১৪ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ১২:৩৫

খাদ্য উৎপাদন কমার শঙ্কা

কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে :: সারের দাম বাড়ানো মানে কৃষকের মরার অবস্থা :: কৃষকের আকুতি প্রতি বছর লোকসান দিলে বাঁচব কেমন করে :: কৃষিমন্ত্রীর আশাবাদ, সারের দাম বৃদ্ধিতে কৃষকের ওপর চাপ পড়বে, তবে উৎপাদন কমবে না
ইউরিয়া, টিএসপিসহ সব ধরনের সারের দাম হঠাৎ কেজিতে ৫ টাকা বৃদ্ধি করায় বাকরুদ্ধ কৃষক। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতে পুঁজির অভাবে লাখ লাখ কৃষক ধার দেনা করে চাষাবাদ করছে। বিদুৎ জ্বালানি তেল, কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষকের দিশেহারা অবস্থা। এর মধ্যে মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে সারের দাম আরেক দফা বাড়ানো হলো। বাড়তি দাম ১০ এপ্রিল থেকেই কার্যকর হয়েছে। সারের দাম বাড়ায় কৃষককে এখন বিঘাপ্রতি ধান চাষে বাড়তি খরচ গুনতে হবে ৩৬৪৫ টাকা। এতে করে মন প্রতি ধানের উৎপাদন খরচ পড়বে ১৩০০ টাকা থেকে ১৩৫০ টাকা। চলতি বছর সরকার ধানের দাম নির্ধারণ করেছে ৩০ টাকা কেজি অর্থাৎ ১২০০ টাকা মণ। সে হিসাবে প্রতিমণ ধানে কৃষককে লোকসান গুণতে হবে ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা। এতে কৃষক উৎপাদনে আগ্রহ হারাতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। অন্যদিকে সবজি ও অন্যান্য ফসলে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে ২২০০ টাকা। সে হিসাবে সারের মূল্যবৃদ্ধিতে কৃষককে ফসল উৎপাদনে বাড়তি ব্যয় করতে হবে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা।

সরকারের দেওয়া তথ্য মতে সারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বছরে সরকারের প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি কমবে। এ টাকা কৃষককেই গুনতে হবে। অর্থাৎ সারের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে ৭ হাজার কোটি টাকা। কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ওপর এর প্রভাব পড়বে। এর ফলে বেড়ে যাবে খাদ্যপণ্যের দাম। তাতে ভোক্তাদের উপরও বাড়তি খরচের চাপ পড়বে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে গত আট-নয় মাস ধরে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের ওপর দিয়ে একধরনের ঝড় বইছে। চড়া মূল্যে তারা কৃষি উপকরণ কিনে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে কোনোভাবেই তাল মেলাতে পারছেন না তারা। অনেক কৃষক পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। যেমনটি ঘটেছে এবার আলুর উৎপাদন ও বিপণনের ক্ষেত্রে। কৃষক চরম অসহায়। এরই মধ্যে সারের দাম বাড়ানো কৃষকের ওপর বাড়তি চাপ যুক্ত হলো। এমনিতেই ডিজেল, বিদ্যুৎ, বীজসহ সব কৃষি উপকরণের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে ফসল উৎপাদনে কৃষকের যখন হিমশিম অবস্থা, তখন বোরো মৌসুম শেষ হতে না হতে আবারো সারের দাম বাড়ানোর ঘোষণায় কৃষকরা চিন্তায় পড়েছেন। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কৃষকের জন্য ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সেচ ও পরিবহন খরচ বাড়ার সঙ্গে সারের এই বাড়তি দাম কৃষককুলকে চাপে ফেলবে। খরচ বাড়ার কারণে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বেড়ে যাবে কৃষিপণ্যের দাম। এতে নিত্যপণ্যের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে।

কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি মূল্যে সার বিক্রি করার জন্য মাঠপর্যায়ে যে নির্দেশনা দেয়া হয়, এতে বলা হয়, বৈশ্বিক সংকটের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্যারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় দেশে সার আমদানি অব্যাহত রাখা এবং সারের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নতুন মূল্য অনুযায়ী, ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের দাম ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ২২ টাকা থেকে ২৭ টাকা পুনর্নিধারণ করা হয়েছে। একইভাবে ডিএপি সারের মূল্য ডিলার পর্যায়ে ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১ টাকা করা হয়েছে। টিএসপি সারের মূল্য ডিলার পর্যায়ে ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে ২২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৭ টাকা করা হয়েছে। এমওপি সারের মূল্য ডিলার পর্যায়ে ১৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করা হয়েছে।
বর্তমানে কৃষকের এক বিঘা জমিতে ধান আবাদে সারের জন্য মোট খরচ ২ হাজার ৯৯০ টাকা। এর মধ্যে ৪০ কেজি ইউরিয়া সারে কৃষকের খরচ ৮৮০ টাকা, ৩০ কেজি ডিএপি ৪৮০ টাকা, ২৫ কেজি এমওপি ৩২৫ টাকা, ২০ কেজি জীপসাম ৬৭৫ টাকা, ৩ কেজি ম্যাগনেসিয়াম ৩০০ টাকা, ১ কেজি জিংক ১৮০ টাকা এবং ১ কেজি বোরণ কিনতে ব্যয় হয় ১৫০ টাকা। তবে দাম বাড়ানোর পর খরচ হবে ৩ হাজার ৬৪৫ টাকা। এর মধ্যে ৪০ কেজি ইউরিয়া সার কিনতে কৃষকের খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮০ টাকা, ৩০ কেজি ডিএপিতে ব্যয় ৬৩০ টাকা, ২৫ কেজি এমওপি ৪৭৫ টাকা, ২০ কেজি জীপসাম ৭৫০ টাকা, ৩ কেজি ম্যাগনেসিয়াম ৩৫০ টাকা, ১ কেজি জিংক ২১০ টাকা এবং ১ কেজি বোরণে ব্যয় হবে ১৫০ টাকা।

দেশে বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে বোরো মৌসুমে। বোরো উৎপাদনের ওপর সারা বছরের চালের বাজারের স্থিতিশীলতা নির্ভর করে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, চলতি বছর বেশিরভাগ স্থানেই বোরো ধান পাকতে শুরু করেছে। এ সময়ে খুব বেশি সারের ব্যবহার নেই। ফলে এ মৌসুমে কৃষকের ওপর চাপ না বাড়লেও ভুট্টা, সবজিসহ অন্যান্য ফসলে খরচের চাপ বাড়বে। এই মুহ‚র্তে সারের দাম বাড়ানোর প্রভাব না পড়লেও পরবর্তী সব মৌসুমেই, বিশেষ করে আসছে বর্ষাকলীন সবজিতে এর প্রভাব পড়বে। এই বাড়তি খরচ কৃষকের ঘাড়ে চাপবে, যা কৃষককে উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

কৃষকরা বলছেন, গত বছর বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি একেবারে কম হয়েছে। এতে সেচের ব্যয় বেড়েছে। এরপর রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট। এ অবস্থায় সারের দাম বাড়ানোয় তারা চোখে সরষে ফুল দেখছেন। সবকিছু মিলে এবার কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে। এতে কৃষকদের একটি অংশ জমি আবাদ কমানোর কথা বলছে। অর্থনীতিবিদ ও কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী মৌসুমে চালসহ কৃষিপণ্য এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পপণ্যের দাম বাড়বে।

বৃষ্টিহীন খরার মধ্য দিয়ে এবারের বোরো মৌসুম শুরু হয়েছে। রোপণের পরই ধানক্ষেতে সার ছিটিয়ে দেয়া হয়। এরই মধ্যে কৃষকের ঘাড়ে ইউরিয়া, ডিএপি, টিএসপি ও এমওপি সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানোর বোঝা চাপালো সরকার। কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের সারের দাম না বাড়ানোর আশ্বাসের পরও হঠাৎ দাম বাড়ায় কৃষকের মাথায় হাত।

নেত্রকোণার এক কৃষক বাবুল মিয়া বলেন, সার, কীটনাশক, ডিজেলসহ কৃষি উপকরণের দাম এভাবে বাড়লে আমাদের কী হবে? এমনিই তো সারের দাম বাড়তি। তার ওপর ধানের দাম কম। এখন যদি এমনভাবে আবারও সারের দাম বাড়তে থাকে, তাহলে কৃষকের তো কোনো উপায় থাকবে না। বস্তায় ৩০০ টাকা বাড়ার মানেতো কৃষকের মরার অবস্থা। তিনি বলেন, সারের দাম বাড়ানো মানে আমাদের লোকসান। সারের দাম যেহেতু বাড়ানো হয়েছে, সেহেতু ধানের দামও বাড়ানো হোক। আর যদি সারের দাম কমানো হয়, তাহলে ধানের দাম যা আছে তাতে আমাদের চলবে।

