১২ এপ্রিল ২০২৩, বুধবার, ৪:১৫

ঈদকে সামনে রেখে সক্রিয় জাল নোটচক্র

গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে উদ্ধার জাল নোট

নাছির উদ্দিন শোয়েব: ঈদুল ফিতর সামনে রেখে জমে উঠেছে রাজধানীর মার্কেটগুলো। এরই মধ্যে জাল নোট তৈরি ও সরবরাহ করতে মজুদ শুরু করেছে চক্রের সদস্যরা। চক্রটি ঈদকে সামনে রেখে এক হাজার টাকার জাল নোট তৈরি করতে এরই মধ্যে তোড়জোর শুরু করেছে বলে তথ্য রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে। ছোট নোটের পরিবর্তে অধিক লাভের আশায় চক্রটি এক হাজার টাকার নোট তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে অন্তত তিন কোটি জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল একটি চক্রের। এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ এসব তথ্য নিশ্চিত হয়। এধরনের আরও কোনো চক্র জাল টাকা তৈরি করছে কিনা, বা কোনো চক্র জাল নোট বাজারে ছেড়েছে কিনা এ বিষয় মাথায় রেখে অভিযান শুরু করেছে র‌্যাব, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

রাজধানীর, নিউমার্কেট, গাউছিয়া, চাঁদনিচক, মৌচাক, গুলিস্তান মার্কেট ছাড়াও বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্কসহ বড় বড় শপিং মলে ঈদ কেনাকাটার ভিড়ে প্রতিদিন চক্রগুলো সক্রিয় থাকে জালনোট ছড়িয়ে দিতে। ঈদ বাজারে জাল টাকার নোট চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে কারবারিরা। ঈদের কেনাকাটার সময় তাড়াহুড়া ও ভাংতি নোটের প্রয়োজনীয়তার সুযোগ নেয় জাল নোট কারবারি চক্র। গত দুই বছর ঈদে কেনাকাটা কম হলেও এবার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে জাল নোট কারবারিরা। এদের অনেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে ছয় মাস আগে থেকে গোপন কারখানায় জাল নোট তৈরি শুরু করে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়িয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।

তদন্তকারীরা বলছেন, দ্রুত নিখুঁত জাল নোট তৈরি করতে বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করছে চক্রের সদস্যরা। তারা এখন পাঁচ শ ও এক হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ৫০ টাকার নোটও জাল করছে। জামিনে থাকা আরো কিছু চক্র জাল নোট ছাড়ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জাল নোট তৈরির চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর তারা জামিন নিয়ে এসে ফের এই ব্যবসায় জড়ায়। তাদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন খোদ আইনজীবীও। সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের মাধ্যমে জাল নোট চক্রের সদস্যরা ধরা পরার পর সহজে জামিনে এসে ফের জাল নোট তৈরি করে বাজারজাত করছে। শুধু তাই নয়, চক্রটি অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে পার্সেলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জাল নোট পৌঁছে দিচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা।

গত রোববার রাজধানীর ধলপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে জাল নোট চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, ঈদুল ফিতর সামনে রেখে অন্তত তিন কোটি জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল তাদের। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশিদ জানান, এক লাখ জাল টাকা পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ফুটপাতের দোকানিদের টার্গেট করে অভিনব কায়দায় ছড়িয়ে দেয়া হয় নকল টাকা। পুলিশের হাতে ধরা পড়া মহাজন কাওসার নামে এক কারবারি সাংবাদিকদের বলেন, ঈদের আগের এ সময়টায় জাল নোটের চাহিদা বেশি থাকে। টার্গেট মূলত ফুটপাতের দোকানিরা। তিনি আরও বলেন, সবেমাত্র জাল টাকা তৈরি করেছি। এরই মধ্যে আমি গ্রেফতার হয়েছি। আমি আর এ কাজ করব না, করেছি ভুল হয়েছে। আর করব না। যখনই সবকিছু গুছিয়ে আনি, তখনই গ্রেফতার হয়ে যাই। আর করব না, ভাই। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ধলপুরের একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ ৬৫ লাখ জাল টাকা এবং কয়েক কোটি টাকা ছাপানোর উপকরণ জব্দ করেছে। তিনি বলেন, ঈদ সামনে রেখে অন্তত তিন কোটি জাল টাকা বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা ছিল চক্রটির। এখন পর্যন্ত যত জাল টাকার কারবারি গ্রেফতার হয়েছে, সবাই একাধিক মামলার আসামি। জাল টাকার কোনো কোনো মহাজনের বিরুদ্ধে মামলা আছে ডজনেরও বেশি। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় কারাগারে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ করে তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও জড়ায় একই পেশায় বলে জানান এ কর্মকর্তা।

