৮ এপ্রিল ২০২৩, শনিবার, ১০:৪৯

রাষ্ট্র আমলাতন্ত্র ও নির্বাচন

ইবনে নূরুল হুদা

গণমানুষের কল্যাণ ও অধিকারের নিশ্চয়তার জন্যই রাষ্ট্র নামক সংঘের পথচলা শুরু হয়েছে। কিন্তু কালের বিবর্তনে ও সময়ের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের আঙ্গিক ও কর্মপরিধিগত পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় রাষ্ট্রের অঙ্গ তিনটি। নির্বাহী তথা শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। নির্বাহী বিভাগের মূল কাজ আইন অনুযায়ী শাসনকাজ পরিচালনা করা। আইন বিভাগের কর্তব্য নতুন আইন প্রণয়ন ও পুরাতন আইন সংশোধন। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে সুবিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের। রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের চেয়ে নির্বাহী বিভাগের কর্মপরিধি ও ক্ষমতা বিস্তৃত। তাই অপরাপর সকল বিভাগের উপরই নির্বাহী বিভাগ কর্তৃত্বশীল। তবে তা সুনিয়ন্ত্রিত ও সংবিধিবদ্ধ। রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের সুসমন্বিত কার্যক্রমই সুশাসনের চালিকা শক্তি।

সার্বিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে গ্রাম পুলিশ পর্যন্ত সকলেই নির্বাহী বিভাগের আওতাভুক্ত। সাধারণভাবে রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধানকে কেন্দ্র করে যে বিভাগ গড়ে ওঠে তাকেই এক কথায় নির্বাহী বিভাগ বলা হয়। নির্বাহী বিভাগের মধ্যমণি হচ্ছে ব্যুরোক্রেসী বা আমলাতন্ত্র। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র স্বত্ত্বা হলেও সেগুলো একে অপরের পরিপূরক। তবে নির্বাহী বিভাগ রাষ্ট্রের অপরাপর বিভাগের ওপর সংবিধিবদ্ধ পরিসরে কর্তৃত্বশীল।

অধ্যাপক গার্নারের মতে, নির্বাহী বিভাগের কার্যাবলীকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। (এক) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও শৃঙ্খলা বিষয়ক (Administrative), (দুই) পররাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও বৈদেশিক সম্পর্ক (Diplomatic), (তিন) সামরিক ব্যবস্থা (Military), (চার) বিচার বিষয়ক ক্ষমতা (Judicial) ও (পাঁচ) আইন বিষয়ক ক্ষমতা (Lagislative)। নির্বাহী তথা শাসন বিভাগকে সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে উপর্য্ক্তু সকল উপবিভাগের একটি কার্যকর সেতুবন্ধন জরুরি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের যেমন সক্রিয়তা দরকার ও ঠিক তেমনিভাবে নাগরিকদেরও হতে হবে দায়িত্বশীল। কারণ, সুনাগিরক কখনোই দায়িত্বহীন হতে পারেন না।

সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদে সুনাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, ''It is the duty of every citizen to observe the Constitution and the laws, to maintain discipline, to perform publice duties and to protect public property.’ অর্থাৎ ‘সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য’। তাই দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে সরকার, রাষ্ট্রযন্ত্র, রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে স্ব স্ব

অবস্থান থেকে দায়িত্ববান হতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থাটা খুবই ভঙ্গুর।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সুশাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশাসন সর্বব্যাপী হয়ে উঠেনি বা প্রশ্নাতীত হয়নি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নের যে তীব্রতাটা আরও বেশি। এক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হলো দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা ও সত্যনিষ্ঠতার অভাব। এজন্য স্বেচ্ছাচারিতা ও অনাধিকারচর্চাও কম দায়ী নয়। সুশাসন ব্যাহত হওয়ার জন্য এসবই অতি উল্লেখযোগ্য কারণ। তবে সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে আত্মস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ চর্চার ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকেও দায়ী করা যুক্তিযুক্তই মনে হচ্ছে। এর প্রভাব আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের সর্বত্রই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। তাই আমাদের দেশে সুশাসন নিয়ে প্রশ্নটাও বেশ তীব্র।