নরসিংদীর সবজি চাষী আবুল হাসেম বলেন, সবজি চাষ করে সংসার চলে। সারের দাম বেড়েছে বস্তায় ২৫০ টাকা। এর আগের বছর বস্তায় বেড়েছে ৩০০ টাকা। যদি বছর বছর সারের দাম এরকম বাড়ে তাহলে চাষ করবো কেমন করে। সারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি ফসলেরও দাম বাড়ে তাহলে সমস্যা হয় না। কিন্তু আমরা কষ্ট করে উৎপাদন করি দাম পাই না। গত বছর বেগুন করে ৫টাকা কেজি বিক্রি করতে হয়েছে। এতে আমার ২০ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। ধার দেনা করে চাষ করার পর যদি এমন হয় তাহলেতো আবাদ কমিয়ে দিতে হবে। প্রতিবছর লোকসান দিলে বাঁচবো কেমন করে।

কৃষকরা বলছেন, চলতি মৌসুমে উৎপাদন ব্যয় উঠবে কিনা-তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশি সমস্যায় আছেন বর্গাচাষিরা। তারা বলছেন, সারের দাম বৃদ্ধি এবং অনাবৃষ্টিসহ শ্রমিক ব্যয়, পরিবহন ব্যয় ও আনুষঙ্গিক যে ব্যয় হবে, তাতে লোকসান হবে। এর সঙ্গে তাদের নিজেদের শ্রমের মূল্য যুক্ত করলে লোকসানের পাল্লা আরও ভারী হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা আর এমওপি ৬০ টাকা। এর ফলে পাঁচ টাকা দাম বৃদ্ধির পরও সরকারকে প্রতি কেজি ইউরিয়াতে ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি দিতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, এই মুহ‚র্তে সরকার দেশে উৎপাদিত সারের থেকে আমদানিকৃত সার দিয়ে চাহিদা মেটাচ্ছে। গ্যাসের সংকটের কারণে সার কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত গ্যাস দেয়া যাচ্ছে না। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সারের ঘাটতি রয়েছে। সেটি আমদানি করে মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও সারের মূল্য বেশি। একই সঙ্গে সরকারের রিজার্ভে টানাপোড়ন রয়েছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী সার আমদানি করা যাচ্ছে না। এদিকে ডলার সংকট অন্যদিকে রাজস্ব আহরণে ঘাটতি। এমন পরিস্থিতিতে সরকার সারে যে ভর্তুকি দেবে, সেই পরিস্থিতিও নেই। সে সব বিবেচনায় সারের মূল্যবৃদ্ধি না করে সরকারের কোনো উপায় ছিল না। সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। যেহেতু কৃষকদের ব্যয় বাড়বে। বোরোসহ সামনে যে ফসলের মৌসুম রয়েছে সেগুলোরও ব্যয় বাড়বে। ফলে সারের বাড়তি মূল্যে প্রভাব পড়বেই। তবে আমি মনে করি, সারকে বাড়তি মূল্য দিয়ে আমদানি করতে হলেও সারের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। কৃষকও বাড়তি মূল্য দিয়ে সার কিনতে প্রস্তুত থাকবেন। যদি তার জন্য যথেষ্ট সার সরবরাহ করা যায়। মূল্যবৃদ্ধির পশাপাশি সারের সরবরাহ কোনোভাবে অপর্যাপ্ত না হয় বা ঘাটতি না পড়ে। কৃষক ফসল উৎপাদনে যেন সার কম না পায় সে জায়গায় নিশ্চিত করতে হবে। না হলে সারের সংকট হলে উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নয় মাসের মাথায় আবারো সারের দাম বাড়ানো মোটেই যৌক্তিক হয়নি। বৈশ্বিক খাদ্য সংকট চলাকালে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে সবার আগে আমাদের পর্যাপ্ত সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। দাম বাড়লে অনেক কৃষক উৎপাদন খরচ কমাতে আগের চেয়ে কম সার ব্যবহার করবে। এতে ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দাম বাড়ানোর কারণে কৃষকের ওপর চাপ পড়বে, তবে উৎপাদন কমবে না। আমরা চাইব, বীজ বা অন্যভাবে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে। আমি চাইনি কোনোভাবেই সারের দাম বাড়ুক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিল যে, দাম বাড়াতেই হবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, সারের দাম না বাড়াতে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাড়াতেই হলো।


 

https://dailyinqilab.com/national/article/568764