হাওরের বিষাক্ত মরা মাছ খেয়ে হাজারো হাঁসের মৃত্যু; ইনসেটে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে খামারের মরা হাঁস ;নয়া দিগন্ত
২১ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৩৬

হাওরে এবার মরছে হাঁস

প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও অকাল বন্যায় পুরো হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল তলিয়ে তা পচে পানিতে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাসে মরে যাওয়া মাছ খেয়ে ঝাঁকে ঝাঁক হাঁস মারা যাওয়ায় কৃষক ও খামারিদের মাথায় বাজপড়ার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে হতাশায় নিমজ্জিত বিপর্যস্ত কৃষকেরা এখন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন।
গত শনিবার সন্ধ্যার পরপর কালবৈশাখীতে হাওরের পানিতে প্রচণ্ড ঢেউয়ে উত্তাল হওয়া পানি থেকে বাতাসে বিষাক্ত দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে। বিষাক্ত ‘হাইড্রোজেন সারভাইট’ গ্যাসের প্রভাবে পুরো হাওরাঞ্চলজুড়ে মাছ মরে পানিতে ভাসতে থাকে। আর সেই মরা মাছ খেয়ে কৃষক ও খামারিদের ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস মরতে শুরু করে। হাওরের বিশাল জলরাশির নিচে পচা ধান আর পানির ওপর মরা মাছ ও হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে।
নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের ডিঙ্গাপেতা, খালিয়াজুরীর কিত্তনখলা, জালিয়ার, গণেশহাওর, সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার টাঙ্গুয়া, টগা, চন্দ্রসোনারথাল, শোনামড়ল, ধরাম, জয়ধলা, ঘোড়াডোবা, ধানকুনিয়া ও সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওরসহ অন্যান্য হাওরে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। গত কয়েক দিনে ওই সব হাওরে কমপক্ষে দেড় সহস্্রাধিক হাঁস মারা যায়। বিশাল হাওরের পানিতে পালিত হাঁসের ডিম বিক্রি করে কৃষক ও খামারিরা জীবন ধারণ করে থাকেন। কৃষক ও খামারিরা একশ্রেণীর মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে বোরো জমি চাষাবাদ ও হাঁস লালন পালন করে থাকেন। কিন্তু এই দুর্বিপাকে পড়ে হাওরের বেশির ভাগ কৃষক ও খামারিরা এখন নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এখন তারা কিভাবে সংসারের ব্যয়ভার বহন করবেন আর ঋণই কিভাবে পরিশোধ করবেন এই দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এই দুর্ভাবনায় খালিয়াজুরীতে দুইজন ও মদনে তিন কৃষক হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছেন।
মোহনগঞ্জের হাওর এলাকা মল্লিকপুর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ঋণ নিয়ে বোরো জমি চাষাবাদ করছিলাম, কিন্তু আগাম বন্যায় ফসল তলাইয়া সব শ্যাষ হইয়্যা গেছে। এহন ক্যামনে চলবান আল্লাই জানেন। খালিয়াজুরী কিত্তনখোলা হাওর পাড়ের খামারি রইছ উদ্দিন বলেন, এনজিওর কাছ খাইক্কা কিস্তিতে ঋণ নিয়া হাঁস পালছিলাম কিন্তু বিষাক্ত মাছ খাইয়া আমার বেবাক হাঁস মইরা গেছে। এহন বউ, পেলাপান লইয়্যা কি কইরা চলবাম আর ঋণের চাপই বা ক্যামনে সইবাম। ধর্মপাশা উপজেলার দুগনই গ্রামের আবু লায়েছ বলেন, ক্ষেতের খোরাক দিয়া বছর যাইতো মাছ ধইরা সংসার চলতো। বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমকে বলেন, অনেকে সান্ত্বনা দিছে কিন্তু ক্যামনে বাঁচবাম হেইডা কইছে না।
বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমকে বলেন, বোরো ধান পাকার আগেই অকাল বন্যায় পানির নিচে তলিয়ে পচে ‘টক্সিন বা অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হওয়ায় হাওরের পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ে। এই বিষক্রিয়ায় হাওরের মাছ মরে ভেসে উঠছে। আর সেই বিষাক্ত মাছ খেয়ে হাঁসও মরছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা নয়া দিগন্তকে বলেন, পানির নিচের কাঁচা ধান পচে এক ধরনের অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে থাকতে পারে। এতে মাছ মরে যাচ্ছে আর সেই মাছ খেয়ে হাঁসও মরে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিষয়ািট নিশ্চিত হতে হলে এর নমুনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুবই জরুরি। তাহলে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা সহজ হবে। এ ছাড়া এমতাবস্থায় সবাইকে হাওরের পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করা উচিত।
গতকাল বিকেলে নয়া দিগন্তের ধর্মপাশা উপজেলা সংবাদদাতা গিয়াস উদ্দিন রানা এই প্রতিবেদককে বলেন, হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার প্রচণ্ড বৃষ্টির পর গতকাল থেকে বাতাসের বিষাক্ত গন্ধ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। মাছ ও হাঁস যেভাবে মরতে শুরু করেছিল সে অবস্থারও কিছুটা উন্নতি হচ্ছে।
