তারা নানা অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

গোয়েন্দারা বলছেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাতে রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় সচেতন মহলসহ সবাই তৎপর না হলে এই গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এদের অপরাধের বিস্তার এতোটা দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে যে, আগামীতে কিশোর গ্যাংই হবে নগরবাসীর দুশ্চিন্তার বড় কারণ।

ডিএমপি পুলিশ কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, তথ্য প্রযুক্তির অপব্যবহারে কিশোর অপরাধ বেড়েছে। শুধুমাত্র আইনের আওতায় এনে কিশোর অপরাধ দমন সম্ভব নয়। এজন্য বাড়াতে হবে সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। অবিলম্বে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ ও অভিভাবকদের এই বিষয়ে সতচেতন হতে হবে।

তিনি বলেন, লেখাপড়া ছেড়ে দেয়া বিশেষ করে উঠতি বয়সি ছেলেরা নানাবিধ অপরাধ কর্মকাÐে জড়িয়ে পড়ে। তাদের পুলিশের পক্ষ থেকে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসুত্র বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গড়ে উঠছে এ সব কিশোর গ্যাং। তারা বিভিন্ন অপরাধ সংগঠনের পাশাপাশি নিজেদের একটা জগত তৈরি করেছে । পাড়া-মহল্লায় তৈরি হওয়া কিশোর গ্যাং নিজেদের তৈরি করা সাংকেতিক ভাষায় তথ্য আদান-প্রদান করে। বিগবস, নাইন এমএম, নাইন স্টার, ডিসকো বয়েজ ইত্যাদি নামে পরিচিত ‘কিশোর গ্যাং’ আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, চুরি, পাড়া বা মহল্লার রাস্তায় মোটরসাইকেলের ভয়ংকর মহড়া, মাদক এবং ইয়াবা সেবন ও বিক্রি, চাঁদাবাজি, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা এমনকি বিভিন্ন হত্যাকাÐের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ছে।

সূত্র জানায়, পুলিশের তালিকা অনুযায়ী রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি কিশোর গ্যাং রয়েছে মিরপুর এলাকায়। এ ছাড়া তেজগাঁও, উত্তরা, গুলশান, ওয়ারী, সায়দাবাদ, মতিঝিলে, রমনায়, লালবাগ, গাবতলী, মহাখালী, বাড্ডা, রামপুরা, আজিমপুর, হাতিরঝিলসহ বিভিন্ন এলাকায় তারা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এদের পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষক বা রাজনৈতিক গডফাদারদের নামও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো রাজনৈতিক ভাবে দেখা হচ্ছে। পুলিশের তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের রাজনৈতিক শেলটারদাতা বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অর্ধশত ব্যক্তির নাম উঠে এসেছে এ তালিকায়। কেউ কেউ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে সুবিধার জন্য সরকারি দলের সাইনবোর্ড এবং পদ-পদবিও নিয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীরা কিশোরদের ব্যবহার করে অপরাধ করায়। তারা মারামারি, জমি দখল, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে দল বড় করা, হিরোইজম দেখানো, ভয়ভীতি এবং এদের কেউ কেউ আবার মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেও এই কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম দিয়েছে। তা ছাড়া টিকটক ও নাটক-সিনেমার আড়ালে অপরাধ করার জন্যও এই গ্যাং তৈরি হয়।

কিশোর গ্যাং এর বিভিন্ন অপরাধ বিশ্লেষণের পর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক সময় অভিভাবকরা তাদের সন্তানের খোঁজ নেয় না। তারা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে তার খোঁজও নিচ্ছেন না। যার কারণে এমন অপরাধ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আবার কিশোর অপরাধ আইন ও ধারা অনুযায়ী বড় অন্যায় করেও পার পেয়ে যাচ্ছে অনেকেই। ছাড়া পেয়ে আবার যুক্ত হচ্ছে নতুন অপরাধে। আর ওই কিশোরের অপরাধের দায় ভোগ করতে হচ্ছে পরিবারকে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মসজিদ কমিটি থেকে স্কুল কমিটি, রাজনীতি, পরিবার সব জায়গায় দ্ব›দ্ব, মারামারি, কলহ। আমাদের শিশু-কিশোররা এ সব সংস্কৃতির মধ্যে বড় হচ্ছে। তাই তারাও নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিশোর অপরাধ কমাতে যারা দ্বায়িত্বপূর্ণ জায়গায় আছে তাদের আগে ঠিক করতে হবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ইনকিলাবকে বলেন, কিশোর অপরাধ বাড়ার পেছনে সব স্টেকহোল্ডারদের ভ‚মিকা আছে। মূলত সমাজের বিভিন্ন ছোটো ছোটো অপরাধ করতে করতেই কিশোররা বড় ধরনের অপরাধ করে থাকে। নৈতিক শিক্ষার অভাবে কিশোর অপরাধ বাড়ছে। তা ছাড়া পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে ভ‚মিকা রাখতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও কিছু ঘাটতি আছে। র‌্যাব রাজধানীসহ সারাদেশেই কিশোর গ্যাংদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।

ডিএমপির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, প্রচলিত শিশু আইনে কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া অনেকটাই জটিল ছিল। বর্তমান আইন অনুযায়ী কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হলেও তারা কতখানি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে সেটা এখনো প্রশ্ন সাপেক্ষ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে কিশোর অপরাধীরা অপরাধ করতে ইন্ধন পাচ্ছে। তবে কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে কোনও রাজনৈতিক চাপ নেই। গ্যাং কালচারের শিকার হয়ে ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো প্রাণ হারায় উত্তরা ট্রাস্ট কলেজের ছাত্র আদনান। এসব সদস্যরা খুন ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাÐে জড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট গ্রæপে আড্ডা, সেখান থেকেই সিনিয়র জুনিয়র দ্ব›দ্ব কিংবা কোনও কিছু নিয়ে মনোমালিন্য হলেই লেগে যায় মারামারি। এছাড়া নানা অপরাধমূলক কর্মকাÐের কারণে স্বার্থের দ্ব›দ্ব ছড়িয়ে পড়ে।

https://dailyinqilab.com/national/article/568737