১১ এপ্রিল ২০২৩, মঙ্গলবার, ১২:৩৯

পাচার চক্রের ভয়ঙ্কর জালিয়াতি

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ভুয়া তথ্য দিয়ে বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণপত্র চাইতো কথক একাডেমি নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন ব্যক্তির নামে আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার পর ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে আমেরিকান ভিসার আবেদন করা হতো। যাদেরকে এম্বেসি ভিসা দিত তারা আমেরিকা গিয়ে গা ঢাকা দিত। অবৈধ হয়ে মার্কিন সরকারের কাছে আশ্রয় চাইতো। তার আগেই কথক একাডেমি নামের প্রতিষ্ঠানটি ওই ব্যক্তিদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিত জনপ্রতি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের সঙ্গে জালিয়াতি করে আসছিল একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র। চক্রটি জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় মানুষকে আমেরিকা পাঠিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। অথচ বাস্তবে নামসর্বস্ব কথক একাডেমির কোনো রেজিস্ট্রেশনও নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি জাতিসংঘের ইকোনমিক ও সোশ্যাল কাউন্সিলের স্পেশাল কনসালটেটিভ স্ট্যাটাস দাবি করে। ঢাকাস্থ আমেরিকান এম্বেসি এ ধরনের জালিয়াতির বিষয়টি বুঝতে পেরে মার্চ মাসে গুলশান থানায় একটি মামলা করে।

ওই মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে এই প্রতারক চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- আবুল কাশেম শেখ (৫৫), বখতিয়ার হোসেন (৩৫) ও মো. নজরুল ইসলাম (৪৫)। এদের মধ্যে আবুল কাশেম ভারত থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিনিউকেশনের উপরে ডিপ্লোমা করেছে। আর বখতিয়ার এসএসসি ও নজরুল ইসলাম বিএসএস পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে ৫টি মোবাইল ফোন, ১টি ল্যাপটপ, ১টি পিসি, প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা কথক একাডেমির ৩টি সিল, ১৩টি ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ১টি ওয়েবসাইট, ১টি ভিজিটিং কার্ড এবং কথক একাডেমির সিইও’র আইডি কার্ড। এছাড়া আবুল কাশেম শেখ এর বাসায় অভিযান পরিচালনা করে ৩১টি পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত পাসপোর্টগুলো আমেরিকা, হার্মান, জাপান, ইতালি, দুবাই ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে মানব পাচার ও প্রতারণায় ব্যবহার করা হয়। পাসপোর্ট উদ্ধার করে ভাটারা থানায় পাসপোর্ট আইনে ১টি মামলা করা হয়।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আবুল কাশেম কথক একাডেমির সিইও পরিচয়ে প্রতারণা ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। তার কথক প্রতিষ্ঠানের কোনো রেজিস্ট্রেশন নাই। ২০০৮ সাল থেকেই কাশেম বিভিন্ন রকম প্রতারণার কাজে জড়িত। ২০১২ সাল থেকে ১০-১২ লাখ টাকার বিনিময়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভিসা পাইয়ে আমেরিকা, জার্মানি, জাপান, ইতালি, দুবাই, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে প্রায় ৮০ জনকে পাচার করেছে। এরমধ্যে আমেরিকাতেই পাঠিয়েছে ২০ জনকে আর বাকি ৬০ জনকে অন্যান্য দেশে পাঠিয়েছে। প্রতারণা করে কাশেম এখন পর্যন্ত ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব টাকা দিয়ে বিলাসী জীবন-যাপন করতো। তার সহযোগী বখতিয়ার হোসেন বেকার ছিল। আর নজরুল একটি বেসরকারি হাসপাতালের সহকারী মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতো।

সূত্রমতে আবুল কাশেমের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে শাহবাগ থানা, ২০১৩ সালে পল্লবী থানায় মামলা হয়। গুলশান থানার মামলায় গ্রেপ্তারের পাশাপাশি পাসপোর্ট আইনেও তার নামে আরেকটি মামলা রুজু হয়েছে। আর বখতিয়ার ও নজরুলের নামে এর আগে কোনো মামলা ছিল না। আমেরিকান এম্বেসির মামলায় একইরকম প্রতারণার দায়ে এর আগে গোলাম কিবরিয়া (৪৩), সাজ্জাদ মো. রিফাত (২৮), শাহনেওয়াজ খান রাফাত (২৫) ও শাহীন আকন (২৭) গ্রেপ্তার হয়েছিল।