সুশাসন নিয়ে প্রশ্ন আরও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে সাম্প্রতিক কালের নির্বাচনগুলোকে কেন্দ্র করে। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সে প্রশ্নকে আরো জোরালো ভিত্তি দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সকল পক্ষেরই কম বেশি ব্যর্থতা রয়েছে। কারণ, সরকার, রাজনৈতিক শক্তি, রাষ্ট্রযন্ত্র, সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও নাগরিক সমাজ যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারতো তাহলে সাম্প্রতিককালের নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে এমন অনাকাঙিক্ষত প্রশ্নের সৃষ্টি হতো না। নির্বাচন নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুললেও এক্ষেত্রে যাদের জন্য নির্বাচন তথা নির্বাচকম-লী কিন্তু সন্তষ্ট হতে পারেনি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এটিই হচ্ছে প্রধান দুর্বলতা ও নেতিবাচক দিক। যা পুরো নির্বাচনকেই করে তুলেছে প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য। দেশী-বিদেশী নির্বাচন পর্যক্ষেকরা সে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ও সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিরোধী দলগুলোও এই নির্বাচনকে ‘জনগণের সাথে নির্মম প্রহসন’ হিসেবেই দেখতেই পুলকবোধ করছে। খোদ একজন নির্বাচন কমিশনারও নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন নির্বাচন পরবর্তী সময়ে। এমনকি বর্তমান কাজী হাবিবুল আওয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের একজন কমিশনার ‘আগামীতে রাতে নয় বরং দিনেই ভোট হবে’ বলে একাদশ জাতীয় সংসদের প্রহণযোগ্যতাকে আরো জটিল করে ফেলেছেন। আর এই নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলসহ প্রায় সকল মহল থেকেই নির্বাহী বিভাগ তথা প্রশাসনকে দায়ী করা হয়েছে। বিরোধী দলের পক্ষে বলা হয়েছে, ‘একটি স্বাধীন দেশের প্রশাসন এমন হতে পারে না’। এতে আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র বা জনপ্রশাসনের সম্মান বৃদ্ধি করেনি বরং তাদের বিরুদ্ধে পেশাদারিত্বের অভাব ও দলবাজীর অভিযোগ উঠেছে বেশ জোরালো ভাবেই। কারণ, কথিত এই রাতের ভোটে আমলারাই নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছেন বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অতি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ জনপ্রশাসন বা আমলাতন্ত্র। সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগগ্রগতিতে আমলারাই আইন ও বিধি-বিধানের আওতায় থেকে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সেই ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকেই আমলাতন্ত্রে পেশদারিত্ব গড়ে উঠেনি বা গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি। মূলত আমলারা রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে আখ্যা পেলেও উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনকে দীর্ঘায়িত করতেই যাত্রা শুরু হয়েছিল বৃটিশ আমলাতন্ত্রের। ফলে আমলারা রাষ্ট্রের কর্মচারী হওয়ার পরও সেই ঔপনিবেশবাদীদের অশুভবৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন নি। তাই গণপ্রশাসনের কাছ কাক্সিক্ষত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না বলে বরাবরই অভিযোগ উঠছে। এই অভিযোগ ক্রমেই তীব্রতা পাচ্ছে।

ঔপনিবেশিক আমলের আমলাতন্ত্রে সিভিল সোসাইটি ও জনগণের কাছে কোন জবাবদিহিতা ছিল না। সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল স্বাধীন পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রেও। সঙ্গত কারণেই সে সময় ''Civil Service’ কে ÔCattle Sevice’ হিসেবে কেউ কেউ ব্যাঙ্গ করতেন বলে একজন সিনিয়র আমলার আত্মস্বীকৃতি রয়েছে। বৃটিশ ও ভারতের অভিজ্ঞতায় পাকিস্তানের সেই আমলারা ছিল এলিট শ্রেণির এবং রাজনীতিবিদদের চেয়েও অধিক দক্ষ। তা দেশ ও জাতির জন্য অবশ্যই ইতিবাচকই হতে পারতো যদি আমলারা দায়িত্ব পালনে পেশাদারী, আইন, সংবিধান ও গণমানুষের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের উরুণচ-ী মনোভাব ও এক শ্রেণির আমলাদের দাসপ্রবণ মানসিকতার কারণেই আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র এখনো প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়নি।

