৮ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ১০:৫৯

বঙ্গবাজার ট্র্যাজেডি

সব হারিয়ে এখন তারা খোলা আকাশের নিচে

ব্যবসায়ী মাছুম রানা বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই জানালেন, দোকানের সব পুড়ে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই। দোকানের বাকির খাতাটি খুঁজছেন তিনি, যদি পাওয়া যায়।

যারা মাছুমের কাছ থেকে বাকিতে মালামাল নিয়েছেন, তাদের মোবাইল নম্বরসহ বিস্তারিত লেখা ছিল ওই খাতায়। ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার মালামাল তিনি বাকিতে দিয়েছিলেন। খাতাটি পেলে হয়তো সেই পাওনা টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারতেন। মাছুম রানা যখন বাকির খাতাটি খুঁজছিলেন, তখন তার হাত ধরেছিল আট বছর বয়সী মাইশা ইসলাম মাহী। ছোট্ট মাইশা বাবার সাথে দোকানে আসার বায়না ধরত প্রায়ই।

গতকাল শুক্রবার সকালেও সে বায়না ধরেছিল বাবার সাথে বের হবে। তাই মেয়েকে নিয়েই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিনি বঙ্গবাজারে আসেন।

মাছুম রানা জানান, তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের সপুরা গ্রামে। তার বাবা একজন ভূমিহীন কৃষক ছিলেন। পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। দারিদ্র্যের কারণে অষ্টম শ্রেণীর পর আর লেখাপড়া করতে পারেননি। জীবিকার তাগিদে এক মামার হাত ধরে ২০০৩ সালে তিনি বঙ্গবাজারে কাপড়ের দোকানে কাজ নেন। ১০ বছর তিনি বঙ্গবাজারে দোকানকর্মীর কাজ করেছেন। ২০১৩ সালে তিনি একটি দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। বঙ্গবাজারে চারটি দোকানে তার বিনিয়োগ ছিল প্রায় এক কোটি টাকা। তার সব ক’টি দোকানই মাছুম নিউ কালেকশন নামে।

মাছুম রানা বলেন, অনেক কষ্ট করে এ পর্যন্ত এসেছি। মাত্রই সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছিলাম। পুরো সংসারের ভার আমার ওপর। দুই ভাই আমার সাথেই কাজ করত। তিন মাস আগে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছি। এখন কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। এর মধ্যে একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৪০ লাখ টাকা ঋণও আছে। সামনে শুধু অন্ধকার দেখছি। বঙ্গবাজারের ধ্বংসস্তূপের পাশে বিলাপ করছিলেন মো: হোসেন নামের এক ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, তার বাসা ধানমন্ডিতে। ঘটনার পর আর বাসায় যাননি। হোসেন বলেন, সব শেষ হয়ে গেছে। বাসায় গিয়ে কী হবে। সামনে ঈদ, কিভাবে কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। দোকানে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল ছিল। ঈদ উপলক্ষে আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ধার করে দোকানে মালামাল তুলেছিলাম। সব পুড়ে গেছে।

গতকাল সকালে বঙ্গবাজারে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বঙ্গবাজার যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকায় ব্যবসায়ীরা বিলাপ করছিলেন। তাদের দাবি, ধ্বংসস্তূপ থেকে মালামাল সরিয়ে নেয়ার পর ব্যবসায়ীদের যেন সেখানে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করার অনুমতি দেয়া হয়। কারণ সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয় ঈদুল ফিতরের সময়।

বঙ্গবাজার ইউনিটের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিচয় দিয়ে জহিরুল ইসলাম বলেন, এখানে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ চলছে। এগুলো সরানোর পরই অস্থায়ী ভিত্তিতে ব্যবসায়ীদের বসার ব্যবস্থা করা হবে।