হাওর এলাকা থেকে নেত্রকোনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন আহমদ জানান, হাওরের পানিতে বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে গত চার দিনে জেলায় কমপক্ষে ৭০০ টন মাছ মরে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এর পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। ডিঙ্গাপোতা, কিত্তনখলা, জালিয়ার হাওরসহ ডেঞ্জার পয়েন্টে পানি বিশুদ্ধকরণে চুন ও অক্সিজেন জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়েছে। আশার কথা ধীরে ধীরে ভয়াবহ অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করেছে।
ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ধর্মপাশা উপজেলায় অকাল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম হানিফ। স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ তার সফরসঙ্গী ছিলেন।
ধর্মপাশায় ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাইবোর) যোগসাজশে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির পিআইসি ও ঠিকাদার একে অন্যের সহযোগিতায় প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন না করেই কোটি কোটি টাকা লুটপাট করায় অকাল বন্যা সব ক’টি হাওরের কৃষকদের লাখ লাখ টন বোরো ধান তলিয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পেটে নেই ভাত, গোলায় নেই ধান, গোয়ালে নেই গরু, হাওরে নেই মাছ। এসব সর্বহারা ক্ষুধার্ত কৃষকদের আহাজারি দেখতে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম হানিফ, হেলিকপ্টারে গতকাল ২০ এপ্রিল সাড়ে ১২টায় উপজেলার হেলিপ্যাড মাঠে নেমে ক্ষতিগ্রস্ত হাওর পরিদর্শন করেন। তার সফরসঙ্গী ছিলেন, সাংগঠনিক সম্পাদক (সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) আহম্মদ হোসেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামিম আহমেদ বিলকিস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সদস্য শামিম আহমেদ মুরাদ, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সদস্য মোজাম্মেল হক রোকন ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সাথে ছিলেন।
জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, জগন্নাথপুরে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসল পচে অ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে হাওর, নদী ও জলাশয়ে সকল প্রকার মাছের বংশ ধ্বংস হওয়ার পর এবার মাছের পর মরছে হাজার হাজার হাঁসসহ বিভিন্ন পাখি। হাওর নদী জলাশয়ে মরে যাওয়া মাছগুলো ভেসে ভেসে ফিরছে আর এসব মাছ খামারীদের হাস ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি খেয়ে ফেলার সাথে সাথে মরে যাচ্ছে। হাওর নদী থেকে বাতাসের সাথে একদিকে ভেসে আসছে মরা মাছের দুর্গন্ধ, অন্য দিকে মরা হাঁস ও পাখির পচা দুর্গন্ধের পাশাপাশি পানিতে তলিয়ে যাওয়া বোরো ফসলের পচা দুর্গন্ধ সব মিলিয়ে হাওর ও নদীর পাড়ে বসবাসকারীরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। হাওর ও নদীর সাদা পানি কালচে হয়ে বিষাক্ত আকার ধারণ করেছে। ব্যবহার অনুপোযোগী এসব পানি থেকে রোগজীবাণু ছড়াতে পারে। লোকজন গোসল করা থেকে শুরু করে সকল প্রকার ব্যবহারের জন্য নলকূপের পানি ব্যবহার করছেন। অনেক গ্রামে পাড়া মহল্লায় পর্যাপ্ত নলকূপ না থাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাবে লোকজন নদী ও হাওরের দুর্গন্ধযুক্ত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এ দিকে গত ১৫ এপ্রিল সন্ধ্যা রাতে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের পর এ পর্যন্ত উপজেলার নলুয়া, মইয়া, পিংলার হাওর এবং নলজুর নদীসহ বিভিন্ন হাওর নদী খাল জলাশয়ে ২৫-৩০ মেট্রিকটন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ মরে ভেসে ওঠে। হাওরের ফসল পচে যাওয়ায় দুর্গন্ধের কারণে এখনো অ্যামোনিয়া গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে মাছ মরে ভাসছে। আর এসব পচা মাছ খেয়ে এ পর্যন্ত উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের পালপুরা বন হাওরে খামারি কাশেম মিয়ার খামারের চার হাজার হাঁসসহ উপজেলার বিভিন্ন হাওরে পাঁচ সহস্্রাধিক হাঁসের মৃত্যু হয়েছে। দরিদ্র পরিবারের খামারী কাশেম মিয়ার শেষ সম্বল খামারের চার হাজার হাঁস পচা মাছ খেয়ে মরে যাওয়ায় ঋণের বোঝা নিয়ে দিশেহারা হয়ে খামার পাড়ে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। এভাবে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের নদী ও হাওর পাড়ের গ্রামগুলোতে হাঁস পালনকারী ব্যক্তিরা তাদের চোখের সামনে হাঁসগুলোর মৃত্যুর ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। এনজিও থেকে উত্তোলনকৃত ঋণের টাকায় হাঁস কিনে ডিম বিক্রি করে সংসার চালানোর আশা করেছিলেন হাওরবাসী। এনজিও থেকে আনা ঋণ এখন তাদের গলার ফাঁস হয়ে দেখা দিয়েছে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/213801