মূলত, আমাদের দেশের চলমান নেতিবাচক রাজনীতিই গণপ্রশাসনকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে একশ্রেণির আমলাদের উচ্চাভিলাষ ও দলবাজী। প্রশাসনে যারা এখনও দুর্নীতি ও অবক্ষয়ের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি তারাও অনেক ক্ষেত্রেই সুযোগ সন্ধানী হয়ে গেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বস্তুত, দলবাজি সরকারের পাওয়ারের স্ট্রাকচারের ভেতর ঢুকে গেছে। ক্ষমতার প্রভাব বলয় থেকেই আমলাতন্ত্রের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কোন সরকারই ব্যুরোক্রেসিকে একটি পেশাদারি ও স্বাধীন স্বত্ত্বা হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেনি বরং তাদেরকে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে পরিবর্তে দলীয় দাসানুদাস বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই নেতিবাচক প্রবণতা আরও বেড়েছে। ফলে জনপ্রশাসন হারাতে বসেছে নিজস্ব স্বকীয়তা ও গণমুখী চরিত্র।

একথাও ঠিক যে, নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনের কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সংবিধানেও ব্যুরোক্রেসিকে কোনো প্রোটেকশন বা গুরুত্ব দেয়া হয়নি বলে দাবি করেন আমলারা। সঙ্গত কারণেই নিরপেক্ষভাবে কাজ করা বা স্বাধীনভাবে মতামত দেয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না বলেও দাবি করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কথিত জনস্বার্থের কথা বলে অনেক আমলাকে বাধ্যমূলক অবসরে পাঠানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমলাদের অপেশাদারী মনোবৃত্তিকেই দায়ী করছেন অনেকেই। তারা পেশাদারিত্ব দিয়েই এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারতেন। কারণ, রাজনৈতিক টোপ, চাপ ও দলবাজী মুক্ত থাকতে না পারলে আমলাদের পুরোপুরি পেশাদারি হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে না।

আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শাসনকাজে মূল ভূমিকায় থাকেন রাজনীতিকেরা। তবে এর বিভিন্ন স্তরে বিচিত্র ধরনের কাজের জন্য দরকার হয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর। সাধারণ্যে তারা সরকারি কর্মচারীরূপে পরিচিত হলেও আমাদের সংবিধান প্রণেতারা আখ্যায়িত করেছেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বলে। সরকারকে নীতিনির্ধারণে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা এবং সেই নীতি ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন তাদের দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আমলাদের অপেশাদারি ও দলবাজ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা সম্পর্কে রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অগ (Ogg) বলেন, (’’The body of the civil servants is an expert, professional, non-political, permanent and subordinate staff.’’) অর্থাৎ ‘রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাবৃন্দ হবে সুদক্ষ, পেশাদারি, অধিনস্ত কর্মকর্তা যারা স্থায়ীভাবে চাকরি করেন এবং রাজনীতির সাথে যাদের কোনো সংশ্রব নেই’।

বস্তুত, নেতিবাচক রাজনীতির কারণেই আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় পদায়ন, পদোন্নতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে নিয়োগ গণপ্রশাসনের কার্যকারিতা হ্রাস করে ফেলেছে। একশ্রেণির দলবাজ কর্মকর্তাও এজন্য কম দায়ি নন। আসলে জনপ্রশাসন চাপমুক্ত থেকে পেশাদারিত্ব বাজায় রাখতে পারলে নির্বাচনকালে ‘নির্দলীয়’ সরকারের দাবি উঠতো না। দুঃখজনক হলেও এটা সত্য, এসব কর্মচারীর একটি অংশ বেশ ইদানিং দলীয় বিবেচনাতেই তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এমনকি পরোক্ষভাবে দলীয় কার্যক্রমে যোগ দিচ্ছেন। ১৯৯৬ সালের আমলা বিদ্রোহের ঘটনাও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এতে ব্যক্তিগতভাবে তারা হয়তো অনেকেই লাভবান হয়েছেন। কিন্তু পরিণতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমলাতন্ত্রের পেশাদারিত্ব। সে দুষ্টক্ষত আজো আমাদেরকে তাড়িয়ে ফিরছে। দেশ ও জাতি বঞ্চিত হয়েছে সুশাসন থেকে। যা কোন স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

