১২ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ৪:২২

ডলার সঙ্কট কাটছে না

এলসি খোলায় নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত, আমদানি কমেছে গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ
চলতি অর্থবছরের ৯ মাস ১০ দিনে সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
আগে নেয়া ঋণ পরিশোধের চাপ, নতুন বাণিজ্য ঋণ কমে যাওয়া এবং আশানুরুপ বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় কোনভাবেই ডলার সঙ্কট কাটছে না। এমনকি নানা নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থায় আমদানি কমালেও ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাজার সামলাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে চলতি অর্থবছরের ৯ মাস ১০ দিনে সাড়ে ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের রফতানি ও রেমিট্যান্সে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি আছে। আবার নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমদানি কমেছে ১০ শতাংশের বেশি। তবে আগে নেয়া ঋণ পরিশোধের চাপ, নতুন বাণিজ্য ঋণ কমে যাওয়া এবং আশানুরুপ বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় ডলার সঙ্কট কাটছে না। এর আগে, ২০২১-২২ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৬২ কোটি ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সূত্র মতে, ডলার সঙ্কট ও ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ির কারণে ফেব্রæয়ারি মাসে দেশে আমদানি কমেছে ৩৮ শতাংশ। গত বছরের ফেব্রæয়ারি মাসে আমদানি হয়েছিল ৮৩২ কোটি ডলারের পণ্য ও সেবা। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে যা ৫১৪ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। আমদানিতে এখন প্রতি ডলারে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০৬ টাকা। রফতানি বিল নগদায়ন হচ্ছে ১০৫ টাকায় আর ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় কিনছে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকায়। জানা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রæয়ারি সময়ে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৪ হাজার ৫৫১ কোটি ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৫ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলারের।

এদিকে ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমলেও ঋণপত্র নিষ্পত্তি এখনো অতটা কমেনি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রæয়ারি সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ হাজার ২০৯ কোটি ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১ দশমিক ২২ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল ৫ হাজার ২৬৬ কোটি ডলারের। জানা গেছে, চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে না পেরে অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে আনছেন বা সীমিত করছেন। অনেকেই আবার ব্যবসা পরিবর্তন করেছেন। এক বছর ধরে চলা ডলার সঙ্কটও এখনো কাটেনি।

এছাড়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের চাপে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ ধরনের ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ কমছে। গত এক মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১২৪ কোটি ডলার। এক বছরের হিসাবে কমেছে ১২৯৮ কোটি ডলার। যদিও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ১৬ কোটি ডলার। আগামী মাসের প্রথমদিকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে যেতে পারে।

সূত্র জানায়, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আগে প্রতিমাসে আমদানি বাবদ লাগত গড়ে প্রায় ৮০০ ডলার। এখন তা ৪৫০ থেকে ৪৭০ কোটিতে নেমেছে। আমদানি কমেছে গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ। নতুন এলসি খোলায় নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত। শুধু রোজাসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানিতে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। গত বছরের ফেব্রæয়ারির তুলনায় চলতি বছরের ফেব্রæয়ারিতে এলসি খোলা কমেছে ৩৬ শতাংশ। জুলাই থেকে ফেব্রæয়ারিÑআট মাসে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আমদানি কমেছে সাড়ে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ রফতানিশিল্পের কাঁচামাল আমদানি কম হয়েছে। এতে আগামী দিনে রফতানি কমে যেতে পারে। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকায় মন্দার কারণেও দেশের রফতানি আয় কমছে। এরপরও রিজার্ভের ওপর চাপ কমছে না। এর কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে গেছে। এসব ঋণ আগে পরিশোধের কথা থাকলেও করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে পরিশোধ স্থগিত করা হয়। এগুলো এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে আমদানি বাবদ বেসরকারি খাতের ঋণই সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ঋণও রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ সাধারণত ছয় মাস থেকে এক বছরের মেয়াদে নেয়া হয়। কোনো কারণে ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হলে ঋণদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে এর মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো যায়।

করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে ঋণ পরিশোধ করতে উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা কমায় এগুলো পরিশোধের মেয়াদ ইতোমধ্যে এক বছর থেকে দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। এখন ওইসব ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। বর্তমানে আমদানি বাবদ ও প্রকল্প ঋণ হিসাবে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ২১০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৩০০ কোটি ডলার এবং বেসরকারি খাতে ১৮০০ কোটি ডলার। মোট ঋণের মধ্যে ৫০০ কোটি ডলার প্রকল্প ঋণ হিসাবে দেয়া। বাকি ১৬০০ কোটি ডলার আমদানি খাতে নেয়া।

মোট ঋণের মধ্যে চলতি বছরে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১৬০০ কোটি ডলার। প্রতিমাসে গড়ে ১৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৭৫২০ কোটি ডলার। এর মধ্যে আগামী অর্থবছরে ২০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চলতি অর্থবছরে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৭০ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধ, আমদানি মেটাতে প্রতিমাসে গড়ে খরচ হচ্ছে ৭০০ কোটি ডলার। এর বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৬৭০ কোটি ডলার। প্রতিমাসে ঘাটতি থাকছে ৩০ থেকে ৫০ কোটি ডলার। এই ঘাটতি মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে চাপ পড়ছে রিজার্ভে। ঘাটতির কারণে রিজার্ভে ডলার যোগ হচ্ছে না। এদিকে আইএমএফ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ডলার গত ফেব্রæয়ারিতে পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছিল। পরে তা আবার কমতে থাকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার দেশের রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২২ কোটি ডলার। এর আগের সপ্তাহে তা নেমে গিয়েছিল ৩ হাজার ১০৬ কোটি ডলারে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রিজার্ভ বেড়েছে ১৬ কোটি ডলার। আলোচ্য রিজার্ভ থেকে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বাদ দিতে হবে। ওইসব অর্থ বিভিন্ন খাতের তহবিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এতে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ২ হাজার ৪২২ কোটি ডলার। এক বছর আগে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৪২২ কোটি ডলার। এক বছরের হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার ২৯৮ কোটি ডলার।

এদিকে রোজা ও ঈদের কারণে রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে। গত ছয় মাস পর রেমিট্যান্স ২০০ কোটি ডলারের ঘর ছাড়াল। তবে রফতানি আয়ের ধারা আবার নি¤œমুখী হয়েছে। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০ শতাংশই আসে রফতানি খাত থেকে, ২৮ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। বাকি ২ শতাংশ অন্যান্য খাত থেকে। এ কারণে রফতানি আয় কমে গেলে রিজার্ভে চাপ আরও বাড়বে।

গত অক্টোবরে রফতানি আয় ছিল ৪৩৬ কোটি ডলার। নভেম্বরে তা বেড়ে ৫০৯ কোটিতে ওঠে। ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে ৫৩৭ কোটি ডলারে ওঠে। জানুয়ারিতে আবার কমে ৫১৪ কোটি ডলারে নেমে যায়। ফেব্রæয়ারিতে তা আরও কমে ৪৬৩ কোটি ডলারে নামে। মার্চে তা ১ ডলার বেড়ে ৪৬৪ কোটি ডলারে ওঠে। গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে রফতানি আয় কমেছে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত বছরের মার্চে বেড়েছিল ৫৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চে বেড়েছিল সাড়ে ৩৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।


https://dailyinqilab.com/national/article/568369