১২ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ৪:১৬

ইউরিয়াসহ সব ধরনের সারের দাম বাড়ল

কৃষি উৎপাদনে খরচ বাড়বে
প্রভাব পড়বে নিত্যপণ্যের বাজারে
প্রায় সাড়ে ৮ মাস আগে কেজিতে ৬ টাকা করে ইউরিয়া সারের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। এ নিয়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে। এবার শুধু ইউরিয়া সার নয়, ডিএপি, টিএসপি এবং এমওপি অর্থাৎ সব ধরনের সারের দামই খুচরা এবং ডিলার পর্যায়ে কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গত সোমবার এই সিদ্ধান্তের কথা কৃষি মন্ত্রণালয়কে জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। গতকাল মঙ্গলবার কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় গণমাধ্যমকে। গত সোমবার থেকেই সারের নতুন দামের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কার্যকর বলে উভয় মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়। গত সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর সারের মূল্য পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি আদেশ জারি করা হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে সারের আমদানি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সারের মূল্য পুনর্নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’ আদেশ জারির তারিখ থেকে সারের মূল্য বৃদ্ধি কার্যকর হবে বলে আদেশে বলা হয়।

মূল্য বৃদ্ধির ফলে এখন ডিলার পর্যায়ে ২০ টাকা কেজির ইউরিয়া সার ২৫ টাকায় এবং খুচরা তথা কৃষক পর্যায়ের ২২ টাকার ইউরিয়া ২৭ টাকায় বিক্রি হবে। ডিলার পর্যায়ের ১৪ টাকার ডিএপি ১৯ টাকায় এবং কৃষক পর্যায়ে ১৬ টাকার ডিএপি ২১ টাকায় বিক্রি হবে। ডিএসপি ডিলার পর্যায়ে ২০ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকায় এবং কৃষক পর্যায়ে ২২ টাকার পরিবর্তে ২৭ টাকায় বিক্রি হবে। এমওপি সার ডিলার পর্যায়ে ১৩ টাকার পরিবর্তে ১৮ টাকায় এরং কৃষক পর্যায়ে ১৫ টাকার পরিবর্তে ২০ টাকায় বিক্রি হবে।

এর আগে গত বছরের ১ আগস্ট সারের মূল্য বৃদ্ধি করে আদেশ জারি করে সরকার। ওই সময় ইউরিয়া সারের দাম কেজিতে ৬ টাকা বাড়ানো হয়। তখন বলা হয়, ইউরিয়া সারের ব্যবহার যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা এবং চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ায় দেশে ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া সারের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্রতি কেজি ১৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা এবং কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২ টাকা পুনর্নির্ধারণ করেছে সরকার।

কথা রাখেননি কৃষিমন্ত্রী : গত ৩ এপ্রিল সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় সভাকক্ষে ‘সার বিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভা’ শেষে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছিলেন, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৫০০ টন সারের চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষি উৎপাদন বজায় রাখতে সারের দাম বাড়ানো হবে না। সারের কোনোরকম সঙ্কটও হবে না।

কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘গত চার বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারের দাম এক টাকাও বাড়াননি। অর্থ মন্ত্রণালয় বারবার আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছে যে, সারের দাম বাড়ান, আমরা অর্থ জোগাড় করতে পারছি না, আমরা অর্থ আপনাদের দিতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী অনড়, কিছুতেই তিনি সারের দাম বাড়াবেন না।’ তিনি বলেন, ‘এ পরিপ্রেক্ষিতে আজকেও আমরা আলোচনা করেছি। আমি আপনাদের বলতে চাই, এ বছরও আমাদের সারের দাম বৃদ্ধির কোনো পরিকল্পনা নেই। সারের দাম বাড়ানো হবে না।’

কিন্তু, এর এক সপ্তাহ পার হতে না হতেই সব ধরনের সারের দাম বাড়ানোর ঘোষণা এলো। গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয় জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি ইউরিয়া সারের বর্তমান দাম ৪৮ টাকা, ডিএপি ৭০ টাকা, টিএসপি ৫০ টাকা আর এমওপি ৬০ টাকা। এর ফলে ৫ টাকা দাম বৃদ্ধির পরও সরকারকে প্রতি কেজি ইউরিয়াতে ২১ টাকা, ডিএপিতে ৪৯ টাকা, টিএসপিতে ২৩ টাকা এবং এমওপিতে ৪০ টাকা ভর্তুকি প্রদান করতে হবে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো জানানো হয়, বিগত তিন বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম প্রায় ৩-৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে দেশে সারে প্রদত্ত সরকারের ভর্তুকিও বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ভর্তুকিতে লেগেছিল ০৭ হাজার ৪২০ কোটি টাকা; সেখানে ২০২১-২২ অর্থবছরে লেগেছে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রয়োজন হবে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সারে ২০০৮-০৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের এখন পর্যন্ত সর্বমোট এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছে।

দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার : গতকাল সচিবালয়ে নিজ দফতরের সামনে সাংবাদিকদের কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সারের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

মন্ত্রী বলেন, দাম বাড়ানোর কারণে কৃষকের ওপর চাপ পড়বে, তবে উৎপাদন কমবে না। আমরা চাইব বীজ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে কৃষকের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে। ‘আমি চাইনি কোনোভাবেই সারের দাম বাড়–ক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে শক্ত অবস্থানে ছিল যে দাম বাড়াতেই হবে। প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন সারের দাম না বাড়াতে, কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত বাড়াতেই হলো।’ তিনি বলেন, কিন্তু দাম যতটা বেড়েছে এটাও বৈশ্বিক পর্যায়ের তুলনায় বাড়েনি। তবে বিশ্ব বাজারে দাম কমে এলে সারের দাম সমন্বয় করা হবে। বোরো ধানের আগ পর্যন্ত সারের চাহিদা বেশি থাকে এরপর সারের চাহিদা কমে আসবে। তাই এই দামে খুব সমস্যা হবে না বলে উল্লেখ করেন কৃষিমন্ত্রী।

কৃষি উৎপাদনে খরচ বাড়বে : চলমান বোরো আবাদের ভরা মৌসুমে বাড়ানো হলো ইউরিয়াসহ সব ধরনের সারের দাম। এর ফলে কৃষককে অতিরিক্ত খরচ জোগাতে হবে আবাদে। এতে উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে। শুধু ধান নয়, সারের সাথে সব ধরনের কৃষি উৎপাদনের গভীর সম্পর্ক। শাকসবজি, ফলমূল থেকে শুরু করে সব ধরনের ফসল আবাদে সার ব্যবহৃত হয়। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমনিতেই কৃষিতে উৎপাদন খরচ বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিক চাষের মাধ্যমে কিছু কিছু ফসলে কৃষক কিছুটা লাভবান হলেও সারের দাম বৃদ্ধির ফলে সেখানেও ছাই পড়লো। সারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে কৃষিপণ্য শুধু নয় সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/741038