আমলাতন্ত্র পেশাদারি হয়ে উঠেনি বা প্রাতিষ্ঠানিক রূপও পায়নি তা সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘটনা প্রবাহ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে যে, এটা কোন নির্বাচন কোন নির্বাচন হয়নি বরং নির্বাচনের নামে প্রহসন হয়েছে। আর এর নেপথ্যে কাজ করেছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। যদিও নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, তবুও কমিশনের আবশ্যক হয় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সার্বিক সহযোগিতা। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে মূলত মাঠ প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা; বিশেষত পুলিশ প্রশাসন। ১৯৪৭-এর পর থেকে আজ অবধি এ ধরনের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে এসেছে। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির পর আইয়ুব খান তার ক্ষমতার বৈধতার জন্য গণভোটসহ সব নির্বাচনে প্রশাসনকে খোলামেলাভাবে ব্যবহার করেছেন। পরবর্তীতে শুধুমাত্র মাত্রার হেরফের ঘটলেও প্রশাসনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা থেকে খুব কম ব্যতিক্রমই দেখা গেছে। আর ২০১৮ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনপ্রশাসনকে যেভাবে বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করার অভিযোগ উঠেছে তা আমাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে।

এই নির্বাচনে প্রশাসন শুরু থেকেই বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে বলে জনসাধারণের মধ্যে অভিযোগ বেশ জোরালো। নির্বাচনে যেকোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার ক্ষেত্রে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দায়িত্ব হবে দৃঢ়তার সঙ্গে আইন ও ন্যায়ের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে এবং কোনো ধরনের অনুরাগ ও বিরাগের বশবর্তী না হয়ে দায়িত্ব পালন করা। তারা আইনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবেন, কোনো ব্যক্তি বা দলকে নয়। শক্তি প্রয়োগে তারা নিষ্ক্রিয়তা কিংবা অতি সক্রিয়তা কোনোটাই দেখানো ঠিক নয়। শান্তিপূর্ণ ও আইনসম্মত প্রতিবাদে কোনো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি অযৌক্তিক হবে। গ্রেপ্তার কিংবা শক্তি প্রয়োগের প্রশ্নে তারা কারও ইন্ধনে প্ররোচিত হওয়াও যথোচিত হবে না। কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনে তার পুরোপুরি ব্যত্যয় ঘটেছে বলে সর্বমহল থেকেই অভিযোগ করা হচ্ছে। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গণহারে গায়েবী মামলা দেয়ার অভিযোগ ছিল খুবই জোরালো। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো দূরের কথা বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণার ন্যূনতম সুযোগও পাননি। পক্ষান্তরে সরকার দলীয় প্রার্থীরা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সে নির্বাচনে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার অভিযানকে আইনশৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্ব বলে দাবি করা হলেও নির্বাচনে ভোট চুরি রোধে প্রশাসনের ভূমিকা রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন গর্হিত ও রাষ্ট্রবিরোধী কাজকে প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার অভিযোগও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। যা সরকারি কর্মচারী বিধিমালা ও সংবিধানের মারাত্মক লঙ্ঘন বলেই বিবেচিত। সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,’’Every person in the service of the republic has a duty to strive at all time to serve the people.’ অর্থাৎ ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকালে গণপ্রশাসনের ভূমিকার বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে। কথা উঠেছে নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা নিয়ে। আলোচনায় স্থান পেয়েছে নির্বাচনে ইভিএম-এর ব্যবহার নিয়ে। এ বিষয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন একেক সময় একেক কথা বলে সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি ইভিএম বিষয়ে বিরোধী দলগুলোর সাথে সংলাপের পর যে অবস্থান গ্রহণ করেছিল তা সর্বমহলেই সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু সে অবস্থানে কমিশন দৃঢ় থাকতে পারেনি বরং সকল আসনে ইভিএম-এর পরিবর্তে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাগজের ব্যালটে ভোট গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে নিজেদের সিদ্ধান্তহীনতা জাতির সামনে উন্মুক্ত করেছে। আবারো নতুন করে শুরু হয়েছে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি ও অনাকাক্সিক্ষত মামলা। যা গণপ্রশাসনের নিরপেক্ষতাকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এমতাবস্থায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। কারণ, নির্বাচন কমিশন ও গণপ্রশাসন যেভাবে দায়িত্ব পালন করছেন তা নিরপেক্ষ মানদণ্ডে কোনভাবেই উত্তীর্ণ নয়। তাই কেয়ারটেকার সরকারে দাবি উপেক্ষা করার নৈতিক কোন ভিত্তি আছে বলে মনে হয় না। বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই মঙ্গল।

https://dailysangram.com/post/521544