৭ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৪৫

এখনো ধোঁয়া উড়ছে ধ্বংসস্তূপে

৩০০ জনকে আসামি করে পুলিশের মামলা : থামছে না আহাজারি

রাজধানীর বঙ্গবাজারে ধ্বংসস্তূপ থেকে এখনো বের হচ্ছে ধোঁয়া। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তিন দিন পার হলেও এখনো পুরোপুরি নির্বাপণ ঘোষণা করেনি ফায়ার সার্ভিস। গতকালও এনেক্সকো টাওয়ারে থেমে থেমে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
আগুনে সর্বস্ব হারানো লোকগুলো ধ্বংসস্তূপে খুঁজে বেড়াচ্ছেন শেষ সম্বলটুকু। রাত-দিন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই চলছে তাদের আহাজারি।

এ দিকে অগ্নিকাণ্ডের সময় উত্তেজিত লোকজনের ফায়ার সার্ভিস কার্যালয় ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আড়াই শ’ থেকে তিন শ’ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেছে। এ ঘটনায় গ্রেফতার তিন আসামিকে এক দিন করে রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।

এ ছাড়া আগুনের ঘটনায় পুলিশ ও ব্যবসায়ীরা পৃথক সাতটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ ও ছবি তুলেছেন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট।
আগুনের তৃতীয় দিনেও গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কান্না আর আহাজারি চলছিল। বাকি কেনাবেচার হিসাবের খাতা পুড়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন তারা। বাকি থাকা কোটি কোটি টাকা পাওয়া নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে ক্ষতিপূরণের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন ঢাকা রেডিমেড গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা। তারা দ্রুত পুনর্বাসনের দাবি জানান।

পুরোপুরি নেভেনি এনেক্সকোর আগুন : বঙ্গবাজারের আগুন লাগার তিন দিনেও নির্বাপণ ঘোষণা করেনি ফায়ার সার্ভিস। গতকাল বৃহস্পতিবার ফায়ার সার্ভিসের দু’টি ইউনিট আগুন নেভাতে ও ডাম্পিংয়ের কাজ করে। এনেক্সকো টাওয়ারের পাঁচতলা থেকে মালামাল সরানোর সময় কিছু আগুন দেখা যায় বলে ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, আগুন এখনো সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা যায়নি। দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করছে। আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা মূলত এখন ডাম্পিংয়ের কাজ করছে। আগুনের ধ্বংসস্তূপ সরানোর সময় নিচ থেকে আবারো কিছু জায়গায় আগুন জ্বলে উঠছে। পরে সেসব আগুন নেভানো হচ্ছে। এ আগুনগুলো পুরোপুরি নেভানো গেলে ফায়ার সার্ভিস সম্পূর্ণ নির্বাপণ ঘোষণা করবে।

এনেক্সকো টাওয়ারে দেখা যায়, আগুন লাগার তৃতীয় দিনেও সেখান থেকে পোড়া ও বেঁচে যাওয়া মালামাল সরানো হচ্ছে। কেউ কেউ উপর থেকে মালামাল নিচে ফেলছেন, আবার কেউ মাথায় করে নিচে নামছেন। টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী সালাম বলেন, পাঁচ তলায় এখনো ধোঁয়া উড়ছে, আবার মাঝে মধ্যে আগুনও জ্বলে উঠছে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন সেগুলো নেভানোসহ ডাম্পিংয়ের কাজ করছেন।

