৮ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ১১:০১

বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে

৭ মাসে ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ৭৭ শতাংশ

সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে তুলে নেয়ার হার বেড়ে গেছে। এতে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ না বেড়ে বরং কমে গেছে। কাক্সিক্ষত হারে বিদেশী ঋণও অবমুক্ত হচ্ছে না। রাজস্ব আদায়েও ভাটা পড়ে গেছে। এর ফলে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে একমাত্র ভরসা এখন ব্যাংকঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংকঋণ বেড়েছে ৭৭ শতাংশ। যে হারে ব্যাংকঋণ বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

জানা গেছে, সরকার এক বছরে যে পরিমাণ ব্যয় করবে তার সমপরিমাণ আয় করে না। ব্যয়ের চেয়ে আয় যেটুকু কম থাকে তাই ঘাটতি বাজেট। আর এ বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী উৎস থেকে ঋণে নিয়ে থাকে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংকিং খাত ও ব্যাংকের বাইরের খাত থেকে ঋণ নেয়া হয়। ব্যাংকের বাইরের খাতের মধ্যে সঞ্চয়পত্র অন্যতম।

নানা কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। প্রতি মাসেই যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হচ্ছে, প্রত্যাহার করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হারে। এর ফলে নিট বিনিয়োগ ঋণাত্মক হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, সাত মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয়েছে ৪৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে মুনাফাসহ উত্তোলন হয়েছে ৫১ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে নিট বিনিয়োগ না বেড়ে বরং কমেছে তিন হাজার ৬৯ কোটি টাকা। যেখানে গত বছরের আলোচ্য সময়ে নিট বিনিয়োগ হয়েছিল ১২ হাজার ১৬৬ কোটি টাকা। ৭ মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ১২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ওপর চলতি বছর থেকেই কড়াকড়ি করা হয়েছে। আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কর শণাক্তকারী নম্বর বা টিআইএন দাখিল করতে হতো না; কিন্তু এখন তা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি রিটার্ন দাখিলের সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। অপর দিকে সব ধরনের পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে ওই হারে মানুষের আয় বাড়ছে না।

ফলে অনেকেই অভাবের তাড়নায় বিকল্প কোনো উপায় না পেয়ে জমানো অর্থে হাত দিচ্ছে। প্রত্যাহার করা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগ চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে যেখানে হয়েছে ৪৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা, সেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬১ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ আলোচ্য সময়ে সঞ্চয়পত্রে বিক্রি কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ।

এ দিকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমার পাশাপাশি বিদেশী ঋণের ছাড়ও কমে গেছে। যেখানে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা সেখানে তা না হয়ে বরং সাত মাসে বিদেশী ঋণের অবমুক্তি কমেছে ১৭৫ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিদেশী ঋণ অবমুক্তি হয়েছে ৩২ হাাজর ৩৬৫ কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা।

এ দিকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে নেমে গেছে, অপর দিকে কমেছে বিদেশী ঋণের অবমুক্তি। এর ফলে সরকার বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকিং খাত থেকে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১১ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে ১৯ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণ বেড়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, এমনিতেই কিছু কিছু ব্যাংকের টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অনেক ব্যাংক বাধ্যতামূলক নগদ জমার হার অর্থাৎ সিআরআর সংরক্ষণ করতে পারছে না। এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংক থেকে অতিমাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি কাথে বিনিয়োগ আরো সঙ্কোচিত হয়ে যাবে। টাকার চাহিদা বেড়ে গেলে সুদহারও বেড়ে যাবে। এ থেকে উত্তোরণের জন্য অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে। কারণ, রাজস্ব আদায়েরও গতি নেই। ফেব্রুয়ারিতে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.০৭ শতাংশ। যেখানে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। ডলার সঙ্কটের কারণে এলসি খোলার হার কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যেখানে পণ্য আমাদনির জন্য এলসি খোলার হার বেড়েছিল প্রায় ৫০ শতাংশ, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে তা না বেড়ে বরং প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩৮ শতাংশ। আমদানি কমায় শুল্ক থেকে আয় ব্যাপক হারে কমে গেছে। এ সঙ্কট সহসাই কাটছে না। বরং বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় ঠিক রাখতে হলে ব্যাংক খাত থেকে অধিক মাত্রায় ঋণ নিতে হবে। আর তা হলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/740068