৭ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার, ৭:৪২

বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব দূর করার রোল মডেল বাংলাদেশ

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

সরকারি লোকদের কথায় শুনি বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে রোল মডেল হওয়ার অভাবনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল, গণতন্ত্রের রোল মডেল, নারীর ক্ষমতায়নের রোল মডেল, গৃহহীনদের গৃহ দেয়ার রোল মডেল, (দরিদ্র যদি এখনও কেউ থাকে) খাবার দেওয়ার রোল মডেল, করোনা মহামারির সময় নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেওয়ার রোল মডেলÑ এমনি আরও অনেক কিছু।

বলা হয়নি যে, পুকুরের পাড় বাঁধানো স্কুল ছাত্রদের জন্য খিচুড়ি খাওয়ানোর ট্রেনিং, পাঁচশত টাকার জিনিস কীভাবে পঞ্চাশ হাজার টাকায় কেনা যায় সে ব্যাপারে রোল মডেল। সাহেদের মতো লোকদের কোটি কোটি টাকা খাওয়ার রোল মডেল, চার-পাঁচ গুণ দামে বিদ্যুৎ কেনার রোল মডেল, নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়নের রোল মডেল- এসব কথা বলা হয়নি। বলা হয়নি দায়মুক্তি দেয়ার কৌশলের রোল মডেল এমনি আরও অনেক কিছু।

তবে সর্বশেষ এবং সবচাইতে উল্লেখযোগ্য রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে বেকারত্ব দূরীকরণ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি যে তত্ত্ব হাজির করেছে, সে তত্ত্ব অনুযায়ী বাংলাদেশ তো বটেই সোমালিয়া-বুরুন্ডিতেও একজন লোকের পক্ষেও বেকার থাকা অসম্ভব। তার পরেও যে কী করে দেশে এখনও ২৬ লাখ ৩০ হাজার লোক বেকার আছে সেটা ভাববার বিষয়। বিবিএস জানিয়েছে, জরিপ পরিচালনায় আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থানের সংজ্ঞা অনুসরণ করা হয়। তাতে বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি সপ্তাহে একদিন অর্থের বিনিময়ে এক ঘণ্টা কাজ করেন, তাহলে তিনি আর বেকার নন।

বুঝলাম সরকার যেভাবে চায় (বিবিএস) সেভাবে রিপোর্ট দেয়। কোথায় কি লেখা আছে জানি না। কেউ যদি পরিবারের জন্য হাঁস-মুরগি পালন করেন তাহলেও ধরে নিতে হবে তিনি কর্মসংস্থানেও নিয়োজিত আছেন। এমনকি উৎপাদনশীল খাতে কাজের মজুরি না পেলেও তাকে বেকার বলা যাবে না। ১৫ বছর এবং তার বেশি বয়সীদের শ্রমশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

বিবিএসের প্রতিবেদনে দেশে বর্তমানে বেকার ৩.৬ শতাংশ। পাঁচ বছর আগে যা ছিল ৪.২ শতাংশ। দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৬ লাখ ৩০ হাজার। পাঁচ বছর আগে ছিল ২৭ লাখ। অর্থাৎ গত ৫ বছরে দেশে বেকার কমেছে ৭০ হাজার। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, পাঁচ বছরে দেশে শ্রম বাজারে যুক্ত হয়েছে আরো কয়েক লাখ লোক। এর মধ্যে ১৫ বছরের কিশোরও অন্তর্ভুক্ত। তাদের সবার কর্মসংস্থান করেও আরো ৭০ হাজার লোকের কাজের ব্যবস্থা করা চাট্টিখানি কথা নয়। এর মধ্যে গেছে কোভিড-১৯ মহামারি কাল। তার ওপর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জন্য বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে কোনো সরকার যদি লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করে দিতে পারেন তাহলে তাদের সাবাসি দিতে দোষ কোথায়।

