৯ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ২:২৫

জাহাজ পরিবহণে মহামন্দা

চট্টগ্রাম বন্দরভিত্তিক কর্মকা-ে অস্বাভাবিক ভাটা পড়েছে। রোজায় ও ঈদকালীন ব্যস্ততার যে তোড়জোড় প্রতিবছর লক্ষ্য করা যায় এখন তা কোথাও নেই। বন্দরের জেটি-বার্থ, মুরিং, লাইটারিং ঘাট, ইয়ার্ড-শেড থেকে শুরু করে বহির্নোঙর, লাইটার জাহাজ-কোস্টার-ট্যাংকার, ঘাট, গুদাম, বেসরকারি কন্টেইনার ডিপো (আইসিডি) অনেকটাই ফাঁকা। শিপিং লাইন্স, জেটি-বার্থ অপারেটর, কাস্টমস সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, স্টিভিডোরিং, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, পরিবহণ এজেন্ট ইত্যাদি খাত-উপখাতে চলছে ভাটার টান।

এক বছরের ব্যবধানে বন্দর দিয়ে প্রায় সোয়া ২ হাজার প্রকারের পণ্যসামগ্রীর আমদানি হ্রাস পেয়েছে। আমদানি প্রবাহ কমেছে পণ্যভেদে ১০ থেকে ২২ শতাংশ। আমদানি হ্রাস পাওয়ায় কমছে সরকারের রাজস্ব আয়ও। বন্দরের জেটি-বার্থ ও ইয়ার্ডের ভেতরে-বাইরে যন্ত্র-যানের ছোটাছুটি কম। শ্রমিকদের হাঁকডাকও কম। সামগ্রিকভাবে জাহাজ পরিবহণ বাণিজ্যে বিরাজ করছে মহামন্দা।
ডলার সঙ্কট, দেশ থেকে অব্যাহতভাবে অর্থ পাচার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের টালমাটাল অবস্থায় কমে গেছে আমদানি। সেই সাথে ডলার ও রিজার্ভ সাশ্রয়ের জন্য সরকার অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য আমদানি কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহিত করছে। যার সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়েছে বন্দর-শিপিং খাতে। দৈনিক শত কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। আমদানি খোলা সাধারণ পণ্য (ব্রেক বাল্ক কার্গো) ও শিল্পের কাঁচামাল নিয়ে বহির্নোঙরে অবস্থানকারী বড় জাহাজসমূহ (মাদার ভেসেল) থেকে লাইটারিং পদ্ধতিতে খালাস করে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে নৌ-বন্দরগুলোতে পরিবহণ করে থাকে অন্তত ২ হাজার লাইটার জাহাজ, কোস্টার, নৌযান।

সেখানে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক-কর্মী নিয়োজিত। আগে প্রতিটি লাইটার জাহাজ মাসে গড়ে ২ থেকে ৩টি ট্রিপ পেতো। এখন এক থেকে দুই মাসে একটি ট্রিপ মিলছে না। এরফলে অলস ভাসছে ৮০০ লাইটার জাহাজ। লোকসানের মুখে স্ক্র্যাপ হিসেবে ইতোমধ্যে বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৫৫০টি। অর্ধেকেরও বেশি লাইটার ‘নেই’ হয়ে গেছে। হাজারো শ্রমিক-কর্মচারি বেকার অথবা অলস বসিয়ে রেখে বেতন গুনতে হচ্ছে। বকেয়া পড়েছে বিপুল অঙ্কের বেতন-মজুরি। মানবেতর জীবনযাপন করছেন শ্রমিকরা। লাইটার জাহাজ ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে বিরাট অঙ্কের দায়-দেনার ভারে দিশেহারা মালিকেরা। এই খাতের মালিক ও শ্রমিকরা সরকারের কোন প্রণোদনা পাচ্ছেন না।

বন্দরের আমদানি ও রফতানি কন্টেইনার মিলিয়ে প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি ডিপোতে (অফডক) হ্যান্ডলিং করা হয়। ২০টি ডিপোতে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োজিত। শিপিং বাণিজ্যে মন্দার ধাক্কা পড়েছে ডিপোতে। বেসরকারি ডিপোগুলো এখন টিকে থাকা চেষ্টা করছে। আমদানি হ্রাসের প্রভাবে মন্দাদশায় পরিবহণ খাতও। স্বাভাবিক সময়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দৈনিক গড়ে ৭ থেকে ৯ হাজার ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন করে থাকে। তা এখন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। পরিবহণ শ্রমিকরাও বেকার কিংবা অর্ধবেকার হচ্ছেন।