যা বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক: ধর্মীয় কোনো উৎসব বা বিশেষ দিনে অর্থ লেনদেনের হার স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। আর এই বাড়তি লেনদেনের সুযোগ নেই একটি চক্র। তাই অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, জাল নোট বিষয়ে আমাদের প্রথমেই মনে রাখা জরুরি, জাল নোটে জলছাপ অস্পষ্ট ও নিম্নমানের হয়। আসল টাকার নোটে ‘বাঘের মাথা’ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘মনোগ্রাম’ এর স্পষ্ট জলছাপ থাকে যা উভয়ই আলোর বিপরীতে দেখা যাবে। আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে আসল ব্যাংক নোট চিনতে ও জাল নোট প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় রমজান মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত ভিডিওচিত্র প্রদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

জাল নোট চিনবেন যেভাবে: এক. ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকাসহ প্রত্যেক ধরনের নোটের সামনে ও পেছন দু’দিকের ডিজাইন, মধ্যভাগের লেখা, নোটের মূল্যমান ও ৭টি সমান্তরাল সরল রেখা উঁচু নিচুভাবে মুদ্রিত থাকে। ফলে হাত দিলে একটু খসখসে মনে হয়। দুই. নোটের ডান দিকে ১০০ টাকার ক্ষেত্রে তিনটি, ৫০০ টাকার ক্ষেত্রে ৪টি ও এক হাজার টাকার নোটে ৫টি ছোট বৃত্তাকার ছাপ আছে যা হাতের স্পর্শে উঁচু নিচু লাগে। এ বৈশিষ্ট্য জাল নোটে সংযোজন করা সম্ভব নয়। তিন. জাল নোটের জলছাপ অস্পষ্ট ও নিম্নমানের হয়। আসল নোটে ‘বাঘের মাথা’ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘মনোগ্রাম’ এর স্পষ্ট জলছাপ আছে। যা ভালো করে খেয়াল করলে আলোর বিপরীতে দেখা যায়। চার. প্রত্যেক মূল্যমানের নোটেই বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো সংবলিত নিরাপত্তা সুতা থাকে। নোটের মূল্যমান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের লোগো নিরাপত্তা সুতার ৪টি স্থানে মুদ্রিত থাকে। এ নিরাপত্তা সুতা অনেক মজবুত যা নোটের কাগজের সঙ্গে এমনভাবে সেঁটে দেয়া থাকে যে নখের আঁচড়ে বা মুচড়িয়ে সুতা কোনোভাবেই উঠানো সম্ভব নয়। নকল নোটে এতো নিখুঁতভাবে সুতাটি দিতে পারে না। পাঁচ. ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের প্রত্যেক প্রকার নোটের উপরের ডানদিকে কোনায় ইংরেজি সংখ্যায় লেখা নোটের মূল্যমান রং পরিবর্তনশীল কালিতে মুদ্রিত থাকে। ফলে ১০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের নোট ধীরে ধীরে নড়াচড়া করলে মূল্যমান লেখাটি সোনালী থেকে সবুজ রং ধারণ করে। একইভাবে ৫০০ লেখা লালচে থেকে সবুজাভ হয়। অন্যদিকে জাল নোটের ব্যবহৃত রং চকচক করলেও তা পরিবর্তিত হয় না। ছয়. প্রত্যেক প্রকার টাকার নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান জলছাপ হিসেবে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মনোগ্রাম ও নোটের মূল্যমান প্রতিকৃতির তুলনায় উজ্জ্বল দেখায়। জাল নোটে এসব বৈশিষ্ট্য থাকে না। সাত. এছাড়া স্বল্পমূল্যেও বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন আছে। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে জাল নোট সহজেই পরীক্ষা করা যায়। জাল নোট ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখলে শুধু একটা রেখা দেখা যাবে।

https://dailysangram.com/post/521989