থামেনি আহাজারি : বঙ্গবাজারে আগুনের তৃতীয় দিনে গতকালও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কান্না আর আহাজারি করতে দেখা গেছে। এখানকার বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর গ্রামের বাড়ি ঢাকার বাইরে। আগুনের খবর পেয়ে গ্রাম থেকে পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা খোঁজ-খবর নিতে ছুটে আসছেন। তাদের দেখা মাত্রই চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা খোঁজ-খবর নিতে আসছেন। তাদের পক্ষে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা দ্রুত ক্ষতিপূরণসহ সরকারের কাছে পুনর্বাসনের দাবি জানান। এক ব্যবসায়ী বলেন, ঈদ উপলক্ষে দোকানে শিশুদের নতুন পোশাক তুলেছিলাম। সবমিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। এখন যদি দ্রুত ব্যবসা শুরু করা যেত, তবে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হতো। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আগুন লাগার তিন দিন আগে ২৫ লাখ টাকার মালামাল উঠিয়েছি। যদি বুঝতাম আগুন লাগবে তাহলে কি আর ধারদেনা করতাম। আশা ছিল ঈদে বিক্রি করে সবার দেনা শোধ করে দেবো; কিন্তু কিভাবে পাওনা শোধ করব বুঝতে পারছি না।
ব্যবসায়ীরা বলেন, এখানকার নিয়ম ছিল, বড় ব্যবসায়ীরা পাইকারিতে ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে বাকিতে পণ্য বিক্রি করতেন। অনেকে আবার ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বাকিতে পণ্য বিক্রি করতেন। সবকিছুর হিসাব বকেয়া খাতায় লেখা থাকত। আগুনে সব খাতা পুড়ে যাওয়ায় বড় ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়েছেন তেমনি ছোট ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন। কিভাবে পাওনা টাকা আদায় করবেন, আর কিভাবে শোধ করবেন সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

বঙ্গবাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও এনেক্সকো টাওয়ারের পরিচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, মার্কেট পুড়ে যাওয়ায় বড়-ছোট সবধরনের ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন। ব্যবসা না থাকলে টাকা ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তাও থাকে না। তারা দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসনের দাবি জানান।

৩০০ জনকে আসামি করে মামলা : বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডের সময় পুলিশের ওপর হামলা ও কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে অজ্ঞাত ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গতকাল বংশাল থানায় পুলিশ বাদি হয়ে মামলাটি দায়ের করে। ওই মামলায় ইতোমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে তাদের এক দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন জানান, বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর অগ্নিনির্বাপণের সময় ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতর ও সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ বাধা দিতে গেলে পুলিশের ওপর হামলা করা হয়। অগ্নিকাণ্ডের দিন পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান ডিসি জাফর হোসেন। এ দিকে অগ্নিকাণ্ডের সময় কাজে বাধা, সদস্যদের ওপর হামলা ও সদর দফতরে ভাঙচুরের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পৃথক মামলা দায়েরের কথা রয়েছে।

পুলিশ-ব্যবসায়ীদের সাত জিডি : বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় শাহবাগ থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে একটি জিডি করা হয়েছে। এই ঘটনায় আরো পৃথক ছয়টি জিডি করেছেন ব্যবসায়ীরা। পুলিশের পক্ষ থেকে জিডির তথ্য নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো: শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে শাহবাগ থানায় গত বুধবার একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ব্যবসায়ীদের জিডির বিষয় শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ বলেন, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ছয়জন ব্যবসায়ী আলাদা করে জিডি করেছেন।

আলামত ও ছবি সংগ্রহ সিআইডির : বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে যাওয়া এলাকা পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহের পাশাপাশি পুড়ে যাওয়া বিভিন্ন জিনিসের ছবি তুলেছেন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। বৃহস্পতিবার বেলা ৩টার দিকে এনেক্সকো টাওয়ারের ডান পাশে পুড়ে যাওয়া মার্কেটে সিআইডি ক্রাইম সিনের সদস্যরা আলামত সংগ্রহ করেন। এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ছয়জনের একটা দল এখানের পোড়া স্তূপ থেকে কিছু আলামত সংগ্রহ করেছি। কিভাবে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। আমরা এখানে ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি।

তালিকা করে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা : প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুনের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের তালিকা করে সহযোগিতা করা হবে। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে এ তালিকা করা হবে। এ ছাড়া ঈদের আগেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা শুরু করার সুযোগ দেয়ার আশ্বাস দেন তিনি। গতকাল সকালে বঙ্গবাজার পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় শেষে এসব কথা বলেন।

সালমান এফ রহমান বলেন, ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তাদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য কাজ করছি। ইতোমধ্যে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য আমাকে ফোন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলেছি। আর্থিক অনুদানের জন্য একটি যৌথ ব্যাংক হিসাব, বিকাশ, নগদ, রকেট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য তাদের পরামর্শ দিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ঈদের আগেই ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ করে দেয়া হবে বলেও আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/739848