ডিবি সাইবারের কর্মকর্তারা বলেছেন, আবুল কাশেম শেখ একটি আন্তর্জাতিক মানব পাচার এবং প্রতারক চক্রের মূলহোতা। সে কথক একাডেমি নামক নামসর্বস্ব একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের আড়ালে মানব পাচার করতো। তার পরিচালিত কথক একাডেমি জাতিসংঘের ইকোনমিক ও সোশ্যাল কাউন্সিল এর স্পেশাল কনসালটেটিভ স্ট্যাটাস দাবি করে। সে ইকোনমিক ও সোশ্যাল কাউন্সিল এর বিভিন্ন কনফারেন্সসহ জাতিসংঘের অন্যান্য কনফারেন্সের বিজ্ঞপ্তির খোঁজ-খবর নিয়মিত রাখতো। কনফারেন্সের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে কথক একাডেমির বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ে কনফারেন্সে যোগদানের জন্য সদরদপ্তরে ই-মেইল পাঠাতো। ভারত থেকে ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন বিষয়ে পড়াশোনা করার কারণে তার ইংরেজিতে কথা বলা ও লেখায় পারদর্শিতা ছিল। কথক একাডেমির নামে মিথ্যা তথ্য উপাত্ত যুক্ত করে কনফারেন্সে যোগদানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আমন্ত্রণপত্র চাইতো। যাদের নামে আমন্ত্রণপত্র আসতো তাদের পাসপোর্ট ও বিভিন্ন ভুয়া কাগজপত্রসহ ঢাকাস্থ আমেরিকান এম্বেসিতে জমা দিয়ে ভিসা আবেদন করতো।

সাইবারের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, চক্রটির উদ্দেশ্যই ছিল জাতিসংঘরে আমন্ত্রণপত্র কাজে লাগিয়ে কথক একাডেমির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী নামধারী ব্যক্তিদের নামে ভিসা ইস্যু করা। প্রকৃতপক্ষে ওই ব্যক্তিরা ছিল তার ক্লায়েন্ট। যাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে আমেরিকা পাঠায়। এছাড়া সে প্রতারণা করে তার প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব সুলতান মাহমুদের নাম-পরিচয় এবং তার স্বাক্ষর জাল করে আমেরিকান এম্বেসিতে চিঠি পাঠাতো। যাতে করে এম্বেসি থেকে ভিসা পাওয়া সহজ হয়।

তদন্ত কর্মকর্তারা বলেন, চক্রটি সাত ধাপে তাদের প্রতারণার প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়ন করে। প্রথমে তাদের দালালদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানের বাসিন্দা যারা আমেরিকা বা উন্নত দেশে যেতে আগ্রহী এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে চুক্তিতে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে। যারা পাসপোর্ট দেয় তাদেরকে কথক একাডেমির স্টাফ হিসেবে বিভিন্ন ডকুমেন্ট তৈরি করে। তারপর জাতিসংঘ সদর দপ্তরের ইকোনমিক এবং সোশ্যাল কাউন্সিলের বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগদানের জন্য তাদের সদর দপ্তরে রেজিস্ট্র্রেশন করে। রেজিস্ট্র্রেশনের পর যাদের জন্য ভিসা ইস্যু করবে তাদেরকে কথক একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিচয়ে যোগদানের অনুমতির জন্য ই-মেইল করে। জাতিসংঘের সদরদপ্তর অনুমতি দিলে সকল কাগজপত্রসহ আমেরিকান এম্বেসিতে ভিসার আবেদন করে পাসপোর্ট জমা দেয়। এম্বেসি তাদের সাক্ষাৎকার ও ফিঙ্গার নিয়ে তিন মাস মেয়াদি ভিসা প্রদান করে। ভিসা পাওয়ার পর ওই ব্যক্তিরা আমেরিকা গিয়ে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অবৈধভাবে আমেরিকায় থেকে যায়।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জুনায়েদ আলম সরকার মানবজমিনকে বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগদানের কথা বলে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ভুয়া তথ্য দিয়ে ই-মেইল পাঠিয়ে আমেরিকান ভিসা সংগ্রহকারীদের বিরুদ্ধে এম্বেসি কর্তৃপক্ষ মার্চ মাসে একটি মামলা করেছিল। ওই মামলায় আগেই চারজনকে গ্রেপ্তার হয়। পরে এই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের মূলহোতা কাশেমকে ৩ এপ্রিল ও ৮ই এপ্রিল তার সহযোগী বখতিয়ার ও নজরুলকে গ্রেপ্তার করি। তিনি বলেন, প্রতারকদের এ ধরণের কাজে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে। এতে করে যারা সঠিকভাবে আমেরিকান ভিসা প্রাপ্তির আবেদন করেন তারা নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হন। পাসপোর্টে জাল ভিসা বা সিল ব্যবহার করা দেশের আইনে অপরাধ। তাই এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করলেই আমেরিকান ভিসা পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করে না। ভিসা পাওয়ার জন্য সঠিক তথ্য দিতে হবে।

https://mzamin.com/news.php?news=50787