বঙ্গবাজারে আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ শুরু করেছে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট দোকান মালিক সমিতি। মেয়রের সাথে কথা বলে ধ্বংসস্তূপে থাকা লোহালক্কর, টিন ও দোকানের স্যাটার দরপত্রের মাধ্যমে মেমার্স বুশরা ট্রেডার্সের কাছে ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠান নিজস্ব শ্রমিকের মাধ্যমে লোহালক্করগুলো সরানো কাজ কাল শুক্রবার সাড়ে ১০টা থেকে শুরু করা হয়। ট্রাকে করে ওই মালামালগুলো সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ধ্বংসস্তূপগুলো সরানো কাজে আসা মো: বাবুল নামের এক শ্রমিক বলেন, প্রায় ৩৭ জন শ্রমিক আমারা এখানে এসেছি। লোহালক্করগুলো নিয়ে যাচ্ছি। এগুলো সরিয়ে নিতে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ দিন লাগবে। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট দোকান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো: নাজমুল হুদা বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের পর প্রশাসনের প্রটেকশন না থাকার কারণে অনেক লোহালক্কর, টিন, স্যাটার ও মালামাল মানুষ নিয়ে গেছে। পরে আমরা মেয়রের সাথে কথা বলে এইগুলো বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে ধ্বংসস্তূপগুলো দ্রুত সরানো যায়। দরপত্রের মাধ্যমে মের্সাস বুশরা ট্রেডার্সের কাছে ৪০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। রোববারের মধ্যে এইগুলো সরানোর হবে। এইগুলো সরে গেলে পরে সিটি করপোরেশন ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করবে। ওই জায়গা পরিষ্কার করে আগামী বুধবারের মধ্যে ব্যবসায়ীদের অস্থায়ীভাবে এইখানে বসানো হবে।

লোহালক্কর বিক্রির ৪০ লাখ টাকা আপাতত ব্যবসায়ীদের তহবিলে থাকবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা খরচের এখতিয়ার আমাদের নেই। মেয়রের সাথে কথা বলে এই টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কাজে লাগানো হবে।

এখানে অস্থায়ীভাবে কতজন ব্যবসায়ীদের বসানো যাবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে তিন তলা পর্যন্ত দোকান ছিল। বঙ্গবাজারে ২৯৬১টি দোকান, মহানগরে ৭০০-এর বেশি এবং এনেক্সকো টাওয়ারে ৫১৯ দোকান অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৫ হাজারের মতো। এনেক্সকো টাওয়ারের ব্যবসায়ীদের এখানে বসানো হবে না। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা অস্থায়ীভাবে বসবে। পরিষ্কারের পর ওপরে ত্রিপাল লাগিয়ে একটা দোকানে দুই-তিনজন ব্যবসায়ীকে বসানো হবে। যাতে ঈদ উপলক্ষে ব্যবসার করতে সবাই বসার জায়গা পায়।

ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরির কাজ অব্যাহত আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শনিবার সিটি করপোরেশনের সাথে বসে তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। আগামী রোববার মেয়রের সাথে আমাদের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে আমরা ব্যবসায়ীদের চূড়ান্ত তালিকা মেয়র কাছে উপস্থাপন করা হবে।

৭৫ ঘণ্টা পর আগুন সম্পূর্ণভাবে নিভলো
প্রায় ৭৫ ঘণ্টা পর বঙ্গবাজার মার্কেটের ধ্বংসস্তূপে থেমে থেমে জ্বলা আগুন পুরোপুরি নিভেছে। ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: শাহজাহান শিকদার এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বঙ্গবাজারের আগুন পুরোপুরি নিভেছে।

ফায়ার সার্ভিস কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় মামলা: বঙ্গবাজার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের দিন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরে হামলা ভাঙচুরের ঘটনায় ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা করেছে ফায়ার সার্ভিস। ১৪টি গাড়ি ভাঙচুরসহ প্রায় ৩৯ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো: শাহিন আলম বাদি হয়ে বংশাল থানায় এ মামলা করেন। গতকাল শুক্রবার মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশের লালবাগ বিভাগরে উপকমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে হামলায় সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। অতর্কিত এ হামলায় ভাঙচুর করা হয় ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন মডেলের ১৪টি গাড়ি, মেইন গেটের সেন্ট্রি পোস্ট, প্রশাসনিক ভবন ও সিনিয়র স্টেশন অফিসারের অফিস। হামলায় আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৯ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা। শুধু তা-ই নয় হামলায় সিনিয়র কর্মকর্তাসহ আহত হন ফায়ার সার্ভিসের চার সদস্য।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জিডি করেছেন : বঙ্গবাজার আগুনে দোকানের মালামাল ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে যাওয়া ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা শাহাবাগ থানায় জিডি করেছেন। জিডির জন্য এনেক্সকো টাওয়ারের সামনে অস্থায়ী বুথ বসানো হয়েছে। এ ছাড়া শাহাবাগ থানায়ও জিডি নেয়া হচ্ছে।


https://www.dailynayadiganta.com/first-page/740080