আইএলও কর্মসংস্থান খাতের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. রিজুয়ানুল ইসলাম বলেছেন, ২০২২ সালের শ্রম শক্তি জরিপের উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, ২০১৬-২০১৭ সালের তুলনায় বেকারত্বের হার কমেছে। কিন্তু একে সুসংবাদ বলে মনে করা যায় না। কারণ আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী জরিপে যেভাবে বেকার চিহ্নিত করা হয়, তা থেকে বাংলাদেশের মতো দেশের শ্রমবাজারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এ সংজ্ঞায় জরিপের আগের সপ্তাহের ১ ঘণ্টাও কাজ করেননি, কিন্তু কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে কাজ খুঁজছিলেন এই তিনশর্ত পালন করলেই একজনকে বেকার বলে গণ্য করা হয়। যেসব দেশে বেকারদের জন্য কোনো ভাতা বা সহায়তা নেই এবং তাদের একটা বড় সংখ্যা দরিদ্র সেসব দেশে এক ঘণ্টাও কাজ করেননি এমন মানুষের সংখ্যা কম হওয়ারই কথা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, আর্থিক অনটনের কারণে অনেকে কিছু একটা করে সামান্য হলেও উপার্জনের চেষ্টা করেন। এ ধরনের মানুষ বেকার হিসেবে চিহ্নিত না হলেও তারা একেবারেই হতদরিদ্র। এই শ্রেণির মানুষের সংখ্যা বাড়ল না কমল তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ড. রিজুওয়ান বলেন, ২০২২ সালে জরিপ অনুযায়ী মোট কর্মসংস্থান কৃষিক্ষেত্রে বেড়েছে। শিল্পখাতে কমেছে। কোভিড মহামারির সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিল যে, শিল্প খাতে শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। আর শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো দেশে কৃষি উদ্বৃত্ত শ্রমিক রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হলে কৃষি থেকে কিছু শ্রমিক শিল্প খাতে যাবে এমনটি আশা করা হয়। সেখানে কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং শিল্প খাতে হ্রাস পাওয়া অবশ্যই উল্টোমুখী প্রবণতা। এটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক দুরবস্থার ইঙ্গিত দেয় অন্যদিকে নীতিমালার ব্যর্থতারও পরিচায়ক।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইএলও’র মানদণ্ডে বাংলাদেশে বেকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করলে তাতে প্রকৃত বাস্তবতা পাওয়া যাবে না। এ কারণে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। আইএলও’র আরো সংজ্ঞা আছে। যেমন- শ্রম কতটা কার্যকর অর্থাৎ সপ্তাহের ৪০ ঘণ্টার আয় দিয়ে ব্যয় মিটানো সম্ভব কিনা তার ভিত্তিতে। তার মতে, গত পাঁচ বছরে অর্থনৈতিক কাঠামো এবং বিবিএস জরিপে কর্মসংস্থানের তথ্য বিপরীতমুখী। শিল্প খাতের সম্প্রসারণ বিবেচনা করেই বাংলাদেশকে পৃথিবীর দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির অন্যতম দেশ বলে মনে করা হয়। বিবিএস’র প্রতিবেদন অনুযায়ী পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিক বেড়েছে। তাহলে কি শিল্পের চেয়ে কৃষিতে নারী শ্রমিক হঠাৎ করেই বেড়ে গেল? এছাড়া বলা হচ্ছে, করোনার সময় কর্মসংস্থান বেড়েছে বাস্তবতার সঙ্গে যা মেলানো যায় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং-এর (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, গত পাঁচ বছরে দেশে বেকার মানুষের সংখ্যা কমেছে। এই তথ্য বিশ^াসযোগ্য নয়। বাস্তবতা অনুযায়ী বেকারত্ব আরো বেড়ে যাওয়ার কথা। বিবিএস-এর প্রতিবেদনে ছদ্ম বেকারের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। অথচ এই শ্রেণির বিশাল একটা অংশ বেকারের যন্ত্রণায় ভুগছে। তিনি বলেন, শ্রম বাজারে স্বল্প দক্ষতা এবং মজুরি ও কর্ম উৎপাদনশীলতার দুষ্ট চক্র রয়েছে। সেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতে যে আধিপত্য রয়েছে তা পরিষ্কার নয়। বিবিএস বলেছে, গত পাঁচ বছরে নারীর কর্মসংস্থান সাত শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এই পাঁচ বছরে কি এমন ঘটেছে যাতে নারীর কর্মসংস্থান এতো বাড়ল?

আমি অর্থনীতিবিদ নই। আমার হিসেবে তাকেই কর্মে নিয়োজিত বলা যায়, যিনি ঐ কর্মের মজুরি দিয়ে; নিজে ও তার পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারেন। যে শ্রমিক মাসে মাত্র ৪ ঘণ্টা কাজ করে বেকারের নাম খোচালেন, তিনি তো তার চার ঘণ্টার মজুরি দিয়ে নিজে তিন দিনও খেতে পারবেন না তার নাম বেকারের খাতা থেকে কেন কেটে দিল বিবিএস। সেটা কি বাংলাদেশকে বেকারত্ব দূরীকরণের রোল মডেল হিসেবে বিশে^র সামনে তুলে ধরার জন্য? হায় বিবিএস, হায় সরকার, হায় রোল মডেল!

https://dailysangram.com/post/521462