এ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, সরকারের নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গ্রহণের ফলে আমদানি কমে গেছে। তবে ডলার সঙ্কট মোকাবেলা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সাশ্রয় করার জন্য বিলাসজাত, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া উপায়ও ছিল না। এ কারণে বন্দর-শিপিং কর্মকা-, শ্রমিকদের কাজের উপর মন্দার বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।

আমদানি হ্রাসের ফলে গভীর সঙ্কটে পড়েছে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী লাইটারেজ জাহাজ, কোস্টার ও নৌযানে পণ্য পরিবহণ। ট্রিপের অপেক্ষায় দুই মাস ধরে নোঙর করে আছে এমন জাহাজও আছে। এ অবস্থায় দুই হাজার জাহাজে কর্মরত প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারী ছাড়াও এই খাত সংশ্লিষ্টরা মহাসঙ্কটে রয়েছে। বেতন-মজুরি বকেয়া পড়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে অনেকে। সামনে ঈদে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ নিয়ে বিপাকে জাহাজ মালিকরা।

আমদানি হ্রাসের শঙ্কা আগে থেকেই ছিল। ডলার সঙ্কটে ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসজাত পণ্য ও জরুরি নয় এমন সব পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করে। এতে করে এলসি খোলা হ্রাস, আমদানি হ্রাস এবং বন্দরকেন্দ্রিক কর্মকা-ে ভাটা পড়ে। আমদানি-রফতানিতে টান পড়লে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের আগমন হ্রাস পায়। প্রায়ই খালি থাকছে বন্দরের একাধিক জেটি ইয়ার্ড। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বন্দরে ৩২ লাখ ৪২ হাজার ১৭১ টিইইউএস কন্টেইনার এবং ১২ কোটি ৮২ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫৪ মেট্রিক টন পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১০ ভাগ কম।

আমদানি কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আহরণও কমেছে। গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত অর্থ বছরের নয় মাসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ৪৪ হাজার ২২৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা কম।

চট্টগ্রাম বহির্নোঙরে বড় জাহাজে আনীত আমদানি ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল ছোট লাইটার জাহাজ বহরে অভ্যন্তরীণ নৌরুটে দেশের বিভিন্ন নৌ-বন্দর ও ঘাটে খালাস করা হয়। নৌপথে প্রতিবছর ছয় কোটি টনেরও বেশি পণ্য পরিবাহিত হয়। এর মধ্যে আছে সিমেন্ট ক্লিংকার, সিরামিক, র-সুগার, চাল, গম, ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল, সার, কয়লা, পাথর, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল, ভোজ্যতেল ও হরেক ভোগ্যপণ্য।

চট্টগ্রাম বন্দর বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলীর ১৬টি ঘাট, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, ঢাকা, আশুগঞ্জ, মীরপুর, নগরবাড়ি, নওয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের নৌ-বন্দরগুলোতে লাইটার জাহাজ-ট্যাংকারে পণ্য পরিবহণ করা হয়। আমদানি হ্রাসের কারণে এখন অর্ধেক জাহাজ অলস বসে আছে।

অভ্যন্তরীণ নৌপথে জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ডব্লিউটিসির নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশীদ বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক প্রায় দুই হাজার লাইটার জাহাজ রয়েছে। আমদানি কমে যাওয়ায় আটশ’র বেশি জাহাজ কাজ না পেয়ে অলস বসে আছে। যেখানে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০টি জাহাজ বুকিং হত সেখানে এখন ২০ থেকে ২৫টি জাহাজও বুকিং পাচ্ছে না। আগে মাসে যেখানে দুটি ট্রিপ পাওয়া যেত এখন দুই মাসেও একটি জাহাজ কোন ট্রিপ পাচ্ছে না।

এতে করে ব্যবসা চালু রাখা মালিকদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। গত দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে ৫০০ থেকে ৫৫০ লাইটার জাহাজ স্ক্র্যাপ হিসেবে কেটে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। বেতন-ভাতা বকেয়া থাকায় শ্রমিকেরাও সঙ্কটে পড়েছে।

https://dailyinqilab.com/national/article/567777