২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৪০

এক টন সার উৎপাদনে ২৫ হাজারের বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে ৪৪ হাজার ঘনফুট গ্যাস

দেশের সব সারকারখানায় বিপুল পরিমাণের গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। সারখানায় যে পরিমাণের গ্যাসের অপচয় হচ্ছে তা দিয়ে প্রতিদিন ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানদ-ে প্রতি টন ইউরিয়া সার উৎপাদনে গ্যাসের প্রয়োজন হয় ২৫ হাজার ঘনফুট। অথচ বাংলাদেশে এক্ষেত্রে গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে গড়ে ৪৪ হাজার ঘনফুট। গ্যাসের এমন অপচয়ের কারণে অদক্ষ সারকারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত ১৫ এপ্রিল বাখরাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ আশুগঞ্জ সারকারখানা বন্ধ রাখতে চিঠি দেয়। ফলে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সারকারখানা উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
আশুগঞ্জ সারকারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএস কামরান জানান, বুধবার (১৫ এপ্রিল) সকাল ১০টা থেকে ইউরিয়া সার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ কারণে আশুগঞ্জ সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে। কবে থেকে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হবে তা নিয়েও কিছু জানায় নি বাখরাবাদ গ্যাস কর্তৃপক্ষ।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অদক্ষ সার কারখানা বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বরাবর সারসংক্ষেপ প্রেরণ করা হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, সার কারখানায় গ্যাস দেয়া মানেই অপচয়। নানা চেষ্টা করেও এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব হচ্ছে না। সার কারখানায় যে হারে লোকসান হচ্ছে, তার চেয়ে সার আমদানি সাশ্রয়ী। এজন্য অদক্ষ কারখানাগুলো বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সংশি¬ষ্টরা বলছেন, সরকার ইউরিয়া ব্যবহার কমানোর প্রতি জোর দিচ্ছে। এছাড়া গ্যাস স্বল্পতার কারণে আবাসিক ও শিল্প-কারখানায় গ্যাস সংযোগ প্রদান কয়েক দফা বন্ধ করে সরকার। আর নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে বর্তমান রিজার্ভ শেষ হবে আট-নয় বছরের মধ্যে। এজন্য ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকছে সরকার। এতে আগামীতে গ্যাসের দাম অনেক বেড়ে যাবে। এ যুক্তিতে বাড়ানো হচ্ছে গ্যাসের দাম। এ অবস্থায় অদক্ষ সব সার-কারখানা এখনই বন্ধ করা উচিত।
বৈঠকে জানানো হয়, দেশে বর্তমানে সার উৎপাদনের পরিমাণ ২৩ লাখ ৭৫ হাজার টন। এজন্য দৈনিক গড়ে ১৩ কোটি ঘনফুট গ্যাস অপচয় হয়। অথচ এ গ্যাস দিয়ে দৈনিক ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। পুরোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না করায় দেশের সব সার কারখানায় গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি পরিচালন দক্ষতারও অভাব রয়েছে।
এর মধ্যে কয়েকটি কারখানার অবস্থা বেশি খারাপ। এজন্য সার কারখানায় গ্যাসের অপচয় নিয়ে উদ্বিগ্ন জ্বালানি মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে অদক্ষ সার কারখানাগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইউরিয়ার চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনে সার আমদানি বাড়ানো হবে। এজন্য বৈঠকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিল্প মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের সবচেয়ে অদক্ষ সার কারখানা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের ন্যাচারাল গ্যাস সার কারখানা। এতে প্রতি টন ইউরিয়া উৎপাদনে অপচয় হচ্ছে ৭৬ হাজার ঘনফুট গ্যাস। এরপর রয়েছে নরসিংদীর পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা। এতে প্রতি টন ইউরিয়া উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় ৫৭ হাজার ঘনফুট গ্যাস। ফলে প্রতি টনে ৩২ হাজার ঘনফুট গ্যাস অপচয় হয়। একই অবস্থা ঘোড়াশালের ইউএফএফএলের (ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড)। এতে প্রতি টন সার উৎপাদনে অপচয় হয় ৩০ হাজার ঘনফুট গ্যাস। আর চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানায় অপচয় হয় ২৬ হাজার ঘনফুট।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সার উৎপাদনে কোনো কারখানাই দক্ষ নয়। এমনকি সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে গত বছর জানুয়ারিতে চালুকৃত দেশের সর্ববৃহৎ (শাহজালাল) সার কারখানায়ও ইউরিয়া উৎপাদনে গ্যাস অপচয় হয়। তবে এক্ষেত্রে অপচয়ের হার ন্যূনতম। কারখানাটিতে প্রতি টন সার উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করা হয় ২৮ হাজার ঘনফুট। তবে এটি আন্তর্জাতিক মানদ-ের কাছাকাছি।
দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সার উৎপাদনে গ্যাসের অপচয় বন্ধের কোনো নজিরই নেই দেশে। এমনকি বহুজাতিক সার-কারখানা কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) প্রতি টন সার উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করছে ৩৪ হাজার ঘনফুট, আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে নয় হাজার ঘনফুট বেশি। এছাড়া যমুনা সার কারখানায় প্রতি টন ইউরিয়া উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় ৩৭ হাজার ঘনফুট গ্যাস। এতে অপচয় ১২ হাজার ঘনফুট। আশুগঞ্জ সার কোম্পানিতে গ্যাস অপচয় হয় প্রতি টনে ২০ হাজার ঘনফুট।
এ অপচয় কমানোর সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম. তামিম। তিনি বলেন, জ্বালানি দক্ষতা (এনার্জি এফিসিয়েন্সি) না থাকার কারণে দেশে বিভিন্ন খাতে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম সার কারখানাগুলো। একসময় কাফকো দক্ষ হিসেবে পরিচালিত হতো। তবে বহুজাতিক এ কোম্পানিটিও অদক্ষ হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। পাশাপাশি আয়ুষ্কাল শেষে যন্ত্রপাতি বা যন্ত্রাংশ পুনঃস্থাপন করতে হবে। পাশাপাশি কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা দক্ষভাবে গ্যাস ব্যবহার করতে পারেন।
এদিকে ইউরিয়া সারের মূল্য বৃদ্ধিতে চলতি মাসে কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে প্রতি টন ইউরিয়ার মূল্য ১৮ হাজার টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে এর দাম রয়েছে ১৪ হাজার টাকা। এতে প্রতি টনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের লোকসান হচ্ছে বলে প্রস্তাবে বলা হয়। এছাড়া ইউরিয়া ব্যবহার কমানোর প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে কৃষিতে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহারে কয়েক বছর ধরেই কৃষককে সচেতন করে আসছে সরকার। এতে গত অর্থবছর ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমেছে ৩ লাখ ৪৭ হাজার টন। এতে সাশ্রয় হয়েছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৩২০ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে দৈনিক ২৫০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর মোট গ্যাসের প্রায় ৪৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। এছাড়া শিল্প-কারখানায় ৩১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, গৃহস্থালিতে ১৪ দশমিক ৩১, সার-কারখানায় ৫ দশমিক ১৮ ও সিএনজিতে ব্যবহার হয় ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ গ্যাস।

http://www.dailysangram.com/post/280611-