৬ এপ্রিল ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ১২:৪৭

অগ্নিকাণ্ড বেড়েই চলছে ॥ পুড়ে ছাই হচ্ছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ

গত বছর (২০২২ সালে) সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৪ হাজার ১০২টি। ২০২১ সালে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ২১ হাজার ১০৬টি। সে তুলনায় আগের বছরের চেয়ে গত বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েছে ২ হাজার ৯৯৬টি। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী গত একযুগে দেশে বড় অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ১৪টি ঘটনায় অন্তত ৫৬৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।

সর্বশেষ মঙ্গলবার দেশের সবচেয়ে বড় তৈরি পোশাকসহ পাইকারি কাপড়ের মার্কেট রাজধানীর বঙ্গবাজারসহ চারটি মার্কেট ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের চেষ্টায় সাড়ে ৬ ঘন্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এ ঘটনায় দু‘টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে অগ্নিকা-টি ভোরে হওয়ায় কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

এর কয়েকদিন আগে রাজধানীর সাইন্সল্যাব ও গুলিস্তানে ভবনে বিস্ফোরণে অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু হয়। পরে আলোচনায় আসে তিতাসের গ্যাস লাইনের দুর্বলতা ও দুর্নীতি, মেয়াদোত্তীর্ণ ভবন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদাসীনতা-অবহেলা ও দুর্নীতির বিষয়টি। কিন্তু ২৭ জনের মৃত্যুর পরও এর দায়ে দেখভালকারী সরকারি কর্তৃপক্ষের কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়নি। যদিও দুর্ঘটনা ঘটলেই কিছু ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারের আওতায় আনা হয় ভবন মালিক বা সংশ্লিষ্টদের। তবে যেসব সরকারি কর্তৃপক্ষের অবহেলায় এতগুলো প্রাণ ঝরে যাওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াল সংশ্লিষ্ট ভবনটি, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা না থাকায় ক্ষোভ কাজ করছে মানুষের ভেতর। এদিকে বঙ্গ বাজারে ঈদের আগে আগুনের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এতে পথে বসেছেন কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। এ অগ্নিকা-টি দুর্ঘটনা না নাশকতা তা ক্ষতিয়ে দেখছে গোয়েন্দারা।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের গত পাঁচ বছরে তথ্য পর্যবেক্ষণ মতে, ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে কম অগ্নিকা- ঘটে বরিশাল বিভাগে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনের মতে, অসচেতনতাই অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ। তাছাড়া শহরগুলো দ্রুত নগরায়ণ হলেও সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে না নগরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের বিষয়। দিন দিন সুউচ্চ ভবনে শহর ভরলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা উপেক্ষিত। পরিবারের চুলা আর শর্ট সার্কিটের আগুনের বিষয় সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দেন তারা। তারা বলেন, এসব ক্ষেত্রে একটু সচেতন হলেই মূল্যবান জীবনের সঙ্গে অর্থসম্পদ রক্ষা করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনের পর দিন সুউচ্চ ভবনগুলো গড়ে উঠছে ইমারত নির্মাণবিধিকে উপেক্ষা করে। এ বিষয়গুলো মনিটরিং করা হচ্ছে না। আবার যারা ইমারত নির্মাণ করছেন তারা কিছু টাকা আর জায়গা বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই আগুনজনিত দুর্ঘটনায় নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করেন। ফলে গায়ে গায়ে লেগে থাকা ইমারতের একটিতে আগুন লাগলে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে আশপাশে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স থেকে জানা যায়, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা, যন্ত্রাংশের সংঘর্ষ, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্র, সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, খোলা বাতির ব্যবহার, চুলার আগুন, মিস ফায়ার, চিমনি, রাসায়নিক বিক্রিয়া, বাজি পোড়ানো ইত্যাদি কারণে আগুন লাগে। প্রায় প্রতি মাসে একাধিক আগুন লাগে। বিশালসংখ্যক অগ্নিকা-ের নেপথ্যে শহরে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ (এসি, ফ্রিজ), গ্যাসের চুলাসহ আবাসিক এলাকায় দাহ্যপদার্থ রাখা, কারখানা স্থাপন প্রভৃতি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়।

অগ্নিকাণ্ডের কিছু তথ্য : ২০১৭ সালে মোট ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৫৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৬ টাকা ক্ষতি হয়। এসব অগ্নিকাণ্ডে ২৬৯ জন আহত ও ৪৫ জন নিহত হন। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ৫১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে ২২ হাজার ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ৩৩০ কোটি ১৫ লাখ ৩৩ হাজার ১৯০ টাকার অধিক ক্ষতি হয়। পাঁচ বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বাড়ে ৪১১৭টি বা ২২ শতাংশ। এ সময় ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে ৭৩ কোটি ৯ লাখ ৫১ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল এই পাঁচ বছরে অগ্নিকাণ্ডের কারণে মোট ৩ হাজার ৯৩ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ৮৬৩ জন আহত হয়। আর ২০২২ সালে দেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৯৮ জন। আর আহত হয়েছেন ৪০৭ জন। এর মধ্যে সাধারণ জনগণ ৮৫ জন এবং ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৩ জন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা সংক্রান্ত ২০২২ সালের বার্ষিক পরিসংখ্যানে এই তথ্য জানা গেছে।

এছাড়াও ফায়ার সার্ভিসের ওয়েবসাইটে সবশেষ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, যা ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। বার্ষিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারাদেশে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকা। অগ্নিকাণ্ডে ৭২ জন পুরুষ ও ১৩ জন সাধারণ নারী নিহত হয়েছেন। আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিহত হয়েছেন ১৩ জন। ২০২২ সালে অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন মোট ৪০৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৩০৩ জন এবং নারী ৭৪ জন। আর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হয়েছেন ৩০ জন। বার্ষিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২২ সালে সারাদেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮.৪৮ শতাংশ বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে হয়েছে। এছাড়া বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে ১৬.০৮ শতাংশ এবং চুলা থেকে ১৩.৯৮ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ৬৫৫৮টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে বাসাবাড়ি বা আবাসিক ভবনে। রান্নাঘরে সংঘটিত আগুনের সংখ্যা ২২৮৭টি, শপিংমল ও মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ছিল ৫৮৯টি। ২০২২ সালে পশু-পাখি ও প্রানী উদ্ধারের ঘটনা ছিল ৫১৪টি। মোট ৫৩০টি প্রাণী উদ্ধার হয়েছে।

আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে: ফায়ার সার্ভিসের ২০২১ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬০১টি। ওই বছর বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৭ হাজার ৯৫৫টি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। যা সে সময়কার মোট আগুনের ৩৬.৮২ শতাংশ। সে তুলনায় ২০২২ সালে বৈদ্যুতিক গোলযোগে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে ১৩২০টি। একইভাবে ২০২১ সালে বিড়ি-সিগারেটের টুকরো থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ছিল ৩ হাজার ১৯৩টি। সে তুলনায় ২০২২ সালে এ থেকে অগ্নিকা- বেড়েছে ৬৮৫টি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর জবাবদিহিতার অভাবেই তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। তাদের মতে সিটি করপোরেশন এবং ফায়ার সার্ভিসসহ জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। তারা বলেন, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থায় কেউ বিনিয়োগ করতে চান না। যে কারণে বিপুল সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। আর প্রাণ যাচ্ছে অনেকের। বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের পেছনে নাশকতা থাকতে পারে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্টদের। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেছেন, বঙ্গবাজার মার্কেটকে ২০১৯ সালে ফায়ার সার্ভিস ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে মার্কেটের বিভিন্ন স্থানে ব্যানার টাঙিয়ে দিয়েছিল। অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে তাদের বিভিন্ন সময়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্যদের নিয়েও ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরে বঙ্গবাজারের নিরাপত্তা বিষয়ে করণীয় নিয়ে সভাও হয়। এ সময় তাদের বিভিন্ন রকম পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু এসব পরামর্শ বাস্তবায়ন হয়নি।

https://dailysangram